মুসা সাদিক
আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ’৭১ সালে আমি ছিলাম রণাঙ্গনে। স্বাধীন বাংলা বেতারের ‘রণাঙ্গন সংবাদদাতা’ হিসেবে ১১টি সেক্টরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে আমি উল্কার বেগে ছুটতাম। আজ এক রণাঙ্গনে ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যে সকাল কেটেছে, কিন্তু পরদিন আবার সন্ধ্যায় অন্য রণাঙ্গনে দু’পরে কামানের গোলা-বারুদে ভারী বাতাসের মধ্যে নিঃশ্বাস টানতে হয়েছে। কখনও রণাঙ্গনের বাতাস হিমালয়ের মত ভারী হয়ে উঠেছে বিউগলের অন্তিম সুরে, যখন কোন বীর মুক্তিযোদ্ধার ছিন্নভিন্ন দেহ অশ্র“জলে বিদায় দিয়ে তার সহযোদ্ধারা চিরনিদ্রায় শায়িত করে দিয়েছেন তাকে রণাঙ্গনের মাটিতে।
মনে পড়ছে ৯ নম্বর সেক্টরে শাজাহান মাষ্টারের নেতৃত্বে পাক সেনাদের সঙ্গে মুখোমুখি সমরে সাতীরা হাবলু-এনামুলদের প্রিয় সহযোদ্ধা খোকনের আত্মদানের কথা। শহীদ বীর খোকনের পবিত্র লাশটুকু দেয়নি বর্বর পাক সেনারা।
মনে পড়ছে তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধে বীর তরুণ দুলু মিয়ার আত্মদানের কথা। সেক্টর কমান্ডার শফিউল্লাহ সাহেবের হাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় বীর দুলু মিয়া বলে যান “স্যার বঙ্গবন্ধুকে আমার রক্ত ভেজা শার্ট দেখিয়ে বলবেন, তিনি বলেছিলেন তোমরা রক্ত দেয়ার জন্য তৈরী হয়ে যাও। আমি রক্ত দিয়েছি। আমি এখন মৃত্যুর পথে। আমার মৃত্যু হলে আমাকে বাংলাদেশের মাটিতে কবর দেবেন।”
মনে পড়ছে রাধানগরের যুদ্ধের মহান বীর শহীদ সুবেদার সদরুদ্দীনের কথা। তার বাড়ি থেকে যুদ্ধের মধ্যে খবর আসে যে, তার একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। কিন্তু মাতৃভূমির ডাক ফেলে, যুদ্ধ ফেলে তিনি তার প্রথম প্রিয় সন্তানকে দেখতে যেতে পারেননি। সেই জাতীয় বীর ১৬ অক্টোবরে তিতিদাহের যুদ্ধে পাক সেনাদের কামানের গোলায় পাঁজরে শেলের মারাত্মক আঘাত পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার মুহূর্তে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে শেষ ক’টি কথা খুব কষ্টে বলেছিলেনঃ “খুব কষ্ট নিয়ে মারা যাচ্ছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখে গেলাম না। প্রথম পুত্রের মুখও দেখে গেলাম না। আমার বাবাও আমার মুখ দেখতে পেল না।” আজ মহান বিজয় লগ্নে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের হাজার হাজার বীর শহীদের শেষ কথা কানে বাজছে। শেষ অশ্রু চোখে ভাসছে।
রণাঙ্গনে সেদিন যারা বীর বিক্রমে লড়েছিলেন, তাদের বীরত্বগাঁথা ১৯৭৭ সালে শ্রদ্ধেয় হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ’ ১৫ খণ্ডে প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৭৭ সালের আগষ্টের শেষে একদিন তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আকবর কবিরের তদানীন্তন একান্ত সচিব খান আমির আলীর কক্ষে আমাকে বললেন, “মুক্তিযুদ্ধের ওপর তুমি অনেক মর্মস্পর্শী লেখা লিখেছো। আমি ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ’ ইতিহাস প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে ঢাকা পৌরসভার ডোম ও সুইপার এবং সুপারভাইজারদের থেকে এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে তৃতীয়/চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ও পুলিশ অফিসারদের থেকে ২৬শে মার্চের গণহত্যা বিষয়ে লোমহর্ষক অনেক তথ্য পাচ্ছি। তুমি তাদের সাাতকারগুলো নিয়ে রাখো। বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিও যে, পাক সেনারা নরপশু ছিল। তারা মানুষ ছিল না। তারা হিটলারের চেয়েও বড় যুদ্ধাপরাধী ছিল।”
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা খান আমির আলীও অনুরূপ উৎসাহ দিলেন। তাদের দু’জনের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে পরদিন থেকে পর পর কয়েকদিনে আমি ঢাকা পৌরসভার যেসব ডোম ও সুপারভাইজার ২৬শে মার্চ থেকে ঢাকায় লাশ তোলার কাজ করেছে এবং পরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর যেসব কর্মচারী ও পুলিশ অফিসার কাজ করেছেন, তাদের সকলের সাক্ষাতকার নিতে শুরু করি।
ঢাকা রেলওয়ে সুইপার কলোনীতে ’৭১ সালে বসবাসকারী ঢাকা পৌরসভার সুইপার চুন্ন ডোম ২৬শে মার্চের গণহত্যার এক সাী। ২৬ মার্চ থেকে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত নর-নারীর লাশ তিনি নিজ হাতে তুলেছেন। ঢাকা পৌরসভার চুন্ন ডোমকে আমি জিজ্ঞেস করলামঃ “২৬ মার্চ ঢাকার কোথায় আপনি কি ডিউটি করেছিলেন?”
চুন্ন ডোম : “১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ সকালে ঢাকার পৌরসভার সুইপার ইন্সপেক্টর ইদ্রিস সাহেব রাস্তায় পড়ে থাকা লাশ উঠাবার জন্য আমাকে ডেকে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে দেখি, বদলু ডোম, রঞ্জিত ডোম (লাল বাহাদুর), গণেশ ডোম ও কানাই ডোম আগে থেকে সেখানে আছে। আমাদের একটি ট্রাকে করে প্রথমে শাঁখারী বাজারের কোর্টের প্রবেশ পথের সামনে নামিয়ে দেয়। ঢাকা জজ কোর্টের দণি দিকে ঢোকার মুখে যে পথ শাঁখারী বাজারের দিকে চলে গেছে সেখানে গিয়ে পথের দু’ধারে ড্রেনের পাশে যুবক-যুবতীর, নারী-পুরুষের, শিশু-কিশোরের বহু পচা লাশ দেখতে পেলাম। তার মধ্যে বহু লাশ পচে, ফুলে বীভৎস হয়ে গেছে। দেখলাম শাঁখারী বাজারের দু’দিকের ঘরবাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। অনেক লোকের অর্ধপোড়া লাশ চারদিকে পড়ে আছে দেখলাম। কাছাকাছি সশস্ত্র পাঞ্জাবী সৈন্যদের পাহারায় মোতায়েন দেখলাম। প্রত্যেক ঘরে দেখলাম মৃত নর-নারী-শিশু জ্বলছে, আসবাবপত্র জ্বলছে। একটি ঘরে প্রবেশ করে একজন মেয়ে, একজন শিশুসহ বারজন যুবকের দগ্ধ লাশ উঠিয়েছে। সেই অবস্থার মধ্যে আমরা সবাই মিলে শাঁখারী বাজারের প্রতিটি ঘর থেকে যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা, শিশু-কিশোর ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধার লাশ তুলেছি। পাঞ্জাবী সৈনিকরা সেখানে থাকা অবস্থায় সেই সব অসংখ্য লাশের উপর বিহারীদের আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে লুট করতে দেখলাম। প্রতি ঘর থেকে বিহারীরা মূল্যবান সামগ্রী, সোনাদানা সবকিছু লুট করে নিয়ে যাচ্ছে দেখলাম।”
