কর্ণেল (অব:) অধ্যাপক ডা. জেহাদ খান
মরুভূমি বা শুষ্ক ভূখণ্ডের দিকে মে–জুন মাসে বয়ে যায় ‘লু হাওয়া’ নামে তাপপ্রবাহ। এ সময় সাধারণত ৪৫–৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে। বাতাসের আর্দ্রতাও থাকে কম। ভারত ও পাকিস্তানে একে বলে ‘লু লগনা’।
লু হাওয়ার কারণে ব্যাপকভাবে হিট স্ট্রোকের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশে লু হাওয়া শুরু না হলেও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা নিয়মিতই ৪০+ ডিগ্রি পার হচ্ছে। রোদে বেরোলেই গা জ্বালা করছে। ছায়ায় বসে থেকেও আরাম নেই, কারণ বাতাসও গরম। বারবার তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের এ সময় কষ্ট বেশি হয়। তাই আরো ৩ তিন সতর্কতা জরুরি মনে করা হয়েছে।
শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে তাকে হিট স্ট্রোক বলে। আমাদের মস্তিষ্কের তাপ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের নির্দেশে রক্তের মাধ্যমে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়। কোনও কারণে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ত্বকের রক্তনালি প্রসারিত হয়ে অতিরিক্ত তাপ পরিবেশে ছড়িয়ে দেয় এবং ঘামের মাধ্যমেও শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্র পরিবেশে বেশি সময় থাকা বা পরিশ্রম করলে শরীরের স্বাভাবিক তাপ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অকেজো হয়ে পরে। এতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বিপদসীমা ছাড়িয়ে যায় এবং হিট স্ট্রোক দেখা দেয়। হিট স্ট্রোক শেষ ধাপ হলেও হওয়ার আগে কিছু লক্ষন ফুটে ওঠে।
লক্ষণ দেখে বুঝবেন
হিট স্টোক হওয়ার আগে শরীরের মাংসপেশিতে ব্যথা হয়, শরীর দুর্বল লাগে, গা ঝিমঝিম ভাব হয় এবং প্রচণ্ড পিপাসা পায়। এর পরের ধাপে হিট দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, মাথা ব্যথা, ঝিমঝিম করা, বমিভাব, অসংলগ্ন আচরণ, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দেয়। এই দুই ক্ষেত্রেই কিন্তু শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ঠিক থাকে এবং শরীর খুব বেশি ঘামতে থাকে। এরকম হলে অবহেলা করে দ্রুত ব্যবস্থা নিলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানো যায়।
১.শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়।
২.ত্বক শুষ্ক ও লালচে হয়ে যায়। ঘাম বন্ধ হয়ে যেতে পারে
৩. রোগী খুব দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়
৪. নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়।
৫. রক্তচাপ কমে যায়।
৬. খিঁচুনি, মাথা ঝিমঝিম করা, অস্বাভাবিক আচরণ
৭. প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায় ও হলুদ রঙের হওয়া
৮. রোগী শকে চলে যেতে পারে। এমনকি পড়ে গিয়ে সাময়িক অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
কাদের হতে পারে
প্রচণ্ড গরমে ও আর্দ্রতায় যারা বেশি সময় ধরে গরমে কাজ করছেন যে-কারও হিট স্ট্রোক হতে পারে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যেমন— ১. শিশু ও বৃদ্ধদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা অনেক বেশি। ২. যারা দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদে কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। যেমন— কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক, দিনমজুর, কন্সট্রাকশন লেবার ইত্যাদি। ৩. শরীরে ডিহাইড্রেশন হলে অর্থাৎ পানি কম পান করলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে । যাদের শরীরে অত্যাধিক ঘামের মধ্যে পানি ও খনিজ বেরিয়ে যায়। ৪. কিছু কিছু ওষুধ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায় বিশেষ করে যারা ডাইইউরেটিক গ্রুপের ওষুধ খান তাদের শরীরে পানির ঘাটতি দেখা দেয়।
