জরাজীর্ণ দেয়াল আর অবকাঠামোর মধ্যেই আটকে রয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র। নারী জাগরণের অগ্রদূতের আতুর ঘরটিই আজ অন্ধকারে। ৯ ডিসেম্বর আসলেই ধোয়া মোছা আর নামমাত্র আনুষ্ঠানিকতায় স্মরণ করা হয় তাঁকে।
রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দে এই মহীয়সী নারীর রয়েছে স্বজন ও বাবার পৈতৃক জমিদারি সম্পত্তি, আঁতুড়ঘরসহ স্মৃতিময় নানাকিছু। বছর ঘুরে এখানে সরকারিভাবে পালন করা হচ্ছে জন্ম-মৃত্যু দিবস। যাকে ঘিরে এত আয়োজন অথচ তার সমাধিই নেই পৈত্রিক নিবাসে।
দেহাবশেষ পড়ে আছে ভারতের কলকাতার সোদপুর নামের এক গ্রামে। প্রায় দেড় যুগে পরিবারের দাবি ছিল সেখান থেকে তার দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনার। কিন্তু সেই দাবি, চিঠি চালাচালিতে চাপা পড়ে আছে। এতে ক্ষুব্ধ পরিবার, স্বজন ও অনুরাগীরা।
সরেজমিনে মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ এলাকায় রোকেয়ার জন্মস্থান ঘুরে দেখা গেছে, মহীয়সী নারীর আতুর ঘরটি ইটের স্তুপ আর শ্যাওলায় আবৃত। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও শ্যাওলাপরা ইট আর ওয়াল ধুয়ে মুছে চুনকামে পালিত হচ্ছে রোকেয়া দিবস।
রোকেয়ার জন্মভিটার হাসপাতালটি মাত্র ১০ শয্যা বিশিষ্ট হওয়ায় পর্যাপ্ত সেবা থেকে বঞ্চিত স্থানীয়রা। তার ওপর দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও নার্সদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের রয়েছে নানা অভিযোগ।
রোকেয়ার নামে একটি বালিকা মাধ্যমিক স্কুল থাকলেও সেটি এখনও বেসরকারি। কারিগরি কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র না থাকায় শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারছেনা কোন নারী। অল্প বয়সেই বসতে হচ্ছে বিয়ের পিঁড়িতে। অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে তাদের দুচোখ ভরা স্বপ্ন।
এদিকে রংপুরে বেগম রোকেয়ার নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও সেখানে রোকেয়াকে নিয়ে নেই আলাদা কোন পাঠ। এ নিয়েও ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
১৯৯৭ সালে রোকেয়ার বসতভিটা রংপুরের পায়রাবন্দে গড়ে উঠেছে রোকেয়া গবেষণা ও স্মৃতিকেন্দ্র কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরোলেও এখনো প্রাণের সঞ্চার হয়নি এখানে। অধরাই থাকছে রোকেয়ার আদর্শ, জীবন দর্শন। উদ্যোগের অভাবে জন্মস্থানে এখনও রুদ্ধ রোকেয়া চর্চা ও গবেষণার দ্বার।
রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, “ঊনবিংশ শতকে নারীরা যখন অবরোধবাসিনী সেই সময় নারীর পরাধীনতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত। এই উপমহাদেশে মুসলিম নারীর যে অগ্রগতি তা অর্জনে রোকেয়ার দর্শন ও কর্মময় জীবন অন্তহীন প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে।”
দুলাল আরও বলেন, “এখানে একটি লাইব্রেরি থাকলেও তাতে নেই পর্যাপ্ত পরিমাণ বই। আর স্মৃতি কেন্দ্রের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিলো
রোকেয়াকে নিয়ে গবেষণার, রোকেয়ার স্মৃতি সংগ্রহশালা গড়ার, এই এলাকার দরিদ্র মেয়েদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রশিক্ষণ ও এমফিল ডিগ্রির ব্যবস্থা করার। এর কোনটিই এখানে সচল নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্মৃতি কেন্দ্রকে বিকেএমই গার্মেন্টস প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করা হয়। এটি দখলমুক্ত করে রোকেয়া চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার দাবি থাকলেও বাস্তবে তেমন কিছু হয়নি।
রোকেয়ার ভাতিজি রনজিনা সাবের বলেন, “রোকেয়ার সব কিছুই আছে পায়রাবন্দে। আমি নিজেই সেই সময় ডিসি এনামুল হককে অনুরোধ করে বললাম, রোকেয়ার দেহাবশেষ কলকাতা থেকে পায়রাবন্দে আনার জন্য। তিনি আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি ঢাকায় আবেদন পাঠিয়েছেন বলে আমরা শুনেছি। তিনি যে আবেদন করেছিলেন তার কিছুদিন পর তার বদলি হয়। বিষয়টি নিয়ে অনেক খোঁজ নিয়েছি অনেকবার বলেছি, অনেকবার। খোঁজ নিলেই বলে, প্রক্রিয়াধীন আছে। পরে কী হলো তা-ও জানি না। বছর বছর ডিসেম্বর আসে, আর আলোচনা হয়, কিন্তু কাজ হয় না।”
রংপুর জেলা প্রশাসক রবিউল ফয়সাল বলেন, “বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এই বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে জানাব।”
বেগম রোকেয়ার স্মৃতি কেন্দ্রের উন্নয়ন করতে সরকারের যথেষ্ট আন্তরিকতার কথাও জানান তিনি।