খালেদ উদ-দীন
দুইবাংলার সাহিত্যাঙ্গনের সুপরিচিত নাম, শিউল মনজুর। আজ এই কবির শুভ জন্মদিন। ১৯৬৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারিতে এই কবি, হযরত শাহজালালের পূণ্যভূমি, দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সুরমানগরী সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। আট এর দশক থেকে দুইবাংলার শীর্ষস্থানীয় পত্র-পত্রিকায় তার গল্প-কবিতা-ছড়া-প্রবন্ধসহ নানা বিষয়ের লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। বিভিন্ন মাসিক ও ত্রৈমাসিক সাহিত্য এবং লিটলম্যাগেও তার গুরুত্বপূর্ণ লেখা ছাপা হয়।
শিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এই কবি প্রাথমিক পর্যায়ে সাংবাদিকতা দিয়ে পেশাজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে অধ্যাপনা পেশায় জড়িত হন। কিন্তু লেখালেখির মধ্যেই তিনি জীবন যাপনের সকল আনন্দ খুঁজে বেড়ান। এই কবি এখনো তুমুল তারুণ্যের গতি নিয়ে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আজও গল্প কবিতা প্রবন্ধসহ নানা প্রকার লেখা উপহার দিয়ে পাঠকদের মায়াজালে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন।
এ পর্যন্ত তার ৮টি কবিতার বই (তিনফর্মা দীর্ঘশ্বাস, আমার প্রার্থণা, দূরের চিত্র কাছের চিত্র, সুরমা গাঙের বাসন্তি নাও, শোনো বীথি কানে কানে বলি, শাদা পাতা শাদা চোখ, পাতা শিশিরের অভিধান, সবুজ পাতার জংশনে, পাখিতীর্থেও আন্তঃনগর) ২টি গল্পের বই (তোমার জন্যে মাধবী, কবি ও প্রেমিকা), ২টি ছড়ার বই (খেলাধুলা হইচই বেশি করে পড় বই, ফুলবালিকার রঙিনছাতা) এবং ১টি উপন্যাস (প্রণয়ের মৌমাছি) প্রকাশিত হয়েছে।
অবিরাম কল্পনার রঙিন ক্যানভাসের ভেতর দিয়ে ব্যক্তিভাবনার রঙ মিশিয়ে কবিতা ও গল্পে স্বতন্ত্র মানস নির্মাণে সক্ষম শিউল মনজুর আজ আমাদের দূরের ও কাছের সাহিত্যাঙ্গনের একটি অনিবার্য নাম। বিশেষ করে তাঁর কবিতার ভেতর দিয়ে জেগে উঠেছে আমাদের গ্রাম বাংলার কুড়েঘরের উঠোন, কুড়েঘরের বৃক্ষছায়া, নদী সমুদ্র হাওর বাওরের পাখি, পাখি শিকারীদের গান, শীত গ্রীস্ম বর্ষা ও বসন্তের নান্দনিক চিত্র। তার কাব্যের অগ্রযাত্রায় আরো খুঁজে নিতে পারি বিশ্ববাংলার সিম্পনি, সময় পাটাতনের নিবিড়পাঠ। একেকটি অনবদ্য রচনার মধ্যদিয়েই বাঁক পেরিয়ে নতুন বাঁকের দিকে তিনি নিরন্তর অগ্রসরমান। গল্পের ভেতরও ছড়িয়ে আছে মুক্তিযদ্ধের রঙ, সমকালীন জীবনবোধ ও হৃদয় অনুভূতির অভিজ্ঞান।
শিউল মনজুরের জন্মদিনে তার দীর্ঘায়ু ও সাফল্য কামনা করি।
শিউল মনজুরের একগুচ্ছ কবিতা
১. সবুজবাঙলার ছবি
এক.
ফাগুনের ঝলমলে রোদ যখন শিমুল পলাশের রঙ ছুয়ে সবুজবাঙলার ছবি এঁকে দিচ্ছে তোমাদের মনের আঙিনায় আমি তখন শীত প্রধান দেশের এক নতুন আগন্তক, বসন্তের অপেক্ষায় সিলভারসিটির কানেকটিকাট এভিনিউতে ঘুরে বেড়াচ্ছি একা একা আর প্রিয় বইমেলার ধুলোবালি, ভালোবাসা দিবসের গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের সুরভি এবং একুশ উদ্যাপনের একেকটি পৃষ্টা খোলে দিচ্ছে স্বদেশভূমির বর্ণময়চিত্র।
দুই.
এখানেও ফুলে ফুলে ভালোবাসায় হারিয়ে যায় তরুণ-তরুণী। তাদের একেকটি আলিঙ্গন ও চুমু আমাকেও আবেগমথিত করে। তবু মনে হয় সোনালিরোদ যেনো লুকিয়ে আছে বাংলার পথে প্রান্তরে, আমার বাড়ির উঠোনে, গৃহবধূর রোপিত গোলাপ বাগানে। যেখানে প্রজাপতি ও পাখিরা রচনা করে জীবনের আনন্দ উদ্যান।
তিন.
