সুনন্দা সিকদার
আমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গায়ে থাকি। জলে জঙ্গলে ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রাম। আমার বয়স তখন ৪/৫ বছর। আমার বোধ জেগে উঠছে একটু একটু করে। আমার চেতনায় তখন দুটি মাত্র দেশ, হিন্দুস্থান আর পাকিস্তান। ভারত বলে কোনও দেশের নাম জানি না। আমাকে আমার পালিকা মা (পিসিমা) তখন থেকেই বোঝাতে শুরু করেছে, যে গাঁয়ে আমার বাড়ি, যে গাঁয়ের মানুষ আমাকে আদরে ভালবাসায় ঘিরে রেখেছে, তাদের ছেড়ে আমায় যেতে হবে দূরের দেশ হিন্দুস্তানে। ‘ছেড়ে যেতে হবে’— এই কথাটির জন্য ওই বয়স থেকেই প্রতিটি আনন্দের ঘটনার সঙ্গে মিশে ছিল বিষাদ। ঈদের উপহার আসত সাদি কাকা, ইয়েদালি কাকার বাড়ি থেকে। ছোট্ট শাড়ি, কাঁচা মাছ-মাংস-দুধ সিমুই-পাটালি গুড়। তাদের রান্না খেলে জাত যাবে, তাই মাছ মাংস দুধ কাঁচা। অত্যন্ত ভালবাসার উপহার। কিন্তু উপহারের সব আনন্দ ম্লান করে দিত ভবিষ্যতের বিচ্ছেদ বেদনা। বুঝতে পারছিলাম, যে উপহার আজ পাচ্ছি ভবিষ্যতে আর পাবো না। তার থেকেও মারাত্মক কথা হল, দেখতে পাবো না কাকাদের-কাকিমাদের-সোবহানদা-খালেকদা, রাধিয়াদি, কালানি, আচিয়া-মঞ্জুদের। সবাই এখানে পড়ে থাকবে, আমি যাব কোনও এক দূরের দেশে। চরম এক শূন্যতার বোধ ওই বয়স থেকেই আমাকে কুরে কুরে খেয়েছে।
বয়স বাড়তে বাড়তে আস্তে আস্তে পাঁচ থেকে ছয়, ছয় থেকে সাতে, আটে পৌঁছচ্ছি আমি। মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। কেন যেতে হবে? এই তো আমার নিজের গাঁ, এখানেই আমার বাড়ি আর ভালবাসার মানুষগুলো। কেন এ সব ছেড়ে যাব হিন্দুস্তান? সে দেশ কেন আমার হবে? সে তো এক অজানা জায়গা। পালিকা মা আমায় বোঝাতে চেষ্টা করে আস্তে আস্তে। ‘দয়া, এ দেশ এক দিন আমাগো আছিল। এখন আর এ দেশ আমাগো নাই। নেহরু-জিন্না মিলা ঠিক করছে, হিন্দুগো দেশ হইলো হিন্দুস্তান, পাকিস্তান কেবল মুসলমানের দেশ।’ একমাত্র ইয়েদালি কাকার কাছেই সব প্রশ্নের উত্তর আছে। কাকাকে জিগ্যেস করি, ‘কাকা, এই দেশ এই গাঁ আমার নয়?’ কাকা বলেন, দয়া, এ দেশ অবশ্যই তোমার। তবে তোমার জন্মদাত্রী মা-বাবা থাকেন ও দেশে। তাই এখনকার মতো তোমারে ও দেশে যাইতে হবে। লেখাপড়া শিখা স্বাধীন হইয়া দেশে ফিরে আসবা।’
মনটা তা সত্ত্বেও খুব খারাপ হল। ফিরে আসব আমার নিজের দেশে। কিন্তু মাঝখানে এতগুলো বছর থাকতে হবে হিন্দুস্তানে?
