আতিকুর রহমান
যথাযথ মর্যাদা ও উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আজ (২১ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার) সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপিত হচ্ছে। দেশের সকল সেনানিবাস, নৌ ঘাঁটি ও স্থাপনা এবং বিমান বাহিনীর ঘাঁটির মসজিদসমূহে দেশের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি, সশস্ত্র বাহিনীর উত্তরোত্তর উন্নতি ও অগ্রগতি এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সশস্ত্র বাহিনীর শহিদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে ফজরের নামাজ শেষে বিশেষ মোনাজাতের মধ্য দিয়ে দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়েছে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন কর্তৃক গণঅভ্যূত্থান পরবর্তি ব্যতিক্রম পরিবেশে এবারের সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত হবে। যথারীতি প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ঢাকা সেনানিবাসস্থ সেনাকুঞ্জে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
এ সংবর্ধনায় উল্লেখযোগ্য আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দের সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কগণও উপস্থিত থাকবেন। ঢাকা ছাড়াও বরিশাল, কক্সবাজার, বগুড়া, সিলেট, ঘাটাইল, চট্টগ্রাম, যশোর, রংপুর ও খুলনা সেনানিবাস/ঘাঁটিতে সংশ্লিষ্ট এরিয়া সদর দপ্তরের ব্যবস্থাপনায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। এছাড়া,ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য সেনা গ্যারিসন, নৌ জাহাজ ও স্থাপনা এবং বিমান বাহিনী ঘাঁটিতেও বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে। ঢাকা, খুলনা, চাঁদপুর, বরিশাল ও চট্টগ্রামে বিশেষভাবে সজ্জিত নৌবাহিনীর জাহাজসমূহ ২১ নভেম্বর বেলা ২টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সর্বসাধারণের দেখার জন্য নিকটস্থ ঘাটসমূহে নোঙরকৃত অবস্থায় রাখা হবে।
এবার সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপনের পটভূমি ও তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করা যাক। ১৯৮০ সাল থেকে সম্মিলিতভাবে ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয়ে আসছে। পূর্বে অবশ্য ২৫ মার্চ সেনাবাহিনী দিবস, ১০ ডিসেম্বর নৌবাহিনী দিবস এবং ২৮ সেপ্টেম্বর বিমানবাহিনী দিবস পৃথকভাবে নিজস্ব বাহিনী দিবস হিসেবে পালিত হত। মূলত: ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ মাতৃকার যে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জিত হয়েছে; সেই অসাধারণ অর্জন স্মরণীয় ও বরণীয় করে রাখার নিমিত্তে নতুন প্রজন্মকে নিয়ে সম্মিলিতভাবে উদযাপনের মাধ্যমে আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধকে মহিমান্বিত করার জন্যে সশস্ত্রবাহিনী দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের সাধারণ জনগণকে সাথে নিয়ে সশস্ত্রবাহিনী যে অবিস্মরণীয় ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের মাতৃভূমি দখলদার হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত করেছে; তা অবগত হলে জাতির মধ্যে দেশপ্রেমের অনুভূতির স্ফুরণ ঘটবে-এটা নি:সন্দেহে বলা যায়। ১৯৭১ সালে আধুনিক মারনাস্ত্রে সজ্জ্বিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্মম আক্রমণ প্রতিহত করে; তাদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে দেশকে হানাদার মুক্ত করে জাতিকে উপহার দিয়েছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র,একটি মানচিত্র এবং লাল-সবুজ পতাকা। অবশ্য সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালনের পেছনে মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অবদানকে দেশের জনগণের আত্মত্যাগের সাথে একীভূত করে বিবেচনা করা হয়। এক কথায় বলা যায়, বিজয় অর্জনের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে স্মরণীয় বরণীয় করে রাখার জন্য ২১ নভেম্বরকে একটি বিশেষ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সৃষ্টির পশ্চাতে যে কয়েকটি দিবস খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে; তারমধ্যে ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ অন্যতম। মূলত: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চালিকাশক্তি ছিল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী এবং সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। সর্বস্তরের মুক্তিকামী জনগণ সশস্ত্র বাহিনীর সহযোদ্ধা বা সম্পূরক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। জনসাধারনের স্বতস্ফূর্ত সহযোগিতায় ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে বিদ্রোহ করা প্রায় ২৬ হাজার সুপ্রশিক্ষিত বাঙালি সদস্যের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়। সেনাবাহিনীর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথমে পাঁচটি ও পরবর্তীতে নবপ্রতিষ্ঠিত আরো তিনটি ব্যাটালিয়ন ছিল প্রধান চালিকাশক্তি। প্রথাগত বা নিয়মিত যুদ্ধ শুরু করার জন্য ’৭১ সালের ২১ নভেম্বর সেনাবাহিনীর সাথে নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিতভাবে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের সূচনা করে। আর সে জন্যই ২১ নভেম্বরকে মুক্তিযুদ্ধের একটি মাইলফলক হিসেবে সশস্ত্রবাহিনীর দিবস হিসেবে গৌরবের সাথে স্মরণ করা হয়। পৃথিবীখ্যাত সুপ্রশিক্ষিত অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জ্বিত একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের সৈনিক-নাগরিক সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনী সৃষ্টি করে যুগান্তকারী এক ইতিহাস। প্রকৃতপক্ষে এ বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বরের সম্মিলিত আক্রমণ।
