নজরুল ইসলাম তোফা: হেমন্তের শেষেই শীতঋতুর আগমন, শীতের কনকনে ঠান্ডায় বাঙালির প্রথমেই স্মৃতিপটে ভেসে উঠে যেন খেজুর গাছের মিষ্টি রস।
হেমন্তের ফসল ঘরে উঠার পরপরই প্রকৃতির মাঝে এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করে, সেই শূন্যতার মাঝেই শীতঋতুর আগমন ঘটে। উত্তরের মৃদু হাওয়াতে ঠান্ডা আমেজ অনুভব হয়। একঘেয়েমির জীবনকে অনেক পরিবর্তন এনে দেয় এই শীত ঋতু।
হিমেল আবরণ টেনেই উপস্থিত হয় এমন শীত। বাংলার জনপ্রিয় বৃক্ষতরু খেজুর গাছের সঙ্গে ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষি বা দারিদ্র ক্লিষ্ট মানুষের জন্য এই সময়টা হয় অনেক আনন্দদায়ক। কারণ, গাছই তো চাষির অন্নদাতা। খেজুর গাছে যত্ন-আত্তি না করলে ‘রস’ মিলবে না। আর রস না মিললে গুড় হবে কি করে। পাটালি না দেখলে যেন ঘুম আসে না চাষির। চাষিরা তাদের মেয়ে কিংবা বউয়ের হাতের কাঁচা সুপারির কচি পান গালেপুরে বাঁশের ডালি মাথায় করে গঞ্জে বা দূরের হাটে যাবেই বা কি করে।
শীত আমেজে প্রকৃতির মাঝ হতে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য চাষিরা চষে বেড়ায় সকাল, বিকেল এবং সন্ধ্যায় মেঠো পথ ধরে, তার বহিঃপ্রকাশে চমৎকার নান্দনিকতার সৃষ্টি কিংবা অপরূপ দৃশ্য পরিলিক্ষত হয়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী মাঝে এমন এই দৃশ্য অবশ্যই শৈল্পিক।
গ্রামাঞ্চলে খুব ভোরে অর্থাৎ সূর্যোদয়ের আগে, খেজুর গাছ থেকে রসের হাড়ি ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে নামিয়ে আনতে চাষির যেন কোনো প্রকার ক্লান্তি বা অস্বস্তি লক্ষ্য করা যায় না । রাতের শেষে, কুয়াশার সকালে হিমশীতল ‘রস’ এমন হাড় কাঁপানি ঠান্ডাতে খাওয়ার স্বাদ একটু আলাদা। খুব ভোরে রস খেলে শীত আরো জাঁকিয়ে বসে। তবুও এমন শীতে শরীর কাঁপানি ঠান্ডার এক স্পন্দন যেন চরম মজাদায়ক।
শীত লাগে লাগুক না, তবুও রস খাওয়ার কোন বিরাম নেই। এক গ্লাস, দুই গ্লাস খাওয়ার পরপরই, কাঁপতে কাঁপতে যেন আরও এক গ্লাস মুড়ি মিশিয়ে মুখে তুলে চুমক দেয়া কিংবা রোদ পোহানোর যে কী আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা দূরহ।
শীতের কুয়াশায় গ্রামাঞ্চলের ছেলে মেয়েরা ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে খড় কুটোয় আগুন জ্বেলে হাত পা গরম করে। আবার তারা অপেক্ষা করে কখন যে রোদের তেজ প্রখর হবে। ‘রোদ’ পোহানো আরামের সঙ্গে আরও অপেক্ষা, তা হলো তাদের প্রিয় খেঁজুর ‘রস’। আবার যেন গ্রামের অভাবী মেয়েরা রংবেরংয়ের যে সব খেজুর পাতার খেজুর পাটি তৈরি করে তার উপর চলে রস খাওয়ার আসর। উপার্জনের জন্যেই ‘খেজুর পাতা’ শুকিয়ে তা দিয়েই “খেজুর পাটি” তৈরি। খেজুর পাতায় এক ধরনের সাহেবী টুপিও তৈরি হয়। খেজুরের পাতা, ডাল এবং গাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার হয়ে থাকে। আবার “মোরুব্বা” তৈরিতেই খেজুর গাছের কাটার ব্যবহার প্রচলিত রয়েছে। এক কথায় বলা যায়, এই খেজুর গাছের ব্যবহার যেন সর্বমুখী।