চুন্ন ডোম এখানে মর্মস্পর্শী ঘটনার মুখোমুখি হয়। সে কথা উল্লেখ করে বলে : শাঁখারী বাজারে সারাদিন ধরে অসংখ্য লাশ উঠাতে উঠাতে হঠাৎ এক ঘরে প্রবেশ করে এক আহত অসহায় বৃদ্ধাকে দেখলাম। বৃদ্ধা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করছিল। তাকে আমি পানি দিতে চেয়েও দিতে পারিনি। আমি পানি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের পিছনে সশস্ত্র পাঞ্জাবী সেনা পাহারায় থাকায় সেই বৃদ্ধাকে পানি দিয়ে সাহায্য করতে পারিনি।
এই সব লাশ নিয়ে তারা কি করেছে জানতে চাইলে চুন্ন ডোম বলে, আমরা নির্দেশ মত ২৮ মার্চ শাঁখারী বাজার থেকে প্রতিবার এক/দেড়শ’ লাশ উঠিয়ে তৃতীয়বার ট্রাক বোঝাই করে তিনশ’ লাশ ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ সকাল থেকে আমরা মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশ ঘর ও প্রবেশ পথের দু’পাশ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা কালীবাড়ি, শিববাড়ি, রোকেয়া হল, মুসলিম হল, ঢাকা হল থেকে শত শত লাশ উঠিয়েছি।
মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে লাশ তোলার লোমহর্ষক ও হৃদয় বিদারক দৃশ্য তুলে ধরে চুন্ন ডোম বলে, ২৯ মার্চ আমাদের ট্রাক প্রথম ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে যায়। আমরা উক্ত পাঁচজন ডোম মিলে হাসপাতালের প্রবেশ পথে নেমে কয়েকজন বাঙালি যুবক ও যুবতীর পচা, ফোলা, বিকৃত লাশ দেখতে পেলাম। গলে যাওয়ায় লোহার কাঁটার সঙ্গে গেঁথে লাশ ট্রাকে তুলতে হয়েছে। ইন্সপেক্টর সাহেব পঞ্চম আমাদের সঙ্গে ছিলেন। সেখান থেকে আমরা লাশ ঘরে প্রবেশ করে বহু যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কিশোর ও শিশুর স্তুপীকৃত লাশ দেখলাম। সে যেন লাশের পাহাড়। আমি এবং বদলু ডোম লাশ ঘর থেকে লাশের পা ধরে টেনে ট্রাকের সামনে জমা করেছি। আর রঞ্জিত (লাল বাহাদুর), কানাই ও গণেশ ডোম কাঁটা দিয়ে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে পচা, গলিত লাশ ট্রাকে তুলেছে। সেখানকার প্রতিটি লাশ শত শত গুলীতে ঝাঁঝরা অবস্থায় পেয়েছি। মেয়েদের লাশের কারও স্তন পাইনি। মেয়েদের লাশের যোনিপথ ক্ষত-বিক্ষত এবং পিছনের মাংস কেটে নেয়া অবস্থায় দেখেছি। মেয়েদের লাশ দেখে মনে হয়েছে, হত্যা করার আগে তাদের স্তন ধারালো ছোরা দিয়ে কেটে তুলে নেয়া হয়েছে। মেয়েদের যোনিপথে লোহার রড কিংবা বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। যুবতী মেয়েদের যোনিপথের এবং পিছনের মাংস যেন ধারালো চাকু দিয়ে কেটে এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি যুবতী মেয়ের মাথায় খোঁপা চুল দেখলাম। তাদের সুন্দর মুখগুলো দেখে খুব কষ্ট পেলাম বুকে। এই সুন্দর সুন্দর মেয়েদের বাবা-মা কোনদিন এদের মুখ আর দেখতে পাবে না মনে করে খুব কষ্ট হল। মিটফোর্ড থেকে আমরা প্রতিবার এক/দেড়শ’ লাশ নিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি।
