কাঞ্চন কুমার: কুষ্টিয়ার বৃষ্টি খাতুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এবং তার চাকরিক্ষেত্রে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে পরিচিত ছিলেন। তবে তার জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং চাকরির জীবন বৃত্তান্তে নামের ক্ষেত্রে কোনোটিতে বৃষ্টি খাতুন আবার কোনোটিতে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী দেওয়া আছে। তার পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা থাকায় মৃত সাংবাদিক অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। তবে তার ডিএনএ পরীক্ষা করে লাশ হস্তান্তর করা হবে।
বার্ন ইনস্টিটিউটে দায়িত্বরত রমনা থানার এসআই হাবিবুর রহমান বলেন, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। লাশ এবং বাবা পরিচয়দানকারী শাবলুর আলম সবুজ ও মা বিউটি বেগমের ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে ডিএনএ না মিললে এবং অভিশ্রুতি পালিত সন্তান হয়ে থাকলে, তার দাফন বা সৎকারের বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত হবে? এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই হাবিবুর বলেন, তিনি যে পরিবারে বেড়ে উঠেছেন, আমার ধারণা আদালত সেই পরিবারের কাছেই হস্তান্তর করবেন।
এদিকে কুষ্টিয়ার খোকসার বনগ্রামে গুজব উঠেছিলো, অভিশ্রুতির লাশ গ্রামে এলে জানাজা পড়ানো যাবে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ মোতায়েন করেছে খোকসা থানা। তবে স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন জানিয়েছে, সবুজ মেয়ের লাশ নিয়ে ফিরলে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী জানাজা পড়ানো ও দাফন সম্পন্ন করা হবে।
ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম মুঠোফোনে বলেন, নিহত সাংবাদিকের নাম বৃষ্টি খাতুন। তার বাবার নাম সবুজ শেখ, মায়ের নাম বিউটি বেগম। কুষ্টিয়ার খোকসার বনগ্রামে তার বাড়ি।
অধ্যক্ষ আরো জানান, ২০১৭-১৮ সেশনে বৃষ্টি ইডেন কলেজের দর্শন বিভাগে ভর্তি হয়। দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা অংশ নেয়। এরপর বৃষ্টি তৃতীয় বর্ষের ফরম পূরণ করে। কিন্তু আর পরীক্ষা দেয়নি। ইডেনের রাজিয়া বেগম হোস্টেলের আবাসিক ছাত্রী ছিল। সে দুই বছর পর হল ছেড়ে দেয়।
অন্যদিকে রমনা কালীমন্দির কমিটির সভাপতি উৎপল সাহা বলেন, নিয়মিত মন্দিরে এসে হিন্দু ধর্মচর্চা ও পূজা-অর্চনা করতেন ওই নারী সাংবাদিক। তিনি বলেন, অভিশ্রুতি শাস্ত্রী হিসাবে, ব্রাহ্মণ মেয়ে হিসাবে সে এখানে পরিচয় দিতো। ধর্মীয় কৃষ্টি কালচারগুলো আমাদের সাথে পালন করেছে। আমরা চাই, এ বিষয়টির একটা সমাধানের জায়গায় আসুক তার পিতৃপরিচয়।
তিনি বলেন, আমার কথা হচ্ছে সে যে ধর্মেরই হোক, সে হিন্দু ধর্মের সেটা আমি বলতে চাচ্ছি না, বা মুসলিম ধর্মের, সেটিও পরীক্ষার বিষয় আছে, তদন্তের বিষয় আছে। সেই তদন্ত হোক।
তিনি আরও বলেন, যদি সে হিন্দু হয়ে থাকে, তবে তাকে সেই কালচারেই আমরা আমাদের যে মন্দির, আমাদের সাথে যেহেতু কানেকশন ছিলো তার এবং পূজা-অর্চনা করতো। সে হিসাবে আমাদের এই প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মকানুন বজায় রেখে, আমাদের হিন্দুধর্মীয় মতে শেষকৃত্যটা করতে চাই।
কাগজপত্রে গরমিল অভিশ্রুতি বা বৃষ্টির জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, ইডেন কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার প্রবেশপত্র এবং চাকরির জন্মবৃত্তান্তে বাবা-মায়ের নামে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া গেছে। তবে স্থায়ী ঠিকানা সব জায়গায় একই। ২০২১ সালের ৬ জুলাই ইস্যু করা জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম বৃষ্টি খাতুন হিসাবেই রয়েছে। সেখানে পিতার নাম সবুজ শেখ এবং মাতার নাম বিউটি বেগম। কলেজের প্রবেশপত্রেও তার একই রকম তথ্য আছে। ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর ইস্যু করা জন্ম নিবন্ধন সনদে আছে নাম অভিশ্রুতি লেখা হলেও বাবার নাম লেখা হয়েছে মো, শাবলুর আলম এবং মায়ের নাম বিউটি বেগম।