মাকে আর দাদাকে ছেড়ে থাকতে হবে না, এটা আমি ধরেই নিয়েছিলাম। মা কি আমাকে ও দেশে একা ছেড়ে আসবে? হতেই পারে না। আর দাদা? সে আমাকে না দেখে থাকবে কী করে? সে-ই তো আমায় কোলেপিঠে করে বড় করেছে। সে আমাদের চাষবাস আর গরু-বাছুর দেখে ঠিকই, কিন্তু ভাল করেই জানি তার মনোযোগের কেন্দ্রে আমি। সে যখন নামাজ পড়ে, পাশে বসে আল্লাহর সঙ্গে তার কথাবার্তা আমি সব শুনি। মা আমার সঙ্গে ছিল আমৃত্যু। দাদা পারেনি আসতে, তার জন্য কষ্ট পেয়েছি বারবার। তবে বড় হবার সঙ্গে এ কথা বুঝেছি, না এসে সে খুব বুদ্ধির কাজ করেছে। এখানে এলে সে আমার জন্মদাত্রী মায়ের সংসারে এক জন বাড়তি লোক হত। সে চাষের কাজ, গরু-বাছুরের দেখভাল ছাড়া আর কোনও কাজ জানে না। আমার জন্মদাত্রী মায়ের সংসার ভাড়া বাড়িতে। না আছে চাষের জমি, না আছে গরু-বাছুর। চাষবাসের কাজ ছাড়া সে এখানে বাঁচতে পারত না।
কিন্তু দূর থেকে সে কী ভাবে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছিল তা টের পেলাম তার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর। তার মৃত্যু সংবাদ আমাকে ঠেলে দিয়েছিল বিষাদের অন্ধকারে। অদ্ভুত এক নিরবলম্ব ভাব গ্রাস করেছিল আমাকে।
আমার পালিকা মা তার প্রখর ব্যক্তিত্বকে গুটিয়ে, নিজেকে প্রায় অস্তিত্বহীন করে কাটিয়ে দিয়েছিল ভ্রাতৃবধূর সংসারে জীবনের শেষ চব্বিশটি বছর, শুধু আমারই জন্য।
এ তো গেল আমার ব্যক্তিগত দুঃখের কথা। দেশভাগের ক্ষত অজস্র মানুষের মধ্যে এ ভাবেই জেগে আছে। কিন্তু আমাদের ওই অঞ্চলের গ্রামগুলো কী ভাবে আস্তে আস্তে সমস্ত গরিমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছিল তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই। আমি যে সব শিল্পকলার স্বাদ আমার শৈশবে পেয়েছিলাম, দীর্ঘ দিন পরে গিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে সে সবের চিহ্ন আর খুঁজে পাইনি। হারিয়ে গেছে জারি সারি গান, হারিয়ে গেছে বংশ নদীর বুকে নৌকা বাইচ। ঢুলি পাড়ার ঢাক-ঢোল-সানাই বাজনা, গল্প বলার সেই সমৃদ্ধ সুপ্রাচীন ঐতিহ্য,— সে সবের কথা জানেই না আজকের প্রজন্ম। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার আমার গাঁয়ে বাস করাকালীন ঠাকুমার ঝুলির বা অন্যান্য সমস্ত গল্প সংগ্রহ করেছিলেন ঢুলিপাড়া থেকে। সোনা ঢুলি ছিলেন আমাদের গাঁয়ের বিখ্যাত গল্প বলিয়ে। গল্পের ডালপালা বদলের সময় বাজত ঢাক-ঢোল-সানাই। গ্রামের বুড়ো মানুষরা আমার শৈশবে গর্ব করতেন সোনা ঢুলি ও দক্ষিণারঞ্জনকে নিয়ে। এখন তাঁদের নাম আর কেউ জানে না এই অঞ্চলে।
হারিয়ে গেছে উৎকৃষ্ট মানের বাঁশের কাজ, শিকে, কাঁথা। প্রয়োজনের খাতিরে বাঁশের ঝুড়ি, বেতের ধামা কুলো আর সাধারণ কাঁথা তৈরি হয়। বাঁশের এক রকম অতি সূক্ষ্ম পর্দা হত, তা আর দেখতে পেলাম না।
গ্রামে কিছু দিন থাকার পর ১০-১২ টা গাঁ ঘুরতে ঘুরতে আস্তে আস্তে এই সব শিল্পকলা হারিয়ে যাওয়ার কারণ খানিকটা বুঝতে পারলাম আমি। আমাদের গায়ে বছর পঞ্চাশেক আগে প্রায় সব জিনিসেরই বিনিময় মূল্য ছিল ধান। শিল্পীরাও তাঁদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ধানই পেতেন। বেশ কয়েক ঘর জমির মালিক থাকত প্রত্যেক গ্রামেই। এ ছাড়া জমিদাররা তো ছিলেনই। বেশি জমির মালিক ছিলেন হিন্দুরাই। তাঁদের ক্ষমতা ছিল ধান দিয়ে এই শিল্পগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার। হিন্দুরা চলে আসার পরে মুসলমানরা জমির মালিক হলেন ঠিকই, কিন্তু কেউই হিন্দু ভূস্বামীদের মতো অত পরিমাণ জমির মালিক হতে পারলেন না। এক জন হিন্দুর জমি কিনলেন পাঁচ-ছ’টি মুসলমান পরিবার। আমাদের জমিই তো অনেকে মিলে কিনেছিলেন। সে জন্য কারও সে রকম উদ্বৃত্ত ধান ফলত না। ধান যা চাষ হত, পরিবার প্রতিপালনের পরে আর তা দিয়ে শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করা সম্ভব হল না। এই পরিবর্তন শিল্পীদের জীবনে এসেছিল এক-দু’বছরে নয়, খুব ধীরে ধীরে। ঢুলিপাড়ার বৃদ্ধ দু’-এক জন মানুষ আমাকে বললেন, ‘‘দয়া, ঢাকঢোল বাজাবো কেমনে? হিন্দুরা চইলা গেল, আমাগো কামও গেল। পূজাআচ্চা নাই, বাজনদারের ডাকে কেডা?’’ সেটা ঠিক বিভিন্ন পুজোয় ঢাক ঢোলের ডাক পড়ত। ঈদ, মহরম কিংবা শবেবরাতে কোনও রকম বাজনাবাদ্যির চল ছিল বলে আমার মনে পড়ে না। জারি শাড়ি গান, বাঁশের কাজ, কাঁথা-শিকে— এ সব কোথায় গেল খোঁজ করতে গিয়ে একই উত্তর পেলাম, ‘বাবুরা চইলা গেল, ধান দিব কেডা? ধান না পাইলে পেট তো চলে না।’
এ ভাবেই গ্রামের শিল্পকলা হারিয়ে গেল, ভাঙন ধরল সেখানকার অর্থনীতিতেও। যাঁরা গ্রাম ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে এলেন, তাঁদের পায়ের তলায় মাটি পেতেও সময় লাগল। দীর্ঘ দিন এক অন্ধকার ঘূর্ণিপাকের মধ্যেই ডুবে রইল। এখন সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এলেও বাঙালি জীবনের সেই ক্ষত তো ভোলবার নয়। সেই স্মৃতি থেকে আমাদের মুক্তি কোথায়?
এক শীতের সকালে গাঁ ছেড়েছিলাম। আটচল্লিশ বছর বাদে আবার এক শীতের সকালে গাঁয়ে পৌঁছলাম। পরিচয় দিলাম, আমি বনভুঁইয়াঁর মেয়ে দয়া। সারা গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ল খবর, ‘দয়া ফিরে আইছে।’ আমাকে ছোট দেখেছেন এমন বৃদ্ধ বেশ কয়েক জন বেঁচে আছেন। আমার সমবয়সী বন্ধুরা আছে, আমার থেকে ছোটরা তো আছেই। নতুন প্রজন্ম যারা আমাকে দেখেনি তারাও আমার নাম জানে। টানাটানি শুরু হল, সবাই আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চায়।
কিন্তু আমি চাই, যে দাদা আমায় মানুষ করেছে, কাঁধে করে বংশ নদীর পাশে পাশে ঘুরেছে, গাছ-লতা-পাতা-ফুল-ফল চিনতে শিখিয়েছে, নামাজের পাশে বসিয়ে রেখেছে, তার বাড়ি যেতে। তার বাড়ি খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম আমি। আমার ভাবী দাদার পৈতৃক ভিটে ছেড়ে পাশের গাঁয়ে চলে গেছে। খুঁজে খুঁজে তার বাড়ি গেলাম। সে আমাকে দেখে বলল, ‘সেই আইলা, সে বাইচ্যা থাকতে আইলা না ক্যান? তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো। খবর পাঠাতে দাদার দুই ছেলে কাজ ফেলে চলে এল, নাজিম আর রশিদ। বড় মেয়ে রাসুর বিয়ে হয়েছে পাশের গাঁয়ে। সে খবর পেয়ে চলে এল। ছোট মেয়ে জুলেখা থাকে ঢাকায়। সে সমানে ফোন করতে লাগল, ‘ফুফি, দেখা হইব ক্যামনে তোমার লগে?’ আমি বললাম, ‘চিন্তা কী? আমি ঢাকায় যাব, তখন দেখা হবে।’ দিঘপাইতের লাগোয়া কলাবাঁধা গ্রামে বাড়ি করেছে ভাবী। আমার পরিচয়টা এ গ্রামের মানুষের কাছে একটু অন্য রকম হল। সকলে বলতে লাগলো, ‘কলকাতা থিক্যা বহু টেকা খরচ কইরা মাজম শেখের ধর্মবোন আইছে। আর সে হইল গিয়া, দিঘপাইত গাঁওয়ের বন ভুঁইয়ার মাইয়্যা দয়া, পোলাপান বেলায় এখানেই আছিল।’
তবে যতই আমি মাজম শেখের ধর্মবোন হই না কেন, আমাকে সকলেই বলে দিল, দিঘপাইত গাঁওয়ের সকল বাড়িই আমার বাড়ি। সব জায়গাতেই আমাকে খেতে হবে কিছু না কিছু। চা মুড়ি বিস্কুট খাইয়ে তৃপ্তি নেই সকলের। খেতে হবে ভাত, শাক ভাজা, আলুর ভর্তা, চুনো মাছ ইত্যাদি। যতটা সম্ভব হল তাদের নিমন্ত্রণ রক্ষা করলাম। আর আমার সঙ্গে আমার ভাবীও নিমন্ত্রিত হল সব জায়গায়। খুব ভাল লাগল দেখে যে জাতপাতের সেই বেড়াজাল থেকে এখন মুক্ত হয়েছে হিন্দুরা। জিজ্ঞেস না করে পারলাম না কী করে জাতপাতের কুসংস্কার দূর হল তাঁদের মধ্য থেকে?