পরের দিন ৩০ মার্চ তারা কোথায় কোথায় ডিউটি করে সে প্রসঙ্গে চুন্ন ডোম বলে, ৩০ মার্চ দক্ষিনা ডোম আমাদের পাঁচজনের সঙ্গে কাজে যোগ দেয়। আমাদের ট্রাক নিয়ে ৩০ মার্চ আমরা সেদিন সাত মসজিদ রোড যাই। আমি সাত মসজিদের সামনে থেকে যখন বাঙালির লাশ উঠাচ্ছিলাম, তখন অসংখ্য বিহারী আমাদের চারদিকে দাঁড়িয়ে হাসছিল আর শেখ সাহেবের নামে গালি দিচ্ছিল। আমরা সাত মসজিদের সামনে থেকে আটটি বাঙালি যুবকের লাশ তুলেছি। অনেক লাশ দেখলাম উপুড় হয়ে আছে। সবার বুক ও পিঠ গুলির অসংখ্য আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। আমরা তাদের পচা, ফোলা লাশ তুলতে গিয়ে দেখলাম, লাশের কারও লুঙ্গি পরা, কারও পাজামা পাঞ্জাবী পরা। অনেকের আবার হাওয়াই শার্ট এবং টেট্রনের দামী প্যান্ট পরা দেখলাম। পানি থেকে বারটি লাশ তুলেছি। লাশগুলোর চোখ এবং হাত পিছন দিকে বাঁধা ছিল। নদীর পাড় থেকে বারটি লাশ গুলীর আঘাতে ঝাঁঝরা অবস্থায় পেয়েছি। লাশ দেখে মনে হল অভিজাত বাঙালি পরিবারের যুবকদের লাশ। সাত মসজিদের সকল লাশ তুলে ধলপুরে ময়লা ডিপোতে আমরা ফেলেছি।
চুন্ন ডোম বর্তমানে মন্ত্রী পাড়া নামে খ্যাত মিন্টু রোডেও সেদিন লাশ তোলার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলে, আমরা ওই দিন ওখান থেকে ফিরে মিন্টু রোডে লাশ তুলতে যাই। মিন্টু রোডের পাশ থেকে প্যান্ট পরা অবস্থায় দুই যুবকের দুটি পচা লাশ তুলেছি। সে লাশ নিয়ে ধলপুর যাবার পথে ঢাকা স্টেডিয়ামের সামনে থেকে এক বৃদ্ধ ফকিরের সদ্য গুলীবিদ্ধ লাশ তুললাম। দেখলাম লাশের পাশেই তার ভিার ঝুলি, শূন্য টিনের ডিব্বা ও লাঠি পড়ে আছে। সে লাশ তোলার সময় দেখলাম তার টিনের ডিব্বায় কোন পয়সা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র-ছাত্রীর কোন লাশ তারা তুলেছে কিনা? সে প্রশ্ন করলে চুন্ন ডোম বলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ির সামনে থেকে দু’জন রূপসী ছাত্রীর এবং তিনজন ছাত্রের ত-বিত লাশ তুলেছি। লম্বা, ফরসা, দুটি রূপসী মেয়ের স্তন কাটা পেয়েছি। তাদের ঠোঁট দু’টি কাটা ছেঁড়া পেয়েছি এবং যোনিপথে লোহার রড বা বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এদের লাশ তুলে আমরা এরকম আর কোন ছাত্রীর লাশ পড়ে আছে কিনা তা দেখার জন্য রোকেয়া হলে যাই। সেখানে একটি অর্ধদগ্ধ যুবতীর লাশ তুলেছি। তারও দুই স্তন ছোরা দিয়ে কেটে নেয়া অবস্থায় পেয়েছি। মুসলিম হলে প্রবেশ করে একটি পচা লাশ পেয়েছি, ঢাকা হলের ভিতর থেকে চারজন ছাত্রের লাশ তুলেছি। তাদের একজন উত্তম কুমারের মত দেখতে। তার মুখে তখনও চাঁদের হাসি ছিল। তাকে দেখে আমার খুব মায়া হয়, কষ্ট হয়। পরের দিন ৩১ মার্চ বাসাবোর খাল থেকে তিনটি পচা লাশ তুলেছি। এ কয়দিন একসঙ্গে শত শত লাশ তুলে এবং এত শিশু ও মা-বোনের লাশের ওপর এত নির্যাতনের চিহ্ন দেখে আমার হাঁটা চলার শক্তি হারিয়ে ফেলি। আমি এ সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ফলে লাশ তোলার কাজ আমি আর করিনি। অন্যরা করতে থাকে।”