শীতরে শুষ্কতায় অধকিাংশ বৃক্ষলতা পত্র-পল্লবহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু ‘খেজুর গাছের পাতা’ শক্ত হওয়ার জন্য ঝরে পড়ে না। তাই খেজুর পাতার বেড়া দিয়ে সেখানে খেজুর রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করে।
গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ তীব্র শীত উপেক্ষা করেই কাজে বের হয়। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে কৃষক লাঙ্গল-জোয়াল কাঁধে নিয়ে মাঠে যায় এবং জমি চাষ করে ঘরে ফিরেই দুপুর থেকে খেজুর গাছ পরিচর্যা করে রসের হাঁড়ি লাগাতে ব্যস্ত হয়। চাষীরা দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান এ গাছে থেকে সে গাছে। মাটিতে পা ফেলার ফুরসতটুকুও পায় না এই মানুষ গুলো।
শীত আসা মাত্রই খেজুর গাছ তোলার জন্য অনেক আগ থেকেই সকাল-সন্ধ্যায় যেন লেগে থাকে চাষি। খেজুর গাছ বিশেষ কায়দায় কাটতে হয়। আর এই গাছ গুলোকে যারা কাটে তাদেরকে গাছি বলা হয়। বিভিন্ন উপকরণ সমন্বয়ে এই গাছি নাম ধারি মানুষ পরিচ্ছন্নভাবে গাছ কাটায় ব্যস্ত হোন। গাছ কাটতে ব্যবহার করেন দা, দড়ি, এক টুকরো চামড়া বা পুরনো বস্তা আবার দা রাখার জন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি থলি বা ঝাঁপি। সেই ঝাঁপি গাছিরা রশি দিয়ে খুব স্ব যত্নে ‘দা’ রেখে এ গাছ থেকে সে গাছে উঠা নামা করতে সুবিধা পায়। গাছ কাটার জন্য ‘গাছি’ তাদের শরীরের ভারসাম্য রক্ষার সময় কোমর বরাবর গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে নেয়। দড়িটা বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়। এমন দড়ির দুই মাথায় বিশেষ কায়দায় গিট দেওয়া থাকে। গাছে উঠার সময় গাছি অতি সহজে মুহূর্তের মধ্যে গিঁট দুটি জুড়ে দিয়ে নিজের জন্য গাছে উঠার নিরাপদ ব্যবস্থা করে নেয়।
গাছ কাটার জন্য গাছের মাথার এক দিকের শাখা কেটে চেঁছে পরিষ্কার করে সেই কাটা অংশেরই নিচ বরাবর দুটি খাঁজ কাটার প্রয়োজন পড়ে। সে খাঁজ থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে একটি সরু পথ বের করা হয়। এই সরু পথের নিচে বাঁশের তৈরি নলী বসানো হয়। এই নলী বেয়ে হাড়িতে রস পড়ে। নলীর পাশে বাঁশের তৈরি খিল বসানো হয়। সে খিলেই মাটির হাড়ি টাঙিয়ে রাখা হয়। বিকেল থেকে হাড়িতে রস জমা হতে হতেই