আমাদের জাতীয় জীবনে শ্রেষ্ঠ গৌরবময় অধ্যায় হচ্ছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। শোষণ,অত্যাচার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে স্বাধীকার আদায়ে বীর বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জন্ম হয় একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। আজকের বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। সশস্ত্র বাহিনী আজ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতির আস্থার প্রতীক। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী হতে পালিয়ে আসা বা বিদ্রোহী দেশপ্রেমিক সেনাদের সাথে যুক্ত হয় আধা-সামরিক বাহিনী ছাড়াও বাংলার স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকামী সাধারণ জনগণ। সৈনিক-নাগরিক গভীর বন্ধনে জন্ম নেয় আজকের বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল প্রকৃত ”সিটিজেন আর্মি”।
১৯৭১ সালের রণাঙ্গনে সেনাবাহিনী-জনসাধারণের রক্ত একাকার হয়ে গিয়েছিল। সৈনিক-নাগরিক মেলবন্ধনে সৃষ্ট এমন সশস্ত্রবাহিনী বিশে^র সামরিক ইতিহাসে বিরল। বাংলাদেশের সৃষ্টি ও সামরিক বাহিনী গঠনের ইতিহাস অন্যান্য দেশের থেকে আলাদা। কেননা বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ কোন গণভোটের মাধ্যমে একক কোন ব্যক্তির নেতৃত্বে স্বাধীন হয়নি। সৈনিক-নাগরিক যৌথ প্রয়াসে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আজকের বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। তেমনি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীও ব্যতিক্রম পরিবেশ ও উদ্যেগের মাধ্যমে সৃষ্ট।
মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র রণাঙ্গনকে ভাগ করা হয় ১১টি সেক্টরে; যার নেতৃত্বে ছিলেন মূলত সামরিক বাহিনীর অফিসারগণ। এছাড়া, তিনটি ব্রিগেডের পাশাপাশি কিছু স্থানে গেরিলা বাহিনী সংগঠিত হয়ে স্থল যুদ্ধ শুরু করে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। সাথে যুক্ত হন মুক্তিকামী সাধারণ জনগণ। মূলত সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকরা নিজেদের সংগঠিত করার পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীর পুনর্গঠনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। বাংলার মুক্তিকামী জনগণের স্বত:স্ফূর্ত সহায়তায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী মুক্ত করে বাংলার বিভিন্ন এলাকা।
ইতিহাস বলে, প্রথমাবস্থায় স্থানীয় ও পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা নৌ ও বিমান সেনারা স্থল বাহিনীর সাথে বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মুজিবনগর সরকারের উদ্যোগে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যার ফলে ভারত সরকারের নিকট হতে দুটি টাগবোট সংগ্রহ করে গানবোটে রূপান্তরিত করা হয়। তখনকার সময়ে নৌকমান্ডোদের দুঃসাহসিক অভিযান; অপারেশন জ্যাকপট; চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। দেশ মাতৃকার সংকটময় কালে তৎকালীন পাকিস্তান এয়ারফোর্সের বাঙালি পাইলট ও টেকনিশিয়ানরা বিভিন্নভাবে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। পরবর্তীতে আসামের দুর্গম জঙ্গলে পরিত্যক্ত রানওয়েতে সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে শুরু হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর কার্যক্রম। মুজিবনগর সরকারের সংগ্রহ করা একটি অটার প্লেন, একটি ডাকোটা বিমান এবং একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারকে মেশিনগান ও রকেটে সজ্জিত করে শুরু হয় কিলো ফ্লাইটের যাত্রা। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর চট্টগ্রাম বিমানবন্দর এলাকা ও চট্টগ্রাম তৈল শোধনাগারে বিমান হামলা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
পর্যায়ক্রমে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সাথে মুক্তিকামী জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মিলিত আক্রমণের সূচনা করে। ফলে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত হয় আমাদের বিজয়। সশস্ত্র বাহিনী বাংলার জনগণকে সাথে নিয়েই অর্জন করে বহুল প্রত্যাশিত স্বাধীনতা। আবার স্বাধীনতা অর্জনের পর ”সমরে আমরা,শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে”- এই মন্ত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী; ”বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত”-শ্লোগানে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এবং ”শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয়”-মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনেও সম্পৃক্ত হয়েছে। দেশ মাতৃকার প্রয়োজনে সশস্ত্র বাহিনী সব সময় বাংলাদেশের জনগণের পাশে থেকেছে। ফোর্সেস গোল-২০৩০ এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে একটি আধুনিক সেনাবাহিনীতে রূপান্তর করা হচ্ছে ।