চুন্ন ডোমের মত ২৬ মার্চ থেকে ঢাকার শত শত লাশ তোলার দায়িত্ব পালন করেছে ঢাকা পৌরসভার ডোম পরদেশী। পশু হাসপাতালে গিয়ে তার সাক্ষাতকার নিলাম। সে ছিল সরকারী পশু হাসপাতালের ডোম।
২৬ মার্চ থেকে ঢাকার কোথায়, কার নির্দেশে তিনি কি ডিউটি পালন করেছেন জানতে চাইলে পরদেশী ডোম বলল, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সকালে রাজধানী ঢাকায় পাক সেনাদের গণহত্যার পর ঢাকা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মেজর সালামত আলি খান শুর, প্রশাসনিক অফিসার ইদ্রিস আরও কয়েকজন অফিসার সঙ্গে নিয়ে একটি ট্রাকে করে পশু হাসপাতালের গেটে এসে চিৎকার করে আমার নাম ‘পরদেশী, পরদেশী’ বলে ডাকাডাকি করতে থাকে। আমি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আমার পশু হাসপাতাল কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে আসি। ইদ্রিস সাহেব খুব ক্ষ্যাপা স্বরে বলতে থাকেন, তোমরা সব ডোম ও সুইপার বের হও। যদি বাঁচতে চাও এক্ষুণি সবাই মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্তুপীকৃত লাশ উঠিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলে দাও। নইলে কেউ বাঁচতে পারবে না। পাক আর্মির হাত থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না।”
পৌরসভার ওই লোকগুলো ছিল আর্মির লোক, একথা বলে পরদেশী ডোম বলল, পৌরসভার সেই ট্রাকে আগে থেকে সুইপার লাডু, কিষণ ও ভরত বসা ছিল। তার নির্দেশ অমান্য করার কোন উপায় না দেখে ট্রাকে উঠে বসলাম। সেই ট্রাকে করে ঢাকা পৌরসভা অফিসে গিয়ে আমাদের প্রায় আঠার জন সুইপার ও ডোমকে একত্রিত করা হল। সেখানে ছয়জনের সঙ্গে দু’জন করে সুইপার ইন্সপেক্টরকে আমাদের সুপারভাইজার নিয়োগ করে তিন ট্রাকে ভাগ করে তিন দলকে মিটফোর্ড, বাংলাবাজার ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রেরণ করা হয়। আমি মিটফোর্ডগামী ট্রাকে ছিলাম।
‘মিটফোর্ড হাসপাতালে আপনারা কাদের লাশ তুললেন’ প্রশ্নের উত্তরে পরদেশী ডোম বলল, আমাদের ট্রাক সকাল ন’টার সময় মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশ ঘরের সামনে উপস্থিত হলে আমরা ট্রাক থেকে নেমে লাশ ঘরে ঢুকি। লাশ ঘরে লাশের উপর লাশের পাহাড় দেখে ভড়কে যাই। সব লাশের বুক এবং পিঠ মেশিন গানের গুলীতে ঝাঁঝরা। প্রায় এক/দেড়শ’ যুবক-যুবতী ও ছাত্র-ছাত্রীর বীভৎস লাশ দেখে গা ছমছম করে উঠল। আমার সুপারভাইজারের নির্দেশে আমি লাশ ঘরের ভিতরে গিয়ে প্রতি লাশের পা ধরে টেনে বের করে আনতে পারলাম। বাইরে দাঁড়ানো অন্যান্য সুইপার লাশগুলো দাঁড়ানো ট্রাকে উঠিয়েছে। আমি ও আমার সঙ্গীরা দেখলাম যে, প্রতি লাশের বুক ও পিঠ মেশিন গানের শত শত গুলীতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। বহু মা, বোন ও শিশুর লাশ এভাবে তোলার পর একটি উলঙ্গ লাশ তুলতে গিয়ে কেঁদে ফেললাম।
আমি কিছুক্ষণ তাকে শান্ত থাকতে বললাম। অন্যদিন আসব বললাম। কিন্তু সে বলল, আমি স্যার আপনাকে সেদিনের সব ঘটনা বলতে চাই।
জিজ্ঞেস করলাম, “লাশটি কি আপনার কোন আত্মীয় বা আপন জনের?”
