জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
গোলাম কিবরিয়া পিনু
আজ কবি বেলাল চৌধুরীর জন্মদিন। তাঁর জন্ম ১৯৩৮ সালে ১২ নভেম্বর, ফেনীতে। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও তিনি প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সম্পাদক হিসেবেও ছিলেন বিশিষ্ট।
২৪শে এপ্রিল ২০১৮ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর এক হাসপাতালের তিনি মারা যান। তিনি আমাদের অনেকের কাছে ছিলেন প্রিয়জন–বিভিন্ন পরিধিতে ও পরিচিতিতে। আজ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু বাক্য গঠন করছি সীমাবব্ধ পরিসরে মাত্র!
৮০ বছর বয়সী আমাদের প্রিয় বেলাল চৌধুরী অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ধারাবাহিকভাবে কবিতাসহ বিভিন্ন লেখা নিরলসভাবে লিখেছেন। কলমকে হাত থেকে নামিয়ে রাখেননি–দূরবর্তী কোথাও। যদিও তাঁর ইমেজে বোহেমিয়ান ও আড্ডাবাজের প্রবল ছাপ রয়েছে কিন্তু সেই ছাপ ছাপিয়ে তাঁর সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের পরিধি কম বিস্তৃত নয়, বরং উল্লেখযোগ্যভাবে সংহত ও উজ্জ্বল; তাঁর বিভিন্নমুখী লেখার স্পর্ধার পরিণত দিগন্ত সেই প্রতিভাসে দেদীপ্যমান। তাঁরই কবিতার পংক্তির কাছে আমাদের যেতে হয়–‘ফেরারী আমি অনেক স্বপ্ন ও নষ্ট স্মৃতির জটিল করিডর পার হয়ে এখন কেবল একফালি সরু বারান্দায়’। আসলে কবিকেও জীবনের করিডর পার হয়ে যেন মৃত্যুর পর এক সরু বারান্দায় অবশেষে উপস্থিত হতে হয়। কবি বেলাল চৌধুরী, আমাদের বেলাল ভাই ‘আত্মপ্রতিকৃতি, স্থিরজীবন ও নিসর্গচিত্র’ নামক এই কবিতায় উল্লিখিত কথা তেমনভাবে বলেছেন।
কবিতা লিখতেন বলেই তাঁর সাথে আমাদের অনেকের পরিচয়। আমরা যারা কবিতা লেখার কারণে বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি, তারা তো জানি তিনি আপন করে নেওয়ার জন্য উন্মুখ থাকতেন–আন্তরিকতায় ও ভালোবাসায়; বিশেষ করে তাঁর বয়সের তুলনায় আমরা যারা দূরবর্তী ছিলাম বা ছিলাম কম বয়সী, তারা তো তাঁর স্নেহে ও আগ্রহে কবিতা লেখা ও প্রকাশে বহুভাবে সহযোগিতা পেয়েছি, তা এই সময়ে কৃতজ্ঞতার সাথে না বললে অশোভন হয়ে দাঁড়ায়। আর কবিতা বিষয়ক সাংগঠনিক ভূমিকায় তাঁর কাছাকাছি থেকে তাঁর সান্নিধ্যে আমরা যারা বেশ সময় ব্যয় করেছি এই এক জীবনে–তা তো আর এক দিগন্তপ্রসারী উজ্জ্বলতা নিয়ে আছে। কবি বেলাল চৌধুরী, লেখক বেলাল চৌধুরী, সম্পাদক বেলাল চৌধুরী, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি বেলাল চৌধুরী ও সর্বোপরি মানুষ বেলাল চৌধুরীর কথা আমরা অনেকে বিভিন্নভাবেই বিভিন্ন দিক থেকেই বিভিন্নভাবে উপলব্ধি করি। বেলাল ভাই আমাদের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জানবেন।
কবিতা, গদ্য, অনুবাদ, সম্পাদনা, শিশুসাহিত্য মিলিয়ে বেলাল চৌধুরীল গ্রন্থ সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। ‘বল্লাাল সেন’, ‘ময়ূর বাহন’, ‘সব্ক্তুগীন’ ছদ্মনামেও তিনি লিখেছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘নিষাদ প্রদেশে’, ‘আত্মপ্রতিকৃতি’, ‘স্থির জীবন ও নিসর্গ’, ‘জলবিষুবের পূর্ণিমা’, ‘সেলাই করা ছায়া’, ‘কবিতার কমলবনে’, ‘বত্রিশ নম্বর’, ‘যে ধ্বনি চৈত্রে শিমুলে’, ‘বিদায়ী চুমুক’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তার কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ ও গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল’, ‘ডুমুরপাতার আবরণ’, ‘চেতনার রঙ চন্দ্রশিলা’ এবং ‘লাকসাম দাদা ও অন্যান্য গল্প’।