সারা রাত্রিতে হাড়ি পূর্ণ হয়। গাছ কাটার পর দুই তিন দিন রস পাওয়া যায়। প্রথম দিনের রসকে বলে জিরান কাট। জিরান কাট রস খুবই সুস্বাদু। প্রথম দিনের রস থেকে ভালো পাটালি গুড় তৈরি হয়। দ্বিতীয় দিনের রসকে বলে দোকাট। তৃতীয় দিনের রসকে বলে তেকাট। রসের জন্যেই খেজুর গাছে একবার কাটার পর আবারও পাঁচ ছয় দিন পর কাটতে হয়। গাছের কাটা অংশ শুকানোর জন্যে এ সময় দেওয়া প্রয়োজন পড়ে। খেজুর গাছ কাটা অংশ শুকানোর সুবিধার জন্য সাধারণত পূর্ব ও পশ্চিম দিকে গাছ কাটা হয়। যাতে সূর্যের আলো সরাসরি কাটা অংশে পড়ে।
গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য মাটির হাড়ি ব্যবহার করা হয়। হাড়িকে আবার অনেকে বলে ভাঁড়। ঠিলা হিসেবেও হাড়ির নাম ব্যবহার হয়। যে যাই বলুক না কেন, ভাঁড়টি আসলেই খুব ছোট আকৃতির কলসের মতো হয়ে থাকে। মাঝারি আকৃতির দশ বা পনেরো ভাঁড় রস জ্বাল দিয়েই এক ভাঁড় গুড় হয়। সেই এক ভাঁড় গুড়ের ওজন ছয় থেকে আট কেজির মতো। গুড় তৈরির জন্য রস জ্বাল দেওয়া হয় মাটির জালায় বা টিনের তাপালে। খুব সকালে রস নামিয়ে এনেই জ্বালানো হয়। জ্বাল দিতে দিতে এক সময় রস ঘন হয়ে গুড় হয়ে যায়। এ গুড়ের কিছু অংশ তাপালের এক পাশে নিয়ে বিশেষ ভাবে তৈরি একটি খেজুর ডাল দিয়ে ঘঁষতে হয়। ঘঁষতে ঘঁষতে এই অংশ টুকু শক্ত হয়ে যায়। আর শক্ত অংশকেই আবার কেউ কেউ বীজ বলে থাকে। বীজের সঙ্গে তাপালের বাকি গুড় মিশিয়ে স্বল্পক্ষণের মধ্যে গুড় জমাট বাঁধতে শুরু করে। তখন এ গুড় মাটির হাঁড়ি বা বিভিন্ন আকৃতির পাত্রে রাখার প্রয়োজন পড়ে। সে গুড় দেখলে বুঝা যাবে, একেবারে জমাট বেঁধে পাত্রের আকৃতি ধারণ করেছে।
খেজুর গাছ ছয় সাত বছর বয়স থেকে ‘রস’ দেওয়া শুরু করে। পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর পর্যন্ত ‘রস’ দেয়। গাছ পুরনো হয়ে গেলে ‘রস’ কমে যায়। আর পুরনো খেজুর গাছের রস যেন খুব মিষ্টি হয় এবং তা মাঝ বয়সী গাছ থেকে সব চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। বেশি রস সংগ্রহ করাও গাছের জন্য ক্ষতিকর। সেই “রস” সংগ্রহের জন্য কার্তিক মাসে খেজুর গাছ কাটা শুরু। রসের ধারা চলতে থাকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত।
শীতের সঙ্গে গাছ হতে রস ঝরার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যেন আছে। শীত যত বেশি পড়বে তত বেশি রস ঝরবে। রসের স্বাদও ততই মিষ্টি হবে। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ মাস হলো রসের ভর মৌসুম। অগ্রহায়ণ মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত একটি খেজুর গাছে মাসে চল্লিশ কেজি রস পাওয়া যেতে পাবে।