গত দুদিনে দেখেছি গতিময় আমেরিকার উচুনিচু আ্ঁকাবাঁকা পিচডালা পথের কারুকাজ। লাল সবুজ বাতিগুলি নিয়ন্ত্রণ করছে পথের দূরত্ব এবং শপিংমল, বিমান বন্দর আর রেল টার্মিনাল ছাড়া কোথাও চোখে পড়েনি মানুষের ভিড়। তবু সভ্যতার প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থেকে মনে হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি হৃদয়বান।
২. আমি ও রোবটিক জগত
ঋতু বদলের সামান্য জ্ঞান নিয়ে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে এই ভূ-খন্ডের মানচিত্রে যখন প্রবেশ করি তখনো বুঝতে পারিনি মানবিক মূল্যবোধের সীমানা পেরিয়ে আমি রোবোটিক জগতে প্রবেশ করছি। অতঃপর ধীরে ধীরে স্বয়ংক্রিয় ভাবে রোবোটিক প্রাণের অস্থিত্ব এবং রোবোটিক আচরণের মধ্যদিয়ে টাকার ও চাকার অবিরাম ঘর্ষণ অনুভব করতে থাকি। আরো অনুভব করতে থাকি তারা বিশ ও পঁচিশের গল্পই করছে এবং জীবনবোধের সুখ দুঃখ ও আনন্দের ভৌগলিক মানচিত্রে তারা কখনও হাঁটেনি অথবা হাঁটলেও ভুলেই গেছে সে পৃথিবীর শিশির ও বৃষ্টিভেজা দিনের গল্প। স্বদেশ বিচ্ছিন্ন, টাকা ও চাকার ঘর্ষণে অভ্যস্ত রোবটগুলো, মানুষ খুন করার জায়গায় দাঁড়িয়ে হাসছে এবং ইতোমধ্যে আমাকে হাসতে হাসতে প্রতিনিয়ত খুন করছে অবলীলায়…। রোবটিক জগতে আর কতক্ষণ বাস করা যায়…!
৩. কবিতা ছাড়া শেষ পর্যন্ত আর কেউ থাকে না
এক.
শীতের শেষপ্রান্তে অথবা বলা যায় ঠিক বসন্ত আসার পূর্ব মুহূর্তে পৃথিবী ঘুরে দেখার এক নতুন বাসনা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম স্বদেশ ছেড়ে। প্রিয় নবীজির দেশ ছুঁয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যখন আমি লিঙ্কনের দেশে প্রবেশ করেছি, তখনি শীতের তীব্রতা আর প্রতিকুল বাতাসের আনাগোনা আমাকে জানান দিয়েছে এখানে অর্থ আর বিত্তের মোহ যদি অর্জন করে নেয়া যায় তাহলেই তুমি খুঁজে পাবে বসন্ত ও চেরীফুলের আনন্দ মৌসুম।
দুই.
পোটোমেক রিভারের তীর ঘেষে রিগান এয়ারপোর্টের উত্তরদিকে যখন একটি সন্ধ্যার পার্কে অজ¯্র শাদা ও ধূসর রঙের সি-গাল আমাকে মুগ্ধ করছিল বারবার, তখনো আমি জানতাম না, আগামি সকালটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে বেদনাময় বিষন্নতার…। এখন প্রতিটি মুহূর্ত, বলা যায় দিন ও রাতের রঙ বদলের সাথে সাথে মনে করিয়ে দেয় তুমি নিঃসঙ্গ আছো এবং প্রতিদিন আরো বেশি নিঃসঙ্গ হবে।
তিন.
বোধকরি কবিদের সাথে কবিতা ছাড়া শেষ পর্যন্ত আর কেউ থাকে না। এই যে আসছে বসন্ত ও চেরীফুলের মৌসুম; এক এ্যভিনিউ থেকে আরেক এ্যভিনিউ কিংবা এক হাইওয়ে থেকে আরেক হাইওয়ে অথবা ডাউন টাউন গুলো জেগে উঠবে ভালোবাসার মোহন এক্সপ্রেসে, সেখানে আমি নিঃসঙ্গ আমার পাশে কেউ নেই এবং কেউ এসে দাঁড়াবেও না জানি, কেননা আমার পকেট শূন্য এবং ওয়াশিংটন ডিসির পথে আমি এক নতুন উদ্বাস্তু; যে বেদনা কবি ছাড়া অন্য কেউ জানবে না অথবা বুঝবে না। যে ঘরের মানুষ, সেও তো কোনদিন খবর রাখেনি।
৪. প্রিয় বাংলাদেশ
বুকের ভেতর এক সাগর- সাগরের নাম ভূমধ্যসাগর।
বুকের ভেতর এক ফুল- ফুলের নাম শাপলা ফুল।
বুকের ভেতর এক পাখি- পাখির নাম দোয়েল পাখি।
বুকের ভেতর এক ভাষা- বাংলা ভাষা।
বুকের ভেতর এক মিনার- শহীদ মিনার।
বুকের ভেতর এক সৌধ- স্মৃতি সৌধ।
বুকের ভেতর এক মানচিত্র এক দেশ- প্রিয় বাংলাদেশ।