মস্তিষ্কের কাজ বাড়াতে হবে

বিশ্ব পারকিনসন্স দিবসে চিকিৎসকরা

 

বিশ্ব পারকিনসন্স দিবসে চিকিৎসকরা বলেন, সচেতন হোন, প্রতিরোধ করুন। মস্তিষ্কের কাজও বাড়াতে হবে।
সোমবার (১১ এপ্রিল) ছিলো বিশ্ব পারকিনসন্স দিবস। এ উপলক্ষে মুভমেন্ট ডিজঅর্ডার সোসাইটি অব বাংলাদেশ এবং হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড চ্যানেল আইতে আয়োজন করে একটি বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠানের। জনসাধারণকে সচেতন করাই ছিল এ আয়োজনের উদ্দেশ্য। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল- পারকিসন্সের একতাবদ্ধতা হই।

নিচে দেশের সেরা চিকিৎসকদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরা হলো:

★প্রফেসর ডা. ফিরোজ আহমেদ কোরাইশী
সভাপতি, সোসাইটি অব নিউরোলজিস্টস অব বাংলাদেশ।

-পারকিনসন্স একটা মস্তিষ্কজনিত রোগ। এটা মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র ও স্নায়ুকোষের অসুখ। এর ফলে মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ জায়গায় মস্তিষ্কের কোষগুলো আস্তে আস্তে মরে যেতে পারে। কোষ মরে গেলে কিছু রোগের সৃষ্টি হয়। এ রোগটাকেই পারকিনসন্স রোগ বলে। মস্তিষ্কের মধ্যে লাখ লাখ কোষ আছে। এই কোষগুলো একে অন্যের মধ্যে সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য কিছু রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে। এই সংবাদ আদান-প্রদানের মধ্যে কিছু রাসায়নিক প্রক্রিয়া আছে। নানাবিধ কারণে তা কমে গেলে যে রোগের সৃষ্টি, তা–ই পারকিনসন্স রোগ। এ রোগ থেকে দূরে থাকতে হলে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রয়োজন সবার সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

★প্রফেসর ডা. আবু নাসার রিজভী

মহাসচিব, সোসাইটি অব নিউরোলজিস্টস অব বাংলাদেশ।
চেয়ারম্যান, নিউরোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ।

-এ রোগ ব্রেন সেল শুকিয়ে যাওয়ার কারণে হয়। এটি এমন একটি রোগ, যা সম্পূর্ণ সেরে যাওয়ার নয়। ওষুধ দিয়ে কমিয়ে রাখা যায়। চিকিৎসার দুটি পার্ট আছে। যেমন ফার্মাকোলজি ও নন–ফার্মাকোলজি পার্ট। ফার্মাকোলজি পার্টে অনেক ওষুধ আছে। শুরুতেই যদি রোগ নির্ণয় করে এর চিকিৎসা করা যায়, তাহলে রোগী অনেক দিন ভালো থাকতে পারেন। বিশ্ব পারকিনসন দিবসের উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণ জনগণকে এ রোগ সম্পর্কে সচেতন করা। রোগ সম্পর্কে জেনে যদি তাঁরা শুরুতেই ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নেন, তাহলে তাঁরা দীর্ঘদিন সুস্থ থাকবেন। এ রোগে প্রথমে রোগীদের ওষুধে চিকিৎসা দেওয়া হয়। রোগীর অবস্থা যদি খুব খারাপ হয়, তখন অপারেশন করানো হয়। নন–ফার্মাকোলজি পার্ট–এ আমরা অর্ধেক ফিজিওথেরাপি দিয়ে থাকি। এ রোগের ক্ষেত্রে থেরাপি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এ রোগে আক্রান্ত রোগীরা প্রাথমিকভাবে খুব অলস হয়ে থাকেন। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে চান না। নড়াচড়া করতে চান না। সারাক্ষণ ঝিমাতে চান, রেস্ট নিতে চান। এ রোগীরা যত অ্যাকটিভ থাকবেন, তত সুস্থ থাকবেন। এ বিষয়ে তাঁদের মোটিভেট করতে হবে। রোগীকে মস্তিষ্কের কাজ বাড়াতে হবে। অলস হওয়া যাবে না। অলস হলে এই রোগ আরও বৃদ্ধি পাবে। বিদেশে এ ধরনের রোগীদের পাজেল খেলতে দেওয়া হয়। ওষুধে যতটুটু কাজ হয়, থেরাপিতে ঠিক সমপরিমাণ কাজ হয়। রোগীদের উচিত নিয়মিত সাঁতার কাটা ও নাচ করা। এগুলো ফিজিওথেরাপিতে খুব ভালো কাজে দেয়। সর্বশেষ পরামর্শ হবে সার্জিক্যাল চিকিৎসা দেওয়া। সম্প্রতি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসর বঙ্গবন্ধু মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়েছেন, যার অধীনে আমরা একটি টিম কাজ করছি। আমাদের দেশে নিউরোসার্জারির কতগুলো কাজ সফলভাবে সম্পূর্ণ করেছি। ভবিষ্যতে আমাদের দেশের নিউরোলজিস্টরাই এককভাবে কাজগুলো করতে পারবেন বলে বিশ্বাস করি। সে ক্ষেত্রে আমাদের পারকিনসন রোগীরা অনেক উপকৃত হবেন। পারকিনসন্স রোগ প্রতিরোধে পরিবারের সাপোর্ট একটা বড় বিষয়। রোগী, চিকিৎসক ও পরিবার—এই তিন পক্ষ যদি সচেতন হয়ে একসঙ্গে সাপোর্ট দিতে পারে, তাহলে রোগী দীর্ঘদিন ভালো থাকতে পারবেন।

