মা প্রিয়া অফিস থেকে ফিরবেন, অপেক্ষায় সন্তান মাহিম

রফিক সরকার: গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের মাইজপাড়া কমলাদিঘী এলাকায় রেল ক্রসিংয়ে রোববারের (২৪ জুলাই) বাস দুর্ঘটনায় নিহত ৫ জনের একজন শ্রীপুর উপজেলার বালিয়াপাড়া গ্রামের শুভ হাসানের স্ত্রী রহিমা খাতুন প্রিয়া।

নিহত প্রিয়ার রয়েছে নূর মাহিম নামে সাড়ে চার বছর বয়সী এক শিশু সন্তান। মা মারা গেছেন, সে আর ফিরে আসবে না- এই বোধ এখনও জন্মেনি শিশু মাহিমের। তার মা অফিসে গেছে, সে ফিরে আসবে। কখনও আবার বলছে, আমার মা মাটির নিচে ঘুমাচ্ছে, রাতে আসবে। এ ধরনের কথা বলে চলেছে শিশু মাহিম।

নিহত প্রিয়ার স্বামী শুভ হাসান জানান, আট বছর আগে প্রিয়াকে তার মামা বাড়ি নারায়ণগঞ্জ থেকে ভালবেসে বিয়ে করেন। প্রিয়ার পরিবারের কেউ জানতেন না তিনি শুভকে বিয়ে করছেন। বিয়ের খবর শোনার পর এই আট বছরে তার স্বজনেরা কেউ তাকে একদিনও দেখতে আসেনি। বিয়ের পর আমার বাবা-মাকেই নিজের বাবা-মায়ের মতো আপন করে নিয়েছিলেন প্রিয়া। দুর্ঘটনায় প্রিয়ার মৃত্যুর খবর শুনে প্রিয়ার মা রোববারই তাদের বাড়িতে প্রথম আসেন বলে জানান শুভ।

শুভ আরো বলেন, আমার ছেলেটার একটা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে প্রিয়া চাকরি নিয়েছিলো। কিন্তু ছেলেটার ভবিষ্যতের আগেই চলে গেল সে। সংসারটা চালাতো প্রিয়া নিজে। আমার চাকরি ছিলো না বলে প্রিয়া চাকরিতে যোগ দেয়। চাকরিতে গিয়ে সে ফিরে আসবে না এমন জানলে তাকে চাকরি করতে দিতাম না।

তিনি জানান, গত তিন মাস আগে অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হন তিনি। তবে স্ত্রী প্রিয়ার সঙ্গে প্রতিদিন বেশ কয়েকবার মুঠোফোন, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কলে কথা হতো। শনিবার (২৩ জুলাই) রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রিয়ার সঙ্গে তার শেষ কথা হয়। মান-অভিমানের নানা কথার ফাঁকে যে কথাটি বলে প্রিয়া ফোন রেখে দিয়েছিলো, তা এখন আমাকে বেদনা দেয়। কথা প্রসঙ্গে সে আমাকে বলেছিলো, তুমি যেদিন আসবে সেদিন আমাকে খুঁজে পাবে না। সত্যিই আমি কুমিল্লা থেকে এসে তাকে আর পাইনি।

প্রিয়ার শাশুড়ি শামসুন্নাহার বলেন, বউ হিসেবে প্রিয়া অনেক ভাল ছিলো। শ্বশুর-শাশুড়িসহ সকলের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতো। মারা যাওয়ার আগের রাতে আমাকে শেষ কথা বলে গিয়েছিল, মা আমার ছেলেটারে দেখে রাইখেন। আমি ঘুমাইতে যাই। সকালে সে কারখানায় যাওয়ার সময় আমি ঘুমিয়েছিলাম।

প্রিয়ার শ্বশুর নুরুল ইসলাম বলেন, সে আমার ছেলের বউ না, মেয়ে বললেই চলে। সে যা করে গেছে তা ভোলার মতো না। সে কারখানায় গেলে আমাকে বলে যেতো, আব্বা আমি যাইতেছি। কিন্তু আমি একটু অসুস্থ থাকায় সেদিন ফজরের নামাজের পর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাই আমাকে আর ডাকেনি। সে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর শুনি ট্রেনের সঙ্গে বাসের দুর্ঘটনা ঘটেছে। খবর নিয়ে গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখি সবাইকে নিয়ে গেছে। আমার প্রিয়া পড়ে আছে। সেখান থেকে তার মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসি।

প্রিয়ার প্রতিবেশী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, মেয়েটি অনেক ভাল ছিলো। আমাদের বাড়িতে আসতো, আড্ডা দিতো। অফিস ছুটি থাকলে আমাদের বাড়িতে এসে গল্প-সল্প করতো। অনেক ভাল ব্যবহার ছিলো। তার মৃত্যুতে আমরা এলাকাবাসী শোকাহত। তার মতো এমন ভাল মেয়ে ও বউ এ যুগে পাওয়া যায় না।

শ্বশুর বাড়ির সামাজিক মসজিদের পাশেই প্রিয়ার কবর দেওয়া হয়েছে। রোববার (২৪ জুলাই) রাতে বালিয়াপাড়ার ওই মসজিদের সামনেই তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

চলন্ত ট্রেনের ধাক্কায় এ দুর্ঘটনায় ৫ জন নিহত হয়। আহত হন আরও ২০ জন। এ দুর্ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা ও ময়মনসিংহের পাঁচজন কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সোমবার (২৫ জুলাই) ওই কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।এছাড়াও ঘটনার পর পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন গাজীপুর জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান।এরই মধো রেলক্রসিংয়ের দায়িত্বে থাকা গেটম্যান আল আমীনকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে বরখাস্ত করেছে রেল কর্তৃপক্ষ।

Print Friendly

Related Posts