প্রতিকার
গরমে যেহেতু ঘামের মাধ্যমে পানির পরিমাণ কমে যাচ্ছে সেহেতু প্রচুর পরিমানে পানি খেয়ে শরীরকে হাইড্রেট করতে হবে। ইলেক্ট্রোলাইট ঘাটতি মেটাতে পনির সঙ্গে ও.আর.এস মিশিয়ে নিতে হবে। নাহলে ঘরোয়া পদ্ধতিতে ৪ টেবিল চামচ চিনি ও ১ চামচ লবন এক লিটার পানিতে মিশিয়ে ব্যাগে রাখুন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় এই পানি পান করতে থাকুন। পানির পাশাপাশি ফলের জুস (লেবু, বেল, তরমুজ) খেতে পারেন। কিডনি ও প্রেশারের রুগীরা চিকিৎসকের পরামর্শ মত পানি পান করুন। পোশাক পরুন ঢিলেঢালা, সুঁতির কাপড়ের ও হালকা রঙের। গরমে আঁটোসাটো পোষাক থেকে শরীরকে রেহাই দিন। ফুল স্লিভ জামা বা কাপড় ব্যবহার করুন যাতে শরীরের বেশিরভাগ অংশ ঢাকা থাকে। নরম কাপড়ের অন্তর্বাস অবশ্যই ব্যবহার করুন। যাতে দ্রুত ঘাম শুষে নিয়ে আপনার শরীরকে ঠাণ্ডা রাখবে। বাইরে বেরোলে অবশ্যই ছাতা, টুপি,সানগ্লাস ব্যবহার করুন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঠান্ডা পনি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিন। ওয়েট ওয়াইপ রাখতে পারেন সাথে। ত্বক অনুযায়ী সঠিক সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। যাদের ত্বক বেশি সেন্সিটিভ প্যারাবেন কিংবা অক্সিবেনজোন জাতীয় কেমিক্যাল যুক্ত সানস্ক্রিন এড়িয়ে চলুন। টাইটানিয়াম ডাইঅক্সাইড বা জিঙ্ক অক্সাইড জাতীয় উপাদান থাকা সানস্ক্রিন সেনসিটিভ ত্বকের জন্য উপকারী। সূর্যের তাপ থেকে ত্বককে রক্ষা করে এই উপাদানগুলি।
যাদের ত্বকে বেশি তেল যুক্ত তারা অয়েল বেসড সানস্ক্রিন এড়িয়ে চলুন এবং যাদের শুষ্ক ত্বক তাঁরা অবশ্যই ময়শ্চারাইজিং সানস্ক্রিন ব্যবহার করবেন। বাইরে যাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট আগে মেখে নিন। সম্ভব হলে ২ ঘন্টা বাদে আরও একবার মেখে নিতে হবে। বিজ্ঞাপনের ঝুঁকিতে পড়ে অযথা উচ্চ (চঋ যুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে যাবেন না। আমাদের এই পরিবেশে মোটামুটি (চঋ ৩০ যুক্ত সানস্ক্রিন যথেষ্ট। সঙ্গে দেখে নেবেন সেই সানস্ক্রিন আল্টাভায়োলেট -এ ও বি উভয় রশ্মিকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আছে কিনা। গরমের সময় ফাস্টফুডকে না বলুন। কেননা, এতে থাকা অতিরিক্ত লবন, তেল গরমে আপনার শরীরকে আরও বেশি ক্ষতি করবে। বাইরের খোলা খাবার থেকে বিরত থাকুন। ঘরোয়া হালকা খাবারে জোর দিন। প্রচণ্ড গরমে শরীরে যাতে ঘাম না জমে তার জন্য সম্ভব হলে হালকা রুমাল পানিতে ভিজিয়ে গা মুছে নিন। বাড়িতে থাকলে একধিকবার গোসল করুন। হঠাৎ বাইরে থেকে এসে এসি তে বসবেন না বা হঠাৎ এসি থেকে বেরিয়ে অতিরিক্ত গরমে যাবেন না। গরমে চা, কফি, কোল্ড ড্রিঙ্কস খাবেন না। দীর্ঘক্ষণ প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। এতে রক্তচাপ কমে যেতে পারে। তাই এ সময়টাতে শিশু, বৃদ্ধ সবাই বাড়তি যত্ন ও সতর্ক থাকুন। নিরাপদ আশ্রয়ে থাকুন।
কর্নেল (অবঃ) অধ্যাপক ডা. জেহাদ খান: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও কার্ডিওলজিস্ট, ইবনে সিনা কার্ডিয়াক সেন্টার।
বাড়ি-৬৮, রোড-১৫/এ, শংকর, ধানমন্ডি, ঢাকা।
প্রয়োজনে: ০১৭৭১-২৪১-৬৭৩, ৫৫০২৯১০১-১২