★প্রফেসর ডা. হাসান জাহিদুর রহমান
আহ্বায়ক, মুভমেন্ট ডিজঅর্ডার সোসাইটি অব বাংলাদেশ।

পৃথিবীজুড়েই মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন। তবে ৬০ বছর বা তদূর্ধ্ব মানুষের এই রোগ দেখা দেয়। এর কম বয়সীদের যে হবে না, তা বলা যাবে না। সাধারণত ষােটার্ধ্ব মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। এ রোগের হার নির্দিষ্ট করে আমরা বলতে পারি না কারণ, আমাদের দেশে এ নিয়ে তেমন সমীক্ষা হয়নি। তবে আমাদের কাছাকাছি দেশগুলো যেমন ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড প্রভৃতি জায়গায় দুটি হার দেখতে পাই। একটি হার হচ্ছে প্রতিবছর এক লাখ লোকের মধ্যে কতজন এই অসুখে আক্রান্ত হন। আরেকটা হচ্ছে এই রোগে কতজন ভুগছেন। অসুখটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে রোগীদের যে উপসর্গ থাকে, তা কমানো সম্ভব। পৃথিবীজুড়ে ১২০ জন প্রতি লাখে এ রোগে আক্রান্ত হন। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রতিবছর পৃথিবীতে প্রতি লাখে ৮ থেকে ২১ শতাংশ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হন। বাংলাদেশ এর বাইরে নেই। ভারতের পশ্চিমে রোগটা বেশি, পূর্ব দিকে কম। আমরা যদি পশ্চিমবঙ্গকে ধরি, সেখানে দেখা যায় সাধারণত প্রতি লাখে প্রতিবছরে ৮ থেকে ১০ শতাংশ আক্রান্ত হন। বাংলাদেশের হারটাও এর কাছাকাছি। যদিও বাংলাদেশে এখনো আমরা এ রকম গবেষণা চালাতে পারিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ষাটোর্ধ্ব মানুেষর মধ্যে ১ শতাংশ পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশে ২০৩০ সালের পর এর ব্যাপকতা অনেক বেশি হতে পারে। বাংলাদেশ ও এশিয়ার দেশগুলোতে ১০০ জনে শূন্য দশমিক ৩ জন আক্রান্ত। রোগটা ছোঁয়াচে নয়। ১৫ থেকে ২০ ভাগ ক্ষেত্রে এটা বংশগত রোগ। আমাদের ক্রোমোসোমের মধ্যে যে জিন আছে, তার মধ্যে বিশেষ কিছু জিন একজন থেকে আরেকজনে ছড়াতে পারে। বাবার এ রোগ থাকলে ছেলের হতে পারে।