সরকারী পশু হাসপাতালের সুইপার পরদেশী বললেন, না স্যার। সব লাশ তোলা শেষে একপাশে একটা লম্বা টেবিলের উপর চাদর দিয়ে ঢাকা একটি লাশের উপর থেকে চাদর টানতেই দেখলাম একটি রূপশী ষোড়শী যুবতীর উলঙ্গ লাশ। লাশের বুক, যোনিপথ ক্ষত-বিক্ষত। কোমরের, উরুর ও পিছনের মাংস ধারালো ছোরা দিয়ে কেটে তুলে নেয়া হয়েছে। ফুলের মত শরীরের বুক থেকে স্তন দু’টি কেটে তুলে নেয়া। তার কোমর পর্যন্ত লম্বা ঘন কালো চুল। হরিণের মত মায়াময় চোখ দু’টি দেখে স্যার আমার চোখ বেয়ে দরদর করে পানি পড়তে লাগল। আমি কিছুতেই চোখের পানি রাখতে পারলাম না। আমি আমার সুপারভাইজারের ভয়ঙ্কর গর্জন ও গালাগালির মুখে সেই সুন্দরীর পবিত্র দেহ অত্যন্ত যতœ ও সম্ভ্রমের সঙ্গে ট্রাকে উঠিয়ে দিলাম। সেখানে সবাই দেখল, আমি কাঁদছিলাম আর চোখ মুছছিলাম। তা দেখে আমার সুপারভাইজার আমাকে গালিগালাজ করলেন। কাঁদলে পাক আর্মি আমাকে মেরে ফেলবে বলে ধমকালেন। মিটফোর্ডের লাশ ঘরের সব লাশ ট্রাকে উঠিয়ে আমরা ধলপুরে ময়লা ডিপোতে নিয়ে গিয়ে বিরাট গর্তের মধ্যে ঢেলে দিলাম। সেখানে দেখলাম বিরাট বিরাট গর্তের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার সুইপার ও ডোমরা ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা শত শত মা, বোন, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও শিশু-কিশোরের লাশ ট্রাক থেকে গর্তের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।”
‘পাক সেনারা কি প্রত্যেক বাঙালি মা-বোনের ওপর পাশবিক নির্যাতন করে বলে দেখেছেন কিনা’- এই প্রশ্নের উত্তরে পরদেশী ডোম তার সেদিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলে, পুরুষ-রমণী অধিকাংশ লাশের দেহে কোন কাপড় দেখিনি আমরা। যে সমস্ত যুবতী মেয়ে ও রমণীর লাশ ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলা হয়, তাদের কোন লাশের দেহেই আমরা কোন আবরণ দেখিনি। তাদের পবিত্র দেহ দেখেছি ত-বিত। তাদের মধ্যে তরুণী ও সুন্দরী মেয়েদের অধিকাংশের স্তন নেই এবং পাছা ও উরুর মাংস কেটে নেয়া। তাদের যোনিপথ পিছন দিকসহ আঘাতে বীভৎস হয়ে আছে। দুপুর প্রায় দু’টার সময় আমরা সেখান থেকে ট্রাক নিয়ে রমনা কালীবাড়িতে আসি। সেখানে দু’জনকে ট্রাকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমরা চারজন কালীবাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখি সবকিছু পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে। কালিবাড়ির ভিতরে ৪১টি পোড়া ও আধা পোড়া লাশ বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় দেখতে পাই। তাদের মধ্যে একজন মায়ের বুকের ভিতর জড়িয়ে রাখা একটি পোড়া শিশুর লাশ দেখলাম। আমরা ওই মা ও শিশুর পোড়া লাশসহ ৪১টি পোড়া লাশ ট্রাকে তুলেছি। কালিবাড়ির এসব লাশ আমরা ধলপুরের ময়লা ডিপোতে গর্তের মধ্যে ফেলেছি। মানুষের পচা চর্বির গন্ধে আমার পাকস্থলী বের হয়ে যাচ্ছিল। পরের দিন অসুস্থ হয়ে আমি আর লাশ তুলতে যাইনি, যেতেও পারিনি, সারাদিন ভাতও খেতে পারিনি। পাকিস্তানী পশু জানোয়ারদের উপর ঘৃণায় কোন কিছু স্পর্শ করতে পারিনি। বারবার সেই পোড়া মায়ের বুকে জড়িয়ে ধরে রাখা পোড়া শিশুর ছবি চোখের উপর উঠে আসে।
অসুস্থ হবার পরে কবে আবার কোন্ ডিউটিতে গেলেন জানতে চাইলে পরদেশী ডোম বলল, পরের দিন ২৯ মার্চ সকালে আবার পৌরসভা অফিসে ডিউটিতে গেলাম। আমাকে ট্রাক দিয়ে লাশ তোলার জন্য আরও কয়েকজন সুইপারের সঙ্গে যেতে বলা হল শাঁখারী বাজারে। জজ কোর্টের সামনে আগুনের শিখা তখনও দাউ দাউ করে জ্বলছিল। তার চারদিকে পাক সেনারা টহলে মোতায়েন ছিল। সে জন্য ট্রাক নিয়ে সে পথ দিয়ে শাঁখারী বাজারে যেতে পারিনি। পাটুয়াটুলী ঘুরে আমরা শাঁখারী বাজারের পশ্চিম দিক দিয়ে পাটুয়াটুলী পুলিশ ফাঁড়ি পার হয়ে শাঁখারী বাজারের ভিতরে যেতে পারি। সেখানে ট্রাক থেকে নেমে আমরা শাঁখারী বাজারের ঘরে ঘরে গেলাম। প্রতিটি ঘরে দেখলাম মানুষের লাশ। নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বালক-বালিকা, শিশু-কিশোরের গুলীবিদ্ধ বীভৎস পচা লাশ। মেয়েদের অধিকাংশ লাশ সম্পূর্ণ উলঙ্গ পড়ে আছে দেখলাম। অন্যান্য স্থানের মত এখানেও দেখলাম তাদের বুক থেকে স্তন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে তুলে নেয়া। আমরা উলঙ্গ সুন্দরী তরুণীদের পাছার ও উরুর মাংসও খাবলা খাবলা করে কেটে নেয়া অবস্থায় দেখলাম। ফুলের মত সুন্দরী কিশোরী ও তরুণীদের মুখ ও ঠোঁট পশুর মত দাঁত দিয়ে কামড়ানো দেখলাম। কারও কারও যোনিপথে লাঠি ঢুকানো দেখলাম। বহু পোড়া, ভস্ম লাশ সেখানে দেখলাম। বাইরে সড়কে পাঞ্জাবী সেনারা পাগলা কুকুরের মত লাফাতে লাফাতে গুলীবর্ষণ করছিল। বিহারীরা দলে দলে শাঁখারী বাজারের ঘরে ঘরে প্রবেশ করে মূল্যবান আসবাবপত্র, সোনাদানা লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল। অবিরাম গুলীবর্ষণের মুখে আমরা সকলে প্রাণের ভয়ে দুই ট্রাক লাশ তোলার পর লাশ তোলার জন্য সেদিন আর শাঁখারী বাজারে যেতে সাহস পাইনি।
আমি প্রশ্ন করলাম,“কতক্ষণ পরে গুলী বন্ধ হল এবং কখন আবার আপনারা লাশ তুলতে গেলেন?”
