ফুটবল বিজয়িদের রাজসিক বরণ

ইতিহাস গড়ে সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হয় সাবিনারা।দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে এমন বিরল সংবর্ধনা আর কেউ পায়নি। নারী সাফের চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ ফুটবল দলের দেশে ফেরাকে কেন্দ্র করে গোটা দেশ থমকে গিয়েছিল। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্য আগেও এসেছিল। মানুষকে আনন্দ দিয়েছিল। কিন্তু এমন আবেগে ভাসেনি কেউ। নারী ফুটবলাররা সাফে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে পেলেন রাজসিক সংবর্ধনা

দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে রাজধানীর হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে বিমানের নিয়মিত ফ্লাইটটি। ভিআইপি গেট দিয়ে খেলোয়াড়দের নিয়ে আসা হয় লাউঞ্জে। দেশের মাটিতে পা রেখেই মিডফিল্ডার মারিয়া মান্দা সামাজিক যোগযোগমাধ্যম ফেসবুকে লেখেন, ‘হ্যালো বাংলাদেশ! প্রিয় জন্মভূমিতে।’ ফাইনালে জোড়া গোল করা কৃষ্ণা রানী সরকার ফেসবুক পেজে লেখেন, ‘বাংলার বাতাস গায়ে লেগেছে অনেকদিন পর।’ ফুল দিয়ে এবং মিষ্টিমুখ করিয়ে সাবিনা খাতুন, সানজিদা আক্তার-কৃষ্ণা রানীদের বরণ করে নেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। ফুটবলারদের গলায় মালা ও উত্তরীয় পরিয়ে স্বাগত জানানো হয়। এ সময় যুব ও ক্রীড়া সচিব মেজবাহ উদ্দিনসহ বাফুফে ও ক্রীড়া মন্ত্রাণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিতি ছিলেন। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনসহ অনেক সংস্থা ও ব্যক্তি সাবিনাদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানান এ সময়।

সাবিনারা যখন বিমানবন্দরে পা রাখেন তার কিছুক্ষণ আগেই পবিত্র ওমরাহ শেষে দেশে ফিরেছিলেন জাতীয় ক্রিকেট দলের তারকা পেসার তাসকিন আহমেদ। তাসকিন সাফজয়ী নারী ফুটবল দলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘এটা খুবই ভালো একটা অর্জন আমাদের জন্য। আমি খুশি, সবাই খুশি।’

বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে অধিনায়ক সাবিনা তাৎক্ষণিকভাবে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই ট্রফি ১৮ কোটি মানুষের। সকলকে ধন্যবাদ আমাদের এত সুন্দরভাবে বরণ করে নেওয়ার জন্য। আমরা কৃতজ্ঞ। যদি চার-পাঁচ বছরের পরিশ্রম দেখেন তাহলে দেখবেন সেটার ফল এখন হাতে আছে।’

ফুটবলারদের নিরাপত্তার জন্য বিমানবন্দরে সকাল থেকেই মোতায়েন ছিল আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন। বিমানবন্দরের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে খেলোয়াড়রা বেলা সাড়ে ৩টায় রওয়ানা হন বাফুফের উদ্দেশে। পরে ছাদখোলা বাসে শিরোপাজয়ী ফুটবলারদের নিয়ে গাড়িবহর রওয়ানা হয় বাফুফে ভবনের উদ্দেশে। সাবিনাদের ‘চ্যাম্পিয়ন’ বাসে উঠেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এমপিসহ অন্যরা।