★ডা. আহসান হাবীব হেলাল
সদস্যসচিব, মুভমেন্ট ডিজঅর্ডার সোসাইটি অব বাংলাদেশ।

ডিবিএস সার্জারি হচ্ছে পারকিনসন্স রোগের আধুনিক চিকিৎসা। ডিবিএসের পূর্ণ রূপ হচ্ছে ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন। এটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটি সার্জারি। যেটি বাংলাদেশে শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে চারটি কেস আমরা করেছি। এই চারটি সার্জারি করেছেন প্রফেসর ডা. টিপু আজিজ। এর বাইরে আরও দুটি পদ্ধতি আছে। প্রান্তিক পর্যায়ে রোগী যখন শয্যাশায়ী হয়ে যান, অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না, ওষুধ ঠিকভাবে খেতে পারেন না, তখন তাঁদের চামড়ার নিচে এপোমর্ফিন ইনজেকশন দেওয়া হয়। এটি অনেকটা ইনসুলিনের মতো। এফোমর্ফিনটা ডোফামর্ফিনের মতো কাজ করে। এপোমর্ফিন দিলে রোগীর ব্রেনে ডোপামিনের পরিমাণ বেড়ে যায়, রোগীর কম্পন কমে যায়, চলাফেরার গতি বেড়ে যায়। কিন্তু এই ইনজেকশন অনেক দামি। এটা ভারতে সহজসাধ্য। আমরাও চেষ্টা করছি বাংলাদেশে আনার। আবার যখন রোগী মুখে খেতে পারেন না, তখন পেটে একটি ছোট অপারেশন করে নল লাগিয়ে দেওয়া হয়। এই নলের মাধ্যমে লিভোডোপা জেল আকারে পেটের মধ্যে সরাসরি দেওয়া হয়। এটি খুবই ব্যয়বহুল। এ ধরনের চিকিৎসা পৃথিবীর উন্নত দেশে দেওয়া হয়।

রোগীদের ক্ষেত্রে উপদেশ হচ্ছে, এ রোগের চিকিৎসা নেওয়া শুরু করলে বন্ধ করা যাবে না। চিকিৎসার পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি চালিয়ে যেতে হবে।

★প্রফেসর ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী
ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস।

এটা মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত রোগ। ব্রেনের কতগুলো অংশ আছে যেমন সাবস্টেনশিয়া নায়াগ্রা, ব্যাসাল গ্যাংলিয়া। এই রোগের ক্ষেত্রে কিছু কিছু কেমিক্যাল যেমন ডোপামিন, এসিট্যালকুলিন যদি কমে যায়, তখন এই রোগ বেশি পরিলক্ষিত হয়। বয়স যখন ৬০–৬৫–এর বেশি হয়, তখন দেখা দেয়। এই রোগের ফলে যখন নিউরোট্রান্সমিটার, এসিট্যালকুলিন অথবা ডোপামিন কমে যায়, তখন হাত–পা কাঁপা শুরু হয়। এ রকম হলে রোগী দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। হাতের মাংস, পায়ের মাংস শক্ত হয়ে যায়। ডোপামিন কমের কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। মানসিক পরিবর্তন হয়। উত্তেজনা বেড়ে যায়। অবসাদ দেখা দেয়। এ রোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের সচেতন হতে হবে। নিয়মিত হাঁটাচলা করতে হবে, ব্যায়াম করতে হবে। রোগের শুরুতেই চিকিৎসা নিতে হবে।

বিশ্ব পারকিনসন্স দিবস উপলক্ষে ১৫, ১৬ তারিখের দিকে চারজন রোগীকে ফ্রি ডিবিএস চিকিৎসা দেওয়া হবে। যে চিকিৎসা করতে বিদেশে ১৯–২০ লাখ টাকা লাগে।

এছাড়াও আলাপনে যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক ডাঃ হারাধন দেবনাথ ও ডাঃ আহসান হাবীব প্রমুখ।

গ্রন্থনা: সাইদুল হাসান ও জ.ই বুলবুল।

Print Friendly

Related Posts