মোঃ সাইফুল ইসলাম
দেশের ১০টি জেলার ১০টি উপজেলায় ‘দারিদ্র বিমোচনে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রাপ্ত মা’দের জন্য স্বপ্ন প্যাকেজ কর্মসূচি’ মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ২০১৪-১৫ অর্থ বছর থেকে দুই বছর মেয়াদে বাস্তবায়ন করেছে।
গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে ২০১২-১৩ এবং ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে সরকারি ভাবে যে সকল মায়েরা দুই বছর মাতৃত্বকালীন ভাতা পেয়েছে সে সকল মা’দের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত দরিদ্র তাদের মধ্য থেকে ৬০ জন মাকে স্বপ্ন প্যাকেজ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় প্রত্যেক মাকে স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিনসহ আবাসন, জীবিকায়ন উপকরন, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জন্মনিয়ন্ত্রন কার্ড, শিক্ষা ও বিনোদন কার্ড প্রদান করা হয়। স্বপ্ন মা’দের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মা ও শিশুর যত্ন, স্বাস্থ্যবিধি, পরিবার পরিকল্পনা, যৌতুক, বাল্যবিবাহ এবং আয় বৃদ্ধি মূলক দক্ষতা উন্নয়নের জন্য হাঁস মুরগি পালন, গরু ও ছাগল পালন, মাছ চাষ, শাক-সবজি চাষ, ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় ।
স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিনসহ আবাসন উপকরণের জন্য প্রত্যেক মাকে পঁচিশ হাজার টাকা বা সমমূল্যের উপকরণ প্রদান যা তারা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে স্থাপনের সুযোগ পেত। জীবিকায়ন উপকরণ বিতরনে প্রত্যেক মা’কে তেইশ হাজার টাকা বা সমমূল্যের উপকরণ প্রদান এবং এখানেও তাদের অংশীদারিত্বের সুযোগ ছিল। এসকল উপকরণ বিতরনের সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সহ উপস্থিত থাকেন। সম্পদ হস্তান্তরে নির্বাচিত মা ও তার স্বামী এবং ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে ২২টি বিষয় ও শর্তাবলি সম্বলিত পাবলিক পুয়র প্রাইভেট পার্টনারশীপ (পিপিপিপি)চুক্তিপত্র সম্পাদিত হয়।
স্বপ্ন প্যাকেজ কর্মসূচির কার্যক্রমের ফলাফল মুল্যায়নের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আল আমিন ১০ জন স¦প্ন মায়ের বাড়ী পরিদর্শন করেন। স্বল্প পুঁজি সম্বল করে স্বপ্ন মায়েরা যে ভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে তা দেখে উপ-পরিচালক মহোদয় বিস্মিত হন।
মিরা বিশ্ব্াস তেইশ হাজার টাকার জীবিকায়ন উপকরণ একটি গাভী পেয়ে বর্তমানে তার তিনটি গরু। যার বর্তমান মূল্য দেড় লক্ষ টাকা। গরুর দুধ বিক্রি করে তিনি একটি বাছুর ক্রয় করেন। এক বছর পালন করে তিনি ষাট হাজার টাকা বিক্রি করেন, যা দিয়ে তিনি বাড়ির পাশে জমি বন্ধক নিয়ে সবজি চাষ করেন। সবজি নিজেরা খান এবং বাজারে বিক্রি করে আয় ভালো হচ্ছে পাশাপাশি স্বামী গ্রামে একটি অটো রাইস মিলে চাকরি করেন। ছেলেকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন। স্কুলে শিক্ষাও বিনোদন কার্ড প্রদর্শন করায় প্রধান শিক্ষক পরীক্ষার ফি ফ্রি করে দিয়েছেন। এখন তাদের সুখের সংসার। সমাজে তারা অনুকরণীয় হয়ে উঠেছেন। তাদের দেখাদেখি গ্রামের অনেকে গাভী পালনে উৎসাহিত হচ্ছেন। ছোট পরিবার, যৌতুক, বাড়ির আশেপাশে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যার্র্ট্রিন ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে তারা প্রতিবেশীদের পরামর্শ দিচ্ছেন।
বর্ণমালা পাড়ৈ স্বপ্ন প্যাকেজে অন্তর্ভূক্তির পূর্বে তার থাকার ভাল ঘর ছিলো না। চালা দিয়ে পানি পড়ত। ভাঙ্গা বেড়া দিয়ে ঘরে বাতাস ঢুকত। শীতকালে সন্তানসহ তাদের সর্দি কাশি লেগে থাকত। স¦প্ন প্যাকেজ থেকে স্বাস্থ্য সম্মত ল্যাট্রিনসহ একটি ঘর পাওয়ায় তাদের বসবাসের সু-ব্যবস্থা হয়েছে। এখন তাদের অসুখ বিসুখ হয় না বললেই চলে। এখন তারা সকলেই সুস্থ জীবনযাপন করছেন। বর্ণমালা স্বপ্নপ্যাকেজ থেকে পাওয়া গরুটি একটি বাছুর দিয়েছে। গরুটি (৫-৬) কেজি দুধ দেয়। গরুটি আবার গাভীন হয়েছে। গরুর দুধ বিক্রি করে টাকা সঞ্চয় করে একটি মুদিদোকান দিয়েছেন যা বর্ণমালা নিজেই পরিচালনা করে। দোকানের আয় এবং স্বামীর বর্গাচাষের আয় দিয়ে তারা বর্তমানে স্বাবলম্বী।
