মুল্লুক চল দিবসকে ‘জাতীয় চা শ্রমিক দিবস’ ঘোষণার দাবী

দেউন্দি বাগানে প্রতীকের সভায় বক্তারা

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি: ২০ মে ঐতিহাসিক মুল্লুক চল দিবস। ১৯২১ সালের এই দিনে ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হতে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩৫ হাজার চা-শ্রমিক নিজেদের জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। এ সময় চাঁদপুরের মেঘনাঘাটে ব্রিটিশ সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হাজার হাজার চা শ্রমিককে হত্যা করে। এরপর থেকে ২০ মে চা-শ্রমিকেরা ‘মুল্লুক চল দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন। তবে বারবার দাবি জানানো এবং অনেক আন্দোলনের পর ১০১ বছরেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি দিবসটি। ঘুচেনি চা শ্রমিকদের বঞ্চনা।

শুক্রবার (২০ মে) বিকেলে জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দেউন্দি চা বাগানে প্রতীক থিয়েটারের আয়োজনে দিবসটি উপলক্ষে প্রথমে শোকর‌্যালি বের হয়ে বাগান প্রদক্ষিণ করে নিহতদের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্যে ফুলের শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে প্রতীক মঞ্চে আলোচনা সভা ও চা শ্রমিকের গান, নৃত্য, নাটক অনুষ্ঠিত হয়। দুইদিন ব্যাপী এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি নাছির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু।

বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের হেমাঙ্গ বিশ্বাস হবিগঞ্জ অঞ্চলের সমন্বয়কারী প্রতীক থিয়েটারের সভাপতি সুনীল বিশ্বাসের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ বুনার্জীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন গ্রাম থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমানসহ বিভিন্ন চা-বাগানের নেতৃবৃন্দ। অনুষ্ঠানে চা শ্রমিকের গানের মাধ্যমে মুল্লুকের মর্মগাথা ও চা শ্রমিকের জীবন চমৎকারভাবে তোলে ধরেন প্রতীকের শিল্পীবৃন্দ। এতে দেউন্দি, গেলানীয়া, রঘুনন্দন, কাপাই ও লস্করপুরসহ বিভিন্ন চা বাগানের চা শ্রমিকবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।

সভায় বক্তারা এ দিবসটিকে জাতীয় চা শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য সরকারের প্রতি জোরালো দাবী জানান। সেই সাথে ‘মুল্লুক ভাস্কর্য’ নির্মাণ করায় প্রতীক থিয়েটারের সহ-সভাপতি আমোদ মালের প্রশংসা করেন।

বক্তারা বলেন, প্রতীক থিয়েটারের এ আয়োজন চা শ্রমিকদের সম্মানীত করেছে। এ থিয়েটার সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে চা শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়নে কাজ করছে।

প্রতীক থিয়েটার সভাপতি সুনীল বিশ্বাস জানান, চা শ্রমিকদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে এদেশে এনে স্বল্প মজুরির মাধ্যমে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ করানো হয়। তাই শ্রমিকরা নিজ মুল্লুকে ফিরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা সফল হয়নি। এখনও চা শ্রমিকরা বঞ্চিত আছে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে চীন ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও চায়ের প্রচলন ছিল না। ১৮৫৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেটের মালিনীছড়া চা বাগানে চা চাষ শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে সময় বৃহত্তর সিলেটে চা বাগান তৈরির জন্য ভারতের আসাম, উড়িষ্যা, বিহার, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয়। ‘গাছ হিলেগা, রুপিয়া মিলেগা’ এমন প্রলোভনে শ্রমিকরা বাংলাদেশে এলেও তাদের ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। বিশাল পাহাড় পরিস্কার করে চা বাগান করতে গিয়ে হিংস্র পশুর কবলে পড়ে কত শ্রমিকের জীবন গেছে তার কোনো হিসাব নেই। এছাড়া ব্রিটিশদের অত্যাচার তো ছিলই। তাদের অব্যাহত নির্যাতনের প্রতিবাদে তৎকালীন চা শ্রমিক নেতা পন্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পন্ডিত দেওসরন ‘মুল্লুকে চল’ (দেশে চল) আন্দোলনের ডাক দেন। ১৯২১ সালের ২০ মে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩৫ হাজার চা শ্রমিক সিলেট থেকে হেঁটে চাঁদপুর মেঘনা স্টিমার ঘাটে পৌঁছেন। জাহাজে চড়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইলে মেঘনা ঘাটে গোর্খা সৈনিকরা নির্মমভাবে চা শ্রমিকদের হত্যা করে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এর পর যারা বেঁচে ছিলেন তারা নিরুপায় হয়ে আবারও বাগানে চলে আসেন। তবে চা শ্রমিকরা যাতে ট্রেনে না চলতে পারেন তার জন্য সহজ-সরল শ্রমিকদের বাগানের নামাঙ্কিত একটি করে ট্যাগ দেওয়া হয়। সেই ট্যাগ দেখলেই শ্রমিকদেরকে নামিয়ে দেওয়া হতো।

চা শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে চা-শ্রমিকরা তীর-ধনুক নিয়ে যুদ্ধ করে। কিন্তু দেশে এখনও চা শ্রমিকরা ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত। চা শ্রমিকদের জীবনমানের তেমন উন্নয়ন ঘটেনি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য চাহিদা এখনও পূরণ হয়নি।

তিনি জানান, অবিলম্বে চা শ্রমিকদের চুক্তি নবায়ন, দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা, রেশন হিসাবে সাপ্তাহিক ৫ কেজি চালসহ ৭ দফা দাবি মানতে হবে। তিনি ২০ মে রাষ্ট্রীয়ভাবে চা শ্রমিক দিবস ঘোষণা এবং ওই দিন সবেতনে ছুটি বাস্তবায়নেরও দাবি জানান। পাশাপাশি চা শ্রমিকদের চাকরি ক্ষেত্রে কোটারও দাবি করেছেন। সন্ধ্যায় প্রতীক মঞ্চে নিজভূমে পরবাসী নাটক অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে শত শত চা শ্রমিক অংশগ্রহণ করেন।

মামুন/এইচ

Print Friendly

Related Posts