‘কাগজে কলমে’, ‘মিশ্রচিত্রপট’, ‘নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়’, ‘জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন’, ‘নবরাগে নব আনন্দে’, ‘সুন্দরবন, সোঁদরবন ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘মুহূর্তভাষ্য’ ইত্যাদি তার অন্যান্য গদ্যগ্রন্থ। শিশু-কিশোরদের জন্য বেলাল চৌধুরী লিখে গেছেন, ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’, ‘সপ্তরত্নের কাণ্ডকারখানা’, ‘সবুজ ভাষার ছড়া’। নিজে লেখার পাশাপাশি হোর্হে লুই বোর্হেস, পাবালো নেরুদা, ডিলান টমাস, অক্তাবিও পাসের মতো কবিদের লেখা তর্জমা করেছেন বেলাল চৌধুরী; সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু স্মারকগ্রন্থ। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘জলের মধ্যে চাঁদ ও অন্যান্য জাপানি গল্প’, ‘বিশ্বনাগরিক গ্যেটে’, ‘পাবলো নেরুদা–শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি’, ‘শামসুর রাহমান সংবর্ধনাগ্রন্থ’, ‘পদাবলী কবিতা সংকলন’ ও ‘কবিতায় বঙ্গবন্ধু’।
ছাত্র অবস্থায় বেলাল জড়িয়ে পড়েন বাম ধারার রাজনীতিতে, ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাগারেও যান।ষাট ও সত্তরের দশকে কয়েক বছর কলকাতায় বসবাসের সময় সাহিত্য পত্রিকা কৃত্তিবাস সম্পাদনায় যুক্ত হন কবি। পরে পল্লীবার্তা, সচিত্র সন্ধানী ও ভারত বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদনায় যুক্ত হন।
কবি বেলাল চৌধুরী কলকাতা থেকে ১৯৭৪ সালে দেশে ফিরে আসেন, যোগ দেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। সে সময়ে জাতীয় কবিতা পরিষদ ও পদাবলী কবিতা সংগঠন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৪ সালে একুশে পদক পান কবি বেলাল চৌধুরী; পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, নীহাররঞ্জন স্বর্ণপদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা।
এক মেয়ে সাফিয়া আক্তার চৌধুরী মৌরী এবং দুই ছেলে আব্দুল্লাহ প্রতীক ইউসুফ চৌধুরী ও আব্দুল্লাহ নাসিফ চৌধুরী।
আমরা জানি কবি হিসেবে বেলাল চৌধুরী প্রথম জীবনে বোহেমিয়ান থাকলেও, পরবর্তী জীবনে বেশ শৃংখলার সাথে সম্পাদক ও অন্যান্য পদেও চাকরি করেছেন। এক ধরনের রোমান্টিকতার আবহ তাঁর কবিতায় থাকলেও তাঁর কবিতার মূল দ্যোতনা হিসেবে স্বদেশচেতনা থেকে শুরু করে অন্তর স্পর্শে সাধারণ মানুষের আর্ত-হাহাকার ও জীবন উন্মুখ হতে আমরা দেখি। আর সে কারণে ‘স্বদেশ’ নামক কবিতায় তিনি বলেন-
‘আমি আছি ব্যস্ত হয়ে তোমার রৌদ্রছায়ায়
এই তো তোমার ঘাসের গন্ধে তোমার পাশাপাশি
তোমার ছায়ার মতো তোমার শরীর জুড়ে
তোমার নদীর কুলকুল স্রােতে’।
কবি বেলাল চৌধুরী শেষ জীবনের দীর্ঘ সময়ে ঢাকার পল্টনের যে বাসায় বসবাস করেছেন, সে বাসায় আমরা অনেকে কম-বেশি গিয়েছি, কেউ বা এক বা দু’বার। ‘হাওয়ামহল’ নামক এই কবিতাটি পড়লে এক ধরনের আর্ত-হাহাকার পাওয়া যায়, মনে হয় সেই বাসাটি থাকবে, কিন্তু সেই বাসায় গিয়ে বেলাল ভাইকে আর পাওয়া যাবে না, তবে কবিতার মধ্যে দিয়ে তাঁকে আমরা খুঁজে নেব। ‘হাওয়ামহল’ কবিতার অংশ-
‘ও-বাড়িটার কেউ থাকে না শুধু হাওয়ার কুহক
জড়িয়ে আছে পাকে পাকে আইভি-লতার আলিঙ্গন
লালচে ইটে পড়ন্ত রোদ আর হাহাকার-
কেউ থাকে না ও-বাড়িটায় শুধু হাওয়ার কুহক’।