মারিয়া বেগম এর স্বামী বেকার ছিল। সংসারে ঝগড়া বিবাদ ছিল। স্বপ্নপ্যাকেজে অন্তর্ভূিক্ত মারিয়ার জীবনে মোড় ঘুড়িয়ে দেয়। গরুটি ছয়মাস লালন পালনের পর ৪৫ হাজার টাকা বিক্রি করে আরো ২০ হাজার টাকা যোগ করে একটি উন্নত জাতের গাভী ক্রয় করেন। গরুটি একটি বাছুর দিয়েছে। গরু দৈনিক (৭-৮) কেজি দুধ দেয়। গরু দুধ বিক্রি করে টাকা সঞ্চয় করে স্বামীকে একটি মুদি দোকান করে দিয়েছে। স্বাস্থ্য পুষ্টি ও জন্ম নিয়ন্ত্রন কার্ড প্রদর্শন করে হাসাপাতালে সন্তানের চিকিৎসায় সুযোগ-সুবিধা ও গুরুত্ব পেয়েছে। সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা আসায় সংসারে মারিয়ার কদর বেড়েছে। শ্বশুর-শ্বাশুরি তার গরুর যত্ন নেয়। তার মতামতের গুরুত্ব দেয়।
নন্দিতা মন্ডল এর স্বামী বেকার ছিল। সংসারে অভাব ছিল। থাকার ভালো ঘর ছিল না। স্বপ্ন প্যাকেজ থেকে ল্যান্টিনসহ বাস স্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। স্বপ্ন প্যাকেজ থেকে সবজি চাষের প্রশিক্ষণ পেয়ে স্বামী স্ত্রী মিলে সবজি চাষ করে আয় ভালো হচ্ছে। গরুর গবর দিয়ে নন্দিতা মুইঠা বানিয়ে নিজেই বিক্রি করে মাসে ২ হাজার টাকা বাড়তি আয় করছে। এখন তাদের ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা প্রতিবেশীর সাহায্যের জন্য বসে থাকতে হয় না। তারা এখন স্বাবলম্বী। এ পরিবারটি সমাজে আদর্শ হয়ে উঠেছে। তাদের দেখা-দেখি অনেকেই বাড়ীর পাশে, পুকুর পাড়ে, খোলা জায়গায় সবজি চাষ এবং লাভজনক বিধায় গাভী পালনে উৎসাহিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে নন্দিতা মন্ডল তাদের পরামর্শ প্রদান করছে।
একে একে গোপালপুর ইউনিয়নে যমুনা টিকাদার, কনিকা মন্ডল, পাটগাতী ইউনিয়নে লাবনী রায়, কুশালী ইউনিয়নে মিতু মন্ডল, বর্নি ইউনিয়নে চায়না -স্বপ্নপ্যাকেজে অর্ন্তভূক্ত হয়ে সকলেই এখন স্বাবলম্বী। স্বপ্ন মায়ের বাড়ী পরিদর্শন করে প্রকল্পের অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হয়। পরিদর্শন শেষে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা প্রকল্পের মূল্যায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে উপ-পরিচালক মহাদয় বলেন, ‘এখানে প্রকল্পের ফলাফল প্রত্যাশার চেয়ে ও বেশী পূরণ হয়েছে। যেখানে মনিটরিং ভালো ছিল, সেখানে ফলাফল ভালো হয়েছে’।
স্বপ্ন প্যাকেজ কার্যক্রমের উদ্যোক্তা, ডরপ’র প্রতিষ্ঠাতা এএইচএম নোমান বলেন, এসডিজি একের ভেতরে সতের লক্ষ অর্জনে আগামী ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের বাজেটে ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা’র সংখ্যা ৫লাখ থেকে না বাড়িয়ে ভাতার পরিমান ৫শ টাকা থেকে ১হাজার টাকায় উন্নিত করার দাবী করেন জনাব নোমান। একই সাথে তিনি ১০ উপজেলায় তথ্য-উপাত্য সম্বলিত, পরীক্ষিত, টেকসই, দেশজ স্বপ্ন প্যাকেজ কর্মসূচী সম্প্রসারণে ‘এক মা, ১ লক্ষ টাকা’ হারে, একশত জন করে, ১০০টি উপজেলার জন্য মোট ১০০কেটি টাকার প্রস্তাবিত ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ প্রকল্পটির জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখার জন্য সরকারের প্রতি দাবী জানান। এ ছাড়া তিনি জাতীয় দারিদ্র্য বিমোচন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠারও দাবী জানান।
ডরপ এর উপজেলা সমন্বয়কারী বলেন- ‘স্বপ্ন প্যাকেজে বসত ঘর এবং জীবিকায়ন উপকরণ প্রদানের পাশাপাশি আয় বৃদ্ধি মূলক দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান এবং স্থানীয় প্রশাসন ও র্ডপ এর কর্মীদের মনিটরিং এর ফলে স্বপ্ন প্যাকেজে সাফল্য অর্জিত হচ্ছে।
স্বপ্ন প্যাকেজের মাধ্যমে দরিদ্র মা তথা নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। সরকারের সামান্য সহযোগীতায় নারীরা এগিয়ে চলেছে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায়। তারা সমাজে অনুকারনীয় আদর্শ হয়ে উঠেছে। আশা করা যায় সারা দেশে স্বপ্ন প্যাকেজ সম্প্রসারনের ফলে ক্ষুধা ও দরিদ্র মুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশ গড়া সম্ভব হবে।