উত্তর পেলাম, দীর্ঘ উত্তর। সে যেন এক গল্প। একাত্তরের নভেম্বর থেকে খান সেনারা মরণ কামড় দিতে শুরু করে। গ্রামে গ্রামে ঢুকে তারা ধর্ষণ, লুঠ ইত্যাদি নানা রকম অত্যাচার শুরু করে, দিঘপাইত গাঁয়ের মানুষ খানসেনা আসছে খবর পেয়ে বংশ নদীর অন্য পাড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। মৃত্যু যখন শিয়রে তখনও হিন্দুরা চিঁড়েমুড়ি বেঁধে নিয়ে মুসলমানদের থেকে সামান্য দূরে আশ্রয় নেয়। যত দিন একটু আধটু খাবার জুটেছে তত দিন হিন্দুরা বজায় রেখেছিল জাতপাতের কুপ্রথা। কিন্তু একসময় যখন খাবারদাবার একদম ফুরিয়ে গেল, সন্তানদের অভুক্ত রাখতে বাধ্য হচ্ছিলেন মায়েরা, তখন অতি দ্রুতই জাতপাত উঠে গেল। যে যার খাবার জোগাড় করতে পারছিল, তা আগে দেওয়া হয়েছিল বাচ্চাদের মুখে। তমিজ কিংবা জামালের মা খাওয়াচ্ছিলেন, কানু-মঞ্জু-লক্ষ্মণদের। আবার কানু-মঞ্জুদের মা যা খাবার জোগাড় করতে পেরেছেন নিজের ছেলেমেয়েদের পাশে বসিয়ে খাইয়েছেন মুসলমান শিশুদেরও। কোনও ভাল খাবার তো নয়, বুনো ফল-মেটে আলু-শাক সেদ্ধ-কচু সেদ্ধ নুন মেখে খাওয়া। চরম দুঃখের দিনে একসঙ্গে থাকতে থাকতে জাতপাতের বিসর্জন হয়েছিল।
বংশ নদীর ওপারে সোনটিয়া গ্রাম। ওই গ্রামের দুই দাদা এখন কলকাতাবাসী। তাদের উদ্যোগেই আমার এত বছর বাদে গ্রামে আসা সম্ভব হয়। ওদের বোন পরিচয়ে সোনটিয়াতেও অনেক নিমন্ত্রণ খেয়েছি। দাদারা ঠিক করলেন, আমরাও একদিন গাঁয়ের সব মানুষকে খাওয়াবো। দাদাদের ইচ্ছে মাংস-ভাত খাওয়ানোর। গ্রামের মাস্টার সাহেব রেহানভাই মাংস-ভাতের প্রস্তাব উড়িয়ে দিলেন। তিনি দাদাদের বললেন, ‘কর্তা, একখান কীর্তন দ্যান। কীর্তনের শেষে খিচুড়ি-লাবড়া আর পায়েস খামু। কাউরে আর দাওয়াত দিবার লাগব না, দশ গাঁয়ের মানুষ ছুইট্টা আইব।’
কীর্তনের প্রস্তাবে মানুষের খুব উৎসাহ। স্কুলশিক্ষিকা দীপ্তি ধরের বাড়ির উঠোনে খিচুড়ি-লাবড়া রান্নার ব্যবস্থা হচ্ছে।
সামনের মাঠে কীর্তনের আয়োজন সন্ধের মধ্যে সম্পূর্ণ হল। কীর্তনীয়ারা এসে গেলেন। এঁরা সকলেই বৈষ্ণব। নাম সব শ্রীকৃষ্ণের নামে। জগদীশ হরি মধুসূদন ইত্যাদি। শামিয়ানার ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়াল দলটি। চারিদিক ঘুরে ঘুরে সবাইকে নমস্কার করলেন। জনা পাঁচেক মানুষ নিয়ে এঁদের দল। এঁদের মধ্যে আছেন বাজনদারেরাও। খোল খঞ্জনি কাঁসর প্রধান বাজনা। আমরা যেহেতু গ্রামের অতিথি, অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে আমাদের অনুমতি নিলেন। চারিদিক হিন্দু-মুসলমান দর্শকে ভর্তি। দর্শক বলছি এ জন্য যে এ কীর্তন শুধু শোনার নয়, দেখারও। প্রধান কীর্তনীয়ার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। শরীরটি রেখেছেন ছিপছিপে। ক্লান্ত হন না তিনি দীর্ঘ সময় নেচেও। নাচ-গান যখন ঢিমে লয় থেকে দ্রুত লয়ে উঠছে, ভারী উপভোগ্য হচ্ছে। ঘণ্টা চারেক প্রায় আসর জমিয়ে রাখলেন তাঁরা, কোথা দিয়ে সময় গেল বুঝতে পারলাম না।
কীর্তনীয়াদের দলের মধ্যে প্রথম থেকেই একটি বছর পঁয়তাল্লিশের মানুষ বসেছিলেন হাতে একতারা নিয়ে। প্রধান কীর্তনীয়া তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাদের সঙ্গে। ‘এই হইল আমাগো গাঁয়ের পোলা বেলাল হুসেন। এই পোলা অত্যন্ত গুণী, নিজেই গান বান্ধে, সুর দেয়, নিজেই গায়। এর গান এখন আপনেরা শুনেন। মন ভিজ্যা যাইব গিয়া।’
বেলাল হুসেন সবাইকে সেলাম জানিয়ে বললেন, ‘আমি গান বান্ধি, কিন্তু কবি না, সুর দিয়া গাই, কিন্তু গায়কও না। আমি হইলাম গিয়া লালন সাঁইয়ের এক জন ভক্ত।’
প্রথমে তিনি সবার অনুমতি নিয়ে লালনের গান গাইলেন। তার পরে গাইলেন নিজের লেখা গান। গানের বিষয় মানবপ্রেম। মিষ্টি সুরেলা কন্ঠে তাঁর গাওয়া গান আমরা শুনলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। তাঁর গানের ক’টি কথা নীচে তুলে দিচ্ছি।
‘মানুষ ছাইড়া খোদা খুঁজ, এ মন্ত্রণা কে দিয়াছে,/মানুষের ভিতরে খোদা কোরানে তার প্রমাণ আছে। আল্লা হরি আর ভগবান মানুষের মধ্যে বিরাজে।। বেলাল কয়, মানুষ হইল অরূপরতন,/ তারে আগে কর যতন-/মানুষেরে করলে হিংসা হইবে তোমার পতন।।’ বেলাল কয়,ভাল বাস, বাস রে ভাল-/জগৎ হইবে আলো,/বেলাল কয় ভালবাসো, বাসো রে ভাল।।’
বেলাল পড়াশোনার সুযোগ পাননি। পৃথিবীর কোনও খবর তাঁর কাছে পৌঁছয় না। শৈশবের মুক্তিযুদ্ধের কথা আবছা মনে পড়ে। মানুষকে মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে বাঁচতে হয়েছিল, এটা তাঁর কাছে খুব দুঃখের স্মৃতি। মানুষ কেন ভয় পাবে মানুষকে? মানুষে মানুষে কীসের হানাহানি? তিনি এমন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন, যখন মানুষ মানুষকে শুধুই ভালবাসবে।
বেলালের গানের পরেই একসঙ্গে খেতে বসা হল। তখন মধ্যরাত। হিন্দু-মুসলমান শূদ্র-কায়স্থ সব একসঙ্গে বসেই খাচ্ছিলাম। খেতে খেতে মনে হচ্ছিল এই ভাবে একসঙ্গে বসে খাওয়ার প্রথা যদি আগে থাকত, তা হলে কি দেশভাগ হত? দাঙ্গা হত? বোধহয় না!