বহরের আগে-পরে ছিল নিরাপত্তা বাহিনী, মিডিয়ার গাড়ি ও অনেক উৎসাহী ফুটবলপ্রেমী। রাস্তার দুধারে হাজারও মানুষ। কেউ গাড়িতে, কেউ দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন। বিমানবন্দর থেকে বাফুফে ভবন পর্যন্ত পুরো পথে এই চিত্র দেখা গেছে। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অভাবনীয় এ দৃশ্য উপভোগে প্রতিটি সড়কেই মানুষের জটলা। অনেকে ভিডিও ধারণ করছেন। অনেকে সেলফি তুলছেন। ফুটওভার ব্রিজগুলোতে দাঁড়িয়ে অভিবাদন দিচ্ছেন পথচলতি মানুষ। বাসের ছাদে দাঁড়িয়ে সাবিনা-কৃষ্ণারা আনন্দে নেচে-গেয়ে জাতীয় পতাকা নাড়িয়ে রাস্তার দুপাশে দাঁড়ানো হাজারও মানুষের ভালোবাসার প্রত্যুত্তর দিয়েছেন। বিমানবন্দর থেকে কাকলী হয়ে মহাখালী ফ্লাইওভার ব্যবহার করে জাহাঙ্গীর গেট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পর বিজয় সরণিতে এসে তেজগাঁও হয়ে পুনরায় ফ্লাইওভার দিয়ে মৌচাক হয়ে কাকরাইলে পৌঁছায় চ্যাম্পিয়ন বহর। কাকরাইল থেকে ফকিরাপুল, আরামবাগ এবং মতিঝিল শাপলা চত্বর হয়ে বাফুফে ভবনে যান চ্যাম্পিয়নরা।

আনন্দের দিনটা হঠাৎ করেই মলিন হয়ে যায় বাংলাদেশ দলের। বাস যখন বনানী ফ্লাইওভারে উঠে তখন হঠাৎ বিলবোর্ডে লেগে আহত হন ঋতুপর্ণা চাকমা। বাস থামিয়ে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে সিএমএইচে নেয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে তিনটি সেলাই দেয়া হয় মাথায়। চিকিৎসা শেষে তাকে বাফুফে ভবনে নিয়ে আসা হয়।

সাবিনাদের বরণ করতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী। তাদের সবার হাতেই রয়েছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। আনন্দ-উল্লাসে স্বর্ণকন্যাদের বরণ করেছেন। চ্যাম্পিয়ন দলের পাঁচ ফুটবলার গোলকিপার ইতি রানি ও সাথী বিশ্বাস, ডিফেন্ডার আঁখি খাতুন এবং ফরোয়ার্ড সিরাত জাহান স্বপ্না ও ঋতুপর্ণা চাকমা শিক্ষার্থী। আনন্দে উদ্বেলিত বিকেএসপির ছাত্রী শিলা আক্তার বলেন, ‘আমাদের সিনিয়ররা দেশের বড় সাফল্য এনে দিয়েছেন। তাদের এই জয়ে আমরা গর্বিত। আমরা সবাই মিলে এখানে এসেছি আপুদের বরণ করে নিতে।’ বিকেএসপির কোচ জয়া চাকমা উচ্ছ্বসিত। তার কথা, ‘এটা আমার জন্য দারুণ অনুভূতি। খেলোয়াড়রা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আমি এই টুর্নামেন্টে রেফারি ছিলাম।’

ইতিহাস গড়ে দেশে ফিরেই পুরস্কারের ঘোষণায় ভাসছেন নারী দলের ফুটবলাররা। চ্যাম্পিয়ন দলের জন্য ৫০ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, বাংলাদেশের ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদীর স্ত্রী ও এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান শারমিন সালাম এবং তমা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বাফুফের সিনিয়র সহসভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক।

বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান বলেন, ‘অসাধারণ পারফরম্যান্স ও ঐতিহাসিক অর্জনের মাধ্যমে গোটা দেশকে আনন্দে ভাসিয়েছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। তাদের প্রতি সমর্থন ও স্বীকৃতি হিসাবে আমি বিসিবির পক্ষ থেকে পুরো দলের জন্য ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করছি। মেয়েদের এই সাফল্য অন্য খেলার খেলোয়াড়দেরও অনুপ্রাণিত করবে।’

আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘মেয়েদের আরও উৎসাহিত করতে তাদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আমার স্ত্রী শারমিন সালাম ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। এনভয় গ্রুপ সব সময় দেশের ও জনগণের পাশে থাকে।’

Print Friendly

Related Posts