শিউল মনজুর
বাংলা ভাষা আমাদের প্রিয় ভাষা। এই ভাষায় আমরা কথা বলি। এই ভাষায় আমরা চিন্তা করি। এই ভাষায় আমরা আমাদের ভাবনা প্রকাশ করি এবং আমাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন রচনা করি। এই ভাষা আমাদের অন্তর আত্মার। এই ভাষা আমাদের গর্বের। অযুত অহংকারের। এক কথায় বাংলা ভাষা আমার মায়ের ভাষা। এই ভাষার জন্যে আমি লড়াই করতে পারি। মরতে পারি। কেননা এই বাংলা ভাষা আমাকে মা বলতে ডাক শিখিয়েছে। বাবা বলতে শিখিয়েছে। ভাইকে ভাই, বোনকে বোন এবং ছোট বড় সবাইকে ভালোবাসি বলতে এই বাংলা ভাষাই আমাকে শিখিয়েছে। তাই এই ভাষার প্রতি আমার জন্ম জন্মান্তরের দুর্বলতা। যে দুর্বলতা অকৃত্রিম প্রেম, ভালোবাসার এবং চিরন্তন সুখ ও শোকের।
শোকের শব্দটি উচ্চারণ করলাম এ কারণেই যে, পৃথিবীর একমাত্র বাংলা ভাষার মানুষ তাদের নিজেদের ভাষার রক্ষার জন্যে মরণ পণ লড়াই করেছে। এই বাংলা ভাষাকে লুপ্ত বা ধ্বংস করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান ও আসাম সরকার বারবার আঘাত করেছে। কিন্তু বাংলা ভাষার বাঙ্গালীরা নিজ মাতৃভাষা রক্ষার জন্যে ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
আমাদের মাতৃভাষার বিরুদ্ধে প্রথম ষড়যন্ত্র হয় ১৯৪৭ সালে। অবশ্য এই ষড়যন্ত্রটা শুরু হয় দেশ বিভাগের পর থেকেই। ১৯৪৮ সালে যখন সংখ্যাগরিষ্টের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয় তখনই আঘাত লাগে বাংলা ভাষাবাসী মানুষের বুকে। সাথে সাথে প্রতিবাদে মুখর হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানী বাংলাভাষাবাসী বাঙ্গালী মানুষ। এরপর থেকে বাঙলাভাষার মানুষেরা দলবেধে আন্দোলন শুরু করে সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে।
শুরু হয় বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলন। ১৯৫২ সালের দিকে এসে এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। তৎকালীর পাকিস্তান সরকার এ আন্দোলন দমনের লক্ষে সভা সমিতি মিছিলের উপর ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১৪৪ ধারার বিরুদ্ধে সে সময়কার বাঙ্গালী ছাত্র সমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার ঘোষণা দিয়ে ঢাকার রাজপথে মিছিল মিটিং করে। এসব মিছিল মিটিঙে পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায় এবং সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ অজানা অনেকে শাহাদাত বরণ করে। সেদিন ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। রক্তে ভেসে যায় ঐদিনকার রাজপথ। সুচিত হয় পাকিস্তান সরকারের কলংকিত অধ্যায়।
মূলত এই ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পরবর্তিতে সকল আন্দোলনের দানা বাধে। আজকের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নামক ভূ-খন্ডের যে জন্ম তার পেছনে ভাষা আন্দোলনের চেতনাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে। অর্থৎ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের পূর্বসুরিরা ভাষা আন্দোলনে রক্ত দিয়ে সাহসের বীজ বপন করেছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা ভাষার জন্যে যারা লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেছে তারা আমাদের ভাষা শহীদ। তাঁরা আমাদের চিরশ্রদ্ধার। তাঁরা আমাদের চির গৌরবের। প্রতি বছর শহীদ মিনারে ফুলে ফুলে গানে গানে যেমন তাঁদেরকে স্মরণ করা উচিত তেমনি তাঁদের জীবন সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা আমাদের ছোট বড় সকলের নৈতিক দায়িত্ব।
২১ ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে আমরা দলে দলে যাই। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গেয়ে গেয়ে শহীদ মিনারে সারিবদ্ধ হয়ে ফুল দিই, চোখের জলে শ্রদ্ধা নিবেদন করি এবং আরো নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে মহান ফেব্রুয়ারি মাসকে স্মরণ করি কিন্তু যারা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই বাংলা ভাষার জন্যে প্রাণ দিয়েছে সেই সব বীরদের সম্পর্কে আমরা তেমন কিছু জানি না। বলা যায় তাদেরকে নিয়ে আমরা তেমন চর্চা করি না। ফেব্রুয়ারি মাস চলে যাবার সাথে সাথে আমরাও ২১ ফেব্রুয়ারির কথা প্রায় ভুলেই যাই।
সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরো যারা এই পবিত্র ভাষা রক্ষার জন্যে জীবন দিয়েছে তাঁদের সম্পর্কে পাঠ করা, তাঁদের আদর্শ ও চেতনায় নতুন প্রজন্মকে উদ্ধুদ করা দেশ প্রেমেরই অংশ। এজন্য ভাষা শহীদদের সম্পর্কে আমাদের জাতীয় শিক্ষা পাঠ্য সূচিতে আলাদা আলাদা ভাবে তাঁদের জীবনী অর্ন্তভূক্ত করা উচিত। আবার ১৯৫২ সালে ভাষার জন্যে যারা বিভিন্নভাবে লড়াই করেছেন এবং এখনও জীবিত আছেন সেব ভাষা সৈনিকদের রাষ্ট্রীয়ভাবে উপযুক্ত মূল্যায়ন করার লক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
২১ ফেব্রুয়ারি আজ শুধু আমাদের বাংলাদেশের মাতৃভাষা দিবস নয় এটি এখন আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসও বটে। এদিকটাও গুরুত্ব দিয়ে সারা বিশে^ যাতে বাংলা ভাষা ছড়িয়ে দেয়া যায় তারও কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমান পৃথিবীতে ৬ হাজারের মতো ভাষা আছে। এমনও আছে কোনো কোনো ভাষায় কথা বলে ১০০ জন মানুষ। প্রত্যেক ভাষার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা রয়েছে। পৃথিবীতে বাংলা ভাষার স্থান সপ্তম। বর্তমানে বাংলা ভাষায় কথা বলে ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ। তা ছাড়া সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাভাষাবাসী হাজার হাজার মানুষ ছড়িয়ে আছে। সুতরাং বাংলা ভাষাকে ষড়যন্ত্র করে ধ্বংস করা যাবে না। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষাতেই, সারা পৃথিবীর মানুষ কথা বলবে। এ জন্যে আমাদের সকলকে বাংলা ভাষার প্রতি, ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কাজ করে যেতে হবে।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক।
sheoulmanjur@yahoo.com