সুমন গুণ
কোনও লেখার ভাষাশিল্প নিয়ে দু’ভাবে কথা বলা যায়। একটা হল সেই ভাষার যে-চোখে-দেখা অংশ, যেমন ছন্দ-অলঙ্কার ইত্যাদি, শুধু তার ওপরে আলো ফেলা। আর কখনও সেই ছন্দ-অলঙ্কার ইত্যাদি ছুঁয়েই ভাষার ওপারে যে-ভাষা, তার কথা, আকাশের ওপারে সেই আকাশের কথাও বলা যেতে পারে। আমি আপাতত সেই অতিরিক্ত আকাশের দিকেই হাত বাড়াতে চেষ্টা করব।
পাখা হলে পাখি হয় ব্যাকরণ বিশেষে—
কাঁকড়ার দাঁড়া আছে, দাঁড়ি নয় কিসে সে?
এই কথাটুকুর মধ্যে একটা তাত্ত্বিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা আছে। সুকুমার রায়ের শিল্পের যে-দর্শন, তা এই কথায় অভ্যন্তরীণ যুক্তিসহ ধরা পড়েছে। ব্যাকরণের নিয়ম মেনেই, তার মধ্যে যে-বিভ্রাট, তাকে সমর্থন জানানো হচ্ছে এখানে। আর এই বিভ্রাট, এই অসঙ্গতি দেখানোর শিল্পের চর্চাই তো করেছেন সুকুমার রায়। কিন্তু বলার কথা হল, সেই উদ্দেশ্যপূর্ণ বিভ্রান্তিকে যতই অসম্ভব মনে হোক, কখনোই কিন্তু পড়তে অস্বস্তি হয়না আমাদের। এটা সুকুমার রায়-এর বহুতল ভাষাশিল্পের দাপটের জন্যই সম্ভব হয়েছে। হাঁসজারু বা বকচ্ছপ তো আমাদের সংস্কৃতির দুটি স্বাভাবিক কুশীলব হিসেবেই এখন গ্রাহ্য হয়ে গেছে। আর টকটক গন্ধ তো আমরা পড়ি এই সময়ের কবিতা পড়ার মন নিয়েই, বরং এটা ভেবেই ঈষৎ বিস্মিত হয় যে, আমাদের ভাষার আধুনিক স্থাপত্যগুলি নির্মিত হবার আগেই সুকুমার রায়ের প্রতিভা নতুন সময়ের নকশা বানিয়ে নিয়েছিল।
হাঁড়ি নিয়ে দাড়িমুখো কে যেন কে বৃদ্ধ
রোদে বসে চেটে খায় ভিজে কাঠ সিদ্ধ।
খাদ্যটি রসনার পক্ষে কতটা উপাদেয় সেটা ভাবার আগেই ধ্বনির রহস্যময় মজা আমাদের টেনে নেয়, এবং তার-ই মোহে তারপর ভিজে কাঠ সেদ্ধ চেটে খাবার ছবিটির পুলক আরও পেয়ে বসে। এভাবে ধ্বনির আলো দেখিয়ে অসম্ভব গন্তব্যের দিকে আমাদের তাকাতে বাধ্য করেন তিনি।
পূবদিকে মাঝরাতে ছোপ দিয়ে রাঙা
রাতকানা চাঁদ ওঠে আধখানা ভাঙা
এই ছবিটির মধ্যে যে-অতিরিক্ত অর্থময়তা আছে সেটাই সুকুমার রায়কে সাধারণ ছড়াকারের থেকে সবদিক থেকে আলাদা করে রাখে। প্রত্যেকটি শব্দ যেন একটি গোটা ছবির একেকটি টান। খেয়াল করে দেখুন, প্রতিটি শব্দই কিন্তু কোনও-না-কোনও ভাবে একটি করে দৃশ্যের জন্ম দিচ্ছে। একটি করুণ অথচ জটিল, আচ্ছন্ন কিন্তু প্রত্যক্ষ সম্ভাবনা আমরা টের পাচ্ছি বলেই এই সময়ের কবিতা পড়ার মন নিয়েই পড়তে পারছি আমরা কথাটি।
রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা আমি নানা লেখায় ব্যবহার করার লোভ সামলাতে পারিনি:
তব অঙ্গে অত্যুক্তি কি করনা বহন
সন্ধ্যায় যখন
দেখা দিতে আসো
তখন যে হাসি হাসো
সে তো নহে মিতব্যয়ী প্রত্যহের মতো
অতিরিক্ত মধু কিছু তার মধ্যে থাকে তো সংহত
কথা হচ্ছে, এই যে অতিরিক্ত মধু, যা রচনার অনির্বচনীয়তাকে রক্ষা করে, তা কি সব বয়সের পাঠকের কাছেই সমানভাবে গ্রাহ্য হতে পারে? তা হয়তো নয়। চ্যাপলিনের ছবির ভাঁজে ভাঁজে যে বিভিন্ন বুনন, তার সবকিছুই কি শিশু-কিশোরের মন নিয়ে সবসময় ছোঁয়া যায়? একটি কাজ নানারকম স্তর নিয়ে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে, এই হয়ে-ওঠাটাই তার লক্ষ্য, এই লক্ষ্যের কতটা কাছে অথবা দূরে রইল লেখাটি, তা-ই তার সামর্থ্য চিহ্নিত করে দেয়।