খেজুর গাছ শুধু রস দিয়েই ক্ষান্ত হয় না। খেজুরেও অনেক ভেষজ গুণ বিদ্যমান। খেজুরের বীজগুলো বাহির করে নিয়ে “দুধে” খেজুর গুলো মিশিয়ে ভাল ভাবে ফুটিয়ে গরম করে এই দুধ, খেজুর ঠান্ডা করে শিশুকে খাওয়ালে শক্তি বাড়ে৷ তাই একটি শুকনো খেজুরের ফলের পুষ্টিমান তুলে ধরে বলা যায়, প্রায় ৭৫-৮০% শর্করা, প্রায় ২% আমিষ এবং প্রায় ২.৫% স্নেহজাতীয় পদার্থ থাকে। ১০০ গ্রাম শাঁসে থাকে, ২ ভাগ পানি, ৬০-৬৫ ভাগ শর্করা, ২ ভাগ আমিষ এবং খুব সামান্য সালফার, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন এ, বি-১, বি-২ সহ কপার থাকে ও খনিজ লবণ খুঁজে পাওয়া যায়।
চালের গুড়োয় তৈরি ‘ভাপা পিঠা’ খেজুরের গাঢ় রসে ভিজিয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। মেয়ে জামাইকে দাওয়াত দিয়ে এই খেজুর রসের পিঠা পায়েসের তৈরির আয়োজনেও চরম ধুম পড়ে এই শীতে। চাষির মেয়ে, বউ, ঝিয়েরা খেজুরের ”রস” বা ‘গুড়’ কিংবা ‘পিঠা’ তৈরিতেও অত্যন্ত ব্যস্ত সকালের মনোরম পরিবেশে উপভোগ করে। এমন চমৎকার দৃশ্য বড়ই শৈল্পিক।
শুধুই কি তাই, শীতের র্দীঘ রজনীতে চাষিরা লেপ, কাঁথা, কম্বল মুড়ি দিয়ে জড়াজড়ি করেই ভোরের প্রত্যাশায় রাত কাটায়। এই শীতের ভোরেই রস কিংবা পাটালি গুড় তৈরিতে জ্বালানির পাশে বসে অথবা লেপ মুড়ি দিয়েই চিড়া, মুড়ির মোয়া খাওয়ার মজার একটি পরিবেশ উপভোগ করতে চাষির পরিবারের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাসহ মেয়ে-জামাইরা ভুল করে না।
রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হবে গুড়। সেই গুড়ের আবার রকমফের আছে। যেমন, পাটালি গুড়, ঝোলা গুড়। এ সব গুড় বিভিন্নভাবে খাওয়া হয়। শীতের খেজুর গাছের রস হতে যে গুড় তৈরি তা দিয়ে দুধের পিঠা, পুলিপিঠা, সেম পিঠা আরও কত কি যে পিঠা তৈরি হয়, তা না খেলে একেবারেই জীবন বৃথা।
পাটালি গুড় দিয়ে মুড়ির ‘মোয়া’ খাওয়া এবং ঝোলা গুড়ের সঙ্গে মচমচে মুড়ি খাওয়ার জনপ্রিয়তা গ্রামাঞ্চলে খুব। আবার এমনিতেও তারা খেজুর গুড় সরবত করে কিংবা খালি খালিই খায়। তবে খেজুরের রস দিয়েই তৈরি রসের পিঠা খুবই সুস্বাদু। তাছাড়াও খেজুর গুড়ের প্রচলিত সন্দেশ যে হয় তার স্বাদই অপূর্ব। শখ করে অনেক চাষিরা চা খাওয়ার নেশায় ঘরেই চা বানিয়ে খায় খেজুর গুড়কে উপজীব্য করে।
শীত তার বিচিত্র রূপ ও রস নিয়েই হাজির হয় গ্রাম বাংলায়। নবান্ন উৎসব কিংবা শীতের পিঠা পায়েশ তৈরির উৎসব শীতে ঘটা করেই হয়। শীতে চিরায়ত যা কিছু সৃষ্টির নিয়ামত, তা উপলব্ধি করতে চাইলে অবশ্যই গ্রামে যেতে হবে।
নজরুল ইসলাম তোফা : অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, ও প্রভাষক।