অন্যদিকে চাকরির জন্মবৃত্তান্তে নিজের নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী লিখেছেন তিনি। তবে বাবার নাম লেখা হয়েছে শাবলুর আলম এবং মায়ের নাম অপর্ণা শাস্ত্রী। জন্ম নিবন্ধন সনদ এবং জন্মবৃত্তান্তে জন্ম তারিখ ২০০০ সালের ২৫ ডিসেম্বর রয়েছে। তবে জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্ম তারিখ ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯৮।
অভিশ্রুতির সাবেক কর্মস্থল দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের চিফ রিপোর্টার গোলাম রাব্বানী গণমাধ্যমকে বলেন, চাকরির বায়োডাটায় তার নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী। সবুজ শেখই অভিশ্রুতির বাবা এবং বিউটি বেগমই তার মা।
তিনি বলেন, অভিশ্রুতি হিন্দু ধর্মচর্চা করতেন বলেই আমরা দেখেছি। নিয়মিত পূজা-অর্চনা করতে মন্দিরে যেতেন। জন্ম নিবন্ধনে তিনি নাম পরিবর্তনও করেছেন। ধর্ম পরিবর্তনের চেষ্টায় থাকতে পারেন হয়তো।
অভিশ্রুতির বাবা বলেন, আমরা মুসলমান। এক সপ্তাহ আগে বলেছি, বাবা বাড়ি যাবা? বলেছে, না একেবারে ঈদে বাড়ি যাবো।
সবশেষ কয়দিন আগে কথা হয়েছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তিন থেকে চারদিন হতে পারে। চারদিন মনে হয়। জুমার নামাজের পর অভিশ্রুতির এক বান্ধবীর ফোনে তার মৃত্যুর খবর জানার কথা বলেন শাবলুর আলম সবুজ। নাম পরিবর্তন বা ধর্ম পরিবর্তন করেছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, না, ধর্ম পরিবর্তনের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো হদিস নাই। ধর্ম পরিবর্তন করছে, নাম পরিবর্তন করছে আমরা জানি না।
এক প্রশ্নে সবুজ বলেন, এক বছর আগে আমি একবার শুনেছি, মন্দিরে গেছে। একজন মন্দিরে যাওয়ার ছবি দেখিয়েছে। তখন আমাকে জানাইছে।
তিনি বলেন, হিন্দু বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে চলাফেরা করে, একটা অনুষ্ঠানে দাওয়াত করেছে, তাদের সঙ্গে গেছে। এটার সত্য-মিথ্যা জানি না।
মেয়ের সঙ্গে দূরত্ব ছিল কিনা এ প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার মেয়ের সঙ্গে আমার কোনো দ্বন্দ্ব নাই, হিংসা নাই। মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে, টাকা পয়সা লাগলে নিতো। অনেক সময় বাজারও নিয়ে আসতো।
ভারতের বেনারস থেকে অভিশ্রুতির ‘ঘটনাচক্রে’ বাংলাদেশে আসার কথা বলছেন রমনা কালীমন্দির কমিটির সভাপতি উৎপল সাহা। তিনি বলেন, আমাদের মন্দিরে এসে ধর্মীয় চর্চা বা পূজা অর্চনা, এই জিনিসগুলোর মাধ্যমে কিন্তু তার সাথে পরিচয়। তার পার্সোনাল বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সঙ্গে যতটুকু শেয়ার করেছে, সেটুকু বলি সেটা হচ্ছে তার ফ্যামিলি বেনারসে ছিলো এবং তার পিতৃপরিচয়, বেনারসে বাবা ও মা একটি মন্দিরে সেবায়েত হিসাবে ছিলো, সেই জায়গা থেকে আসছে। তিনি আরও বলেন, তার ফাদার-মাদার ওখানে মৃত্যু বরণ করার পরে, কোনো একটা ঘটনাচক্রে, সেটি আমাদের কাছে উন্মোচিত হয়নি বা সেটি বলেনি, ঘটনাচক্রে সে বাংলাদেশে কুষ্টিয়াতে এসেছে এবং এখানে পড়াশোনা সে মুসলিম ফ্যামিলিতে করেছে, এটুকু আমরা জানি। এটুকু আমরা শুনেছি তার কাছ থেকে।
অভিশ্রুতি অথবা বৃষ্টি খাতুন, কেন পরিচয় বদলেছিলেন তিনি?
অভিশ্রুতির ধর্ম পরিচয় নিয়ে আলোচনা চলছে ফেসবুকেও। নিজেকে অভিশ্রুতির ‘কাছের বন্ধু’ পরিচয় দেওয়া মাহফুজুর রহমান নামের একজন এক পোস্টে লিখেছেন, ধর্মপরিচয় নিয়ে প্রশ্নের সমাধানে প্রয়োজনীয় তথ্য রয়েছে তার কাছে। মাহফুজের ভাষ্য, ও যাদেরকে বাবা মা হিসাবে পরিচয় দিতো, তারা মুসলিম হলেও ও নিজে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী ছিলো। কারণ তার মতে কুষ্টিয়ার সবুজ শেখ ও তার স্ত্রী মূলত তার পালক পিতামাতা, ওকে ইন্ডিয়ার কোনো একটা হিন্দু পরিবার থেকে দত্তক নেওয়া হয়েছিলো।
মাহফুজ লিখেছেন, যদিও ওর মা দৃঢ়ভাবে দাবি করতেন ‘আমাদের পরিবারেই জন্ম নিয়েছে। ও অবশ্যই মুসলিম, ক্লাস এইট-নাইন পর্যন্ত নামাজ পড়তো। তারপর ওর বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে’। এই নিয়ে ওর পরিবারের সাথে ওর জটিলতা চলছিলো অনেক দিন ধরেই। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত কথা বলতে মাহফুজের ফেসবুকে দেওয়া ফোন নম্বরে কল করলেও তিনি ধরেননি। এসএমএস করলেও সাড়া দেননি।