উত্তরে পরদেশী ডোম বলল, ৩০ মার্চ সকালে মিলব্যারাক থেকে লাশ তোলার জন্য যে দল সেখানে যায়, তাদের সঙ্গে আমাকেও লাশ তুলতে বলা হয়। মিলব্যারাক ঘাটে পৌরসভার ট্রাক নিয়ে গিয়ে আমরা দেখলাম নদীর ঘাটে অসংখ্য মানুষের লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বহু লাশ রশি দিয়ে বাঁধা দেখলাম। প্রতিটি রশির বাঁধন খুলে প্রতি দলে দশ/পনের জনের লাশ আমরা বের করলাম। লাশগুলো সব যুবক ও স্বাস্থ্যবান বালক ও তরুণদের ছিল। সেসব লাশ তোলার সময় আমরা অবাক হয়ে দেখলাম যে, প্রতিটি লাশের পিছন দিক দিয়ে শক্ত দড়ি দিয়ে হাত বাঁধা ও চোখ বাঁধা। এই লাশগুলোর চেহারা দেখে আমরা সবাই বুঝলাম এরা ঢাকা ইউনিভার্সিটি বা কলেজের ছাত্র। হল থেকে চোখ হাত-পা বেঁধে নদীর ঘাটে এনে গুলী করে পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছে পাক সেনারা। প্রতিটি লাশের মুখমন্ডল কালো দেখলাম। এসিডে জ্বালিয়ে বিকৃত ও বিকট করে দিয়েছে। লাশের সামনে গিয়ে ওষুধের অসহ্য গন্ধ পেলাম। লাশের কোন দলকে দেখলাম মেশিন গানের গুলীতে বুক ও পিঠ ঝাঁঝরা হয়ে আছে। কারো মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মগজ বের হয়ে আছে। কারও কাটা হৃদপিন্ড বের হয়ে আছে। নদীর পাড়ে ছয়জন যুবতীর ত-বিত, বীভৎস উলঙ্গ লাশ দেখলাম আমরা। তাদের পাঁচজনের স্তন কাটা। পাছার মাংস কাটা। চোখ বাঁধা, হাত ও পা শক্ত করে বাঁধা প্রতিটি লাশ গুলীর আঘাতে ঝাঁঝরা। তাদের মুখমন্ডল, বুক ও যোনিপথ ত-বিত ও বীভৎস দেখলাম। আমরা দুইবারে দুই ট্রাকে ৭০টি লাশ তুলে ধলপুর ময়লা ডিপোতে নিয়ে ফেলেছি। এরপর আমাদেরকে সদরঘাট, বাদামতলী ও শ্যামবাজার থেকে লাশ তুলতে বলা হয়। আমরা সেসব এলাকার নদীর ঘাট থেকে ষাটটি পচা লাশ তুলে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি।”
সরকারী পশু হাসপাতালের সুইপার পরদেশী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে লাশ তোলার বিষয়ে তার বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বললঃ “আমি যেদিন (সম্ভবতঃ ২৭ মার্চ) কালীবাড়ি থেকে লাশ তুলেছি, সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের পিছনের স্টাফ কোয়ার্টার থেকে এবং রোকেয়া হলের পশ্চিম দিকে জনৈক প্রফেসারের বাসা থেকে কয়েকটি লাশ তুলেছি। আমার মনে আছে যে, রোকেয়া হলের পিছনের স্টাফ কোয়ার্টারের ভিতর দিয়ে গিয়ে পুরুষ, নারী ও শিশুর মোট নয়টি লাশ তুলেছি। আর প্রফেসারের বাসা থেকে সিঁড়ির সামনে লেপের ভিতর পেঁচানো অবস্থায় এক প্রফেসারের দুই হাত কব্জি থেকে কাটা লাশ আমি তুলে নিয়ে গেছি।”
“লাশটি কোন্ প্রফেসারের ছিল? তার নাম জান কি না? এবং তার লাশ কোথায় নিয়ে যাও”- এ প্রশ্ন করলে সুইপার পরদেশী ভয়ে ভয়ে বলে যে, “তার নাম জানবার চেষ্টা করলে আমাদের সুপারভাইজার আমাকে ‘হারামী, তেরা বাপ লাগতা হ্যায়’ বলে গালি দেয়। আমি মাথা নীচু করে ভগবানের নামে বলি যে, ‘সারে প্রফেসার লোগোনে সারা জাহান কি বাপ লাগে, অউর তু কৌন!”
আমি তাকে শেষ প্রশ্ন করি, “সেই প্রফেসারের লাশ কোথায় নিয়ে গেলে?”
পরদেশীঃ “তার ছাত্রদের লাশ যেখানে ফেলি, তাকেও সেখানে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। ছাত্র-প্রফেসার এক সঙ্গে আছে। অন্য কোথাও লাশ নিয়ে যাবার তাকদ আমার ছিল না, স্যার।” (আমাকে দেয়া তার এই সাাতকার ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ’ অষ্টম খণ্ডে সরকারী দলিলেও পৃথকভাবে প্রকাশিত হয়েছে।)
মুসা সাদিক : স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট এবং সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার
Email: infomusabd@gmail.com, Web: www.musabd.com