এইরকম অজস্র স্বয়ম্ভর ছবিতে ভর্তি সুকুমার রায়ের কবিতা। কয়েকটি আমাদের অনেকেরই মুখস্থ:
সোয়াস্তি নেই মনে মেঘের কোণে কোণে
হাসির বাষ্প উঠছে ফেঁপে
কান পেতে তাই শোনে
হাসির বাষ্প মেঘ হয়ে ফেঁপে উঠছে, এই কথাটির মধ্যে একটি অস্পষ্ট স্বাভাবিকতার অংকও কিন্তু মিলে যাচ্ছে, তাই ছবির ডানা মেলে দিয়ে ভেসে যেতে এক মুহূর্তও লাগছে না লেখাটির।
এভাবেই হালকা মেঘের পানসে ছায়ার বলতে পারেন সুকুমার রায়, বলতে পারেন:
চাঁদের আলোয় পেঁপের ছায়া ধরতে যদি পারো
শুঁকলে পরে সর্দিকাশি থাকবে না আর কারো
অধরা বলেই ওই দুরভিসন্ধিমূলক ছায়াটির জন্য আমাদের রোমাঞ্চ হয়।
কিংবা:
… এই মনে কর রোদ পড়েছে ঘাসেতে
এই মনে কর চাঁদের আলো পড়ল তারই পাশেতে
সহজ মনে হলেও দুটি ছবিকে পাশাপাশি এমন অসম্ভবভাবে মিশিয়ে দেওয়ার কাজটি যে মোটেই সহজ নয়, সেটা যাঁরা এই কাজের সঙ্গে বেদনাদায়কভাবে যুক্ত, তাঁরা ভালোই জানেন।
সুকুমার রায়ের সামর্থ্য এখানেই যে তিনি এই দুস্তর কাজটি এমনভাবে সম্পন্ন করেছেন যে পাঠকের কাছে এর নেপথ্য পরম্পরাটি উহ্য থেকে যায়। এটা তিনি পেরেছেন কবিতার ভাষাশিল্পের ওপর তাঁর স্বাভাবিক দখল ছিল বলেই। মিল-অনুপ্রাস নিয়ে অভাবনীয় সব নিরীক্ষা করেছেন তিনি, শব্দকে দিয়ে সবরকম কাজ করিয়ে নিয়েছেন।কতরকমের মিল আমরা পড়েছি তাঁর লেখায়, একটু মনে করা যাক :
‘এ গোঁফ যদি আমার বলিস করব তোদের জবাই’–
এই না ব’লে জরিমানা কল্লেন তিনি সবায়
কিংবা:
হাসছি মোরা হাসছি দেখ, হাসছি মোরা আহ্লাদি
তিনজনেতে জটলা করে ফোকলা হাসির পাল্লা দি
অনুপ্রাসের খেলায় সুকুমার রায় যে-দাপট দেখিয়েছেন, বাংলা কবিতায় তার কোনো জুড়ি নেই। বলার কথা হল, শুধু অনুপ্রাসের জন্যই অনুপ্রাস দেবার একমাত্রিক কৌশলে বিশ্বাস ছিল না তাঁর। গোপনতম হলেও একটা অর্থময় যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতেন তিনি। ‘শশ্মানঘাটে শষ্পানি খায় শশব্যস্ত শশধর’ জাতীয় কালোয়াতি খুব বেশি পাওয়া যাবে না তাঁর লেখায়।
একদিন এনে তারে এইখানে ভুলিয়ে
গেঁটেবাত ঘেঁটে-ঘুটে সব দেব ঘুলিয়ে
কিংবা:
ভর দিতে ভয় হয় ঘর বুঝি পড়ে
খক্ খক কাশি দিলে ঠকঠক নড়ে
—
মেরামত দিনরাত কেরামত ভারি
থুরথুরে বুড়ি তার ঝুরঝুরে বাড়ি
ভাল করলে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে অনুপ্রাসের ঘনঘটা কিন্তু বলার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না, তার একটা ইশারা থেকে যাচ্ছে।খক্ খক কাশির সঙ্গে ঠকঠক করে বাড়ি নড়ার শব্দের কোনও অসঙ্গতি নেই। আবার, বুড়ি যদি থুরথুরে হয়, তবে তার বাড়ি তো ঝুরঝুরে হতেই পারে।
বৈঠকী একটা চাল বজায় রাখতে অনেক সময় তাঁর বিশিষ্ট ধরনকে ব্যবহার করেছেন সুকুমার রায় । যেমন:
ঢের হয়েছে! আয় দেখি তুই বোস তো দেখি এদিকে
ওরে গোপাল গোটাকয়েক পান দিতে বল খেঁদিকে
মজা করে হাসানোর লক্ষ্য তো ছিলোই তাঁর। কিন্তু যে-সংযত বৈচিত্র্যের মাত্রা ছড়িয়ে আছে তাঁর কবিতায়, তা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। কাতুকুতু বুড়ো আর রামগড়ুরের ছানা লেখা দুটি পাশাপাশি পড়লে হাসি নিয়ে সুকুমার রায়ের ভাবনার স্বাচ্ছন্দ্য বোঝা যায়। কাতুকুতু বুড়োর স্বভাব এইরকম:
তোমায় দিয়ে সুড়সুড়ি সে আপনি লুটোপুটি,
যতক্ষণ না হাসবে তোমার কিচ্ছুতে নাই ছুটি
আর
রামগরুড়ের বাসা ধমক দিয়ে ঠাসা,
হাসির হাওয়া বন্ধ সেথায়
নিষেধ সেথায় হাসা
কল্পনার এক মেধাবী সচ্ছলতা সুকুমার রায়ের লেখাগুলিকে এমন বহুমাত্রিক করে তুলতে পেরেছে।
সুকুমার রায়ের কবিতায় ফুল ফোটে ঠাস ঠাস, দ্রুম দ্রাম করে, এবং সে-ফুলের গন্ধ শাই শাই ছুটে যায়। হিম পড়ে হুড়মুড় ধুপধাপ করে। চাঁদ ডোবে গব গব গবা-স।কখনো
ঢপঢপ ঢাক ঢোল ভপভপ বাঁশি
ঝনঝন করতাল ঠনঠন কাঁসি
কেন ভপভপ? এই প্রশ্ন আর তার উত্তরের অসম্ভব সম্ভাবনার মধ্যেই সুকুমার রায়ের কবিতার সাফল্য ধরা আছে। তিনি তো
তেজপাতে তেল কেন? ঝাল কেন লঙ্কায়?
নাক কেন ডাকে আর পিলে কেন চমকায়?
—এই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য কবিতা লেখেননি। তিনি এক সম্ভাবনাকে উসকে দেবার জন্য লিখেছেন, আর, আমরা সেই প্ররোচনা সরবে গ্রহণ করেছি।
এই গ্রহণ করার রসায়নটি বেশ জটিল আর মজার। বুদ্ধদেব বসু মধুসূদন সম্পর্কে লেখার শিরোনাম দেন ‘মাইকেল’, এবং বলেন: ‘মাইকেলি ছন্দের প্রধান দোষ এই যে সেটা আগাগোড়াই অত্যন্ত বেশি কড়া, তাতে নিচুগলা কখনো শুনি না, নরম সুর কখনো বাজে না, সেটা কোনোখানেই গান নয়, সমস্তটাই বক্তৃতা’। ‘কখনো’, ‘সমস্তটাই’, ‘আগাগোড়াই’ শব্দগুলির মোহে পড়ে বুদ্ধদেব একটানে যা বলে গেলেন, তাতে এক স্বাদু সরলীকরণ হল, পড়লেই আমরা বুঝতে পারি লেখক এটা বললেন বটে, কিন্তু এটাই তাঁর চূড়ান্ত কথা বললে আমাদের না ভাবলেও চলবে।
আমরা, মানে বাঙালি পাঠকেরা তাই সুকান্তর মতোই, মধুসূদন সম্পর্কেও বুদ্ধদেবের কথা নিঃশব্দে অগ্রাহ্য করেছি। বাংলা কবিতার শুরু, উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে যে মধুসূদন থেকেই, একথা আজ জোর করে কাউকে বুঝিয়ে দিতে হয় না। আর যেটা বুদ্ধদেব ‘দোষ’ বলছেন মেঘনাদবধ-এর, সেখানেই যে তার শক্তি, একথাও বলছেন এখন অনেকেই।
এই লেখার শুরুর উদ্ধৃতিটিতে ব্যাকরণ মেনেই ব্যাকরণবিভ্রাটকে সমর্থন জানিয়েছিলেন সুকুমার রায়। এবার যে-দুটি লাইন তুলছি তাঁর, সেখানে তিনি পরিষ্কার বলছেন:
হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না),
হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না
ব্যাকরণ শুধু সুকুমার রায় নন, আমরাও মেনে চলার একগুঁয়েমি দেখাইনি বলেই হাঁসজারু, হাতিমি, বকচ্ছপেরা আমাদের সংস্কৃতির অভিধানে অবধারিতভাবে থেকে গেছে আর তাদের স্রষ্টা হিসেবে সুকুমার রায় শিরোধার্য হয়ে আছেন।