সরকারের আন্তরিকতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ একটি সুপ্রশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খলবাহিনী; যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। উন্নতির ধারাবাহিকতায় নৌবাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে সাবমেরিন। উন্নত নৌযানে সজ্জিত নৌবাহিনী সমুদ্রে আমাদের গর্বের প্রতীক। বিমানবাহিনীর অধুনিকায়নে তৈরি হয়েছে নতুন বিমানঘাঁটি। বিমান বহরে সংযোজন করা হয়েছে আধুনিক যুদ্ধবিমান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আলোকিত সশস্ত্র বাহিনী দেশের বিভিন্ন প্রয়োজনে বহুবার নিয়োজিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছে। পার্বত্য এলাকায় শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী উল্লেখযোগ্য ও কার্যকরী ভূমিকা রেখে চলেছে। এক্ষেত্রে বিমানবাহিনীও পার্বত্য অঞ্চলের শান্তি রক্ষায় সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছে। কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম নয় দেশের বিভিন্ন স্থানে অবকাঠামোগত উন্নয়নে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী প্রশংসনীয় অবদান রেখেছে। এছাড়া, সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ক্যাডেট কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের মাধ্যমে দেশের শিক্ষা বিস্তারে আমাদের গর্বিত সেনাবাহিনী অসাধারন ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
তাছাড়া বাংলাদেশকে প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়। ঝড়,বন্যা,অগ্নিকান্ড সহ বিভিন্ন দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগোত্তর পরিস্থিতি মোকাবেলায় সশস্ত্র বাহিনীকেই প্রথম নিয়োজিত করা হয়। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ও দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এ ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলার মাধ্যমে অর্জন করেছে জনগণের আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা। এমনকি রাজনৈতিক বিশৃংখলা প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে দেশে শান্তি শৃংখলা ফিরিয়ে আনয়নে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী বর্তমানে ও অতীতে গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে।
এখানেই শেষ নয়। জনগণের আস্থার প্রতিক সশস্ত্র বাহিনী এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে চলেছে। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষাবাহিনীতে সদস্য প্রেরণে বাংলাদেশ আজ শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। পেশাদারিত্বে ও আন্তরিকতায় বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় মানবাধিকার ও শান্তি শৃংখলা রক্ষায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে দেশের জন্যে সুনাম কুড়িয়ে যাচ্ছে। আজ সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি সদস্য দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করছে।
এবার দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে আমাদের গর্বিত সামরিক বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। আমাদের সুপ্রশিক্ষিত ও পেশাদার সশস্ত্রবাহিনী আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেগৌরবের সাথে স্থান করে নিয়েছে। জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে প্রথমস্থানে অবস্থানকারী সশস্ত্রবাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে এখন বাংলাদেশের সদস্য সংখ্যা সর্বোচ্চ। ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক শান্তি মিশনে যোগদানের মধ্য দিয়ে জাতিসঙ্ঘের পতাকাতলে পথ চলা শুরু করে আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহন করে ১৯৯৩ সালে। তাছাড়া, শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পেয়েছে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ১৯৮৮ সালে ইউএন ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভেশন গ্রুপ (ইউনিমগ) মিশনে মাত্র ১৫ জন সেনা পর্যবেক্ষক প্রেরণের মাধ্যমে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু । ১৯৯৩-৯৪ সালে সবচেয়ে আলোচিত রুয়ান্ডা, সোমালিয়া ও বসনিয়ার তিনটি শান্তি মিশনে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আলোচনায় আসে। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সোমালিয়ার জনগণের হৃদয় জয় করে নিজেদের অবস্থানকে সেখানে সুদৃঢ় করে নিয়েছিল।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী চলতি বছরে ৭৫ বছর (১৯৪৮-২০২৩) পূর্ণ করেছে। এদিকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের অধীনে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী পূর্ণ হয়েছে ৩৫ বছর (১৯৮৮-২০২৩)। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে শুরু থেকেই বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সেনারা নিজেদের কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়ে সুনাম ও ভালোবাসা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ গর্বিত সহযোগী। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। হাইতি থেকে পূর্ব তিমুর, লেবানন থেকে ডিআর কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ এলাকার জনমনে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ৬ জন ফোর্স কমান্ডার ও ৭ জন ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের গৌরব অর্জন করেছেন। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৮টি সংকটাপন্ন দেশে এবং জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রায় ৬৭৩১ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৪০টি দেশের ৫৪টি মিশনে শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে অসামান্য অবদান রেখে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা বিশ্বব্যাপী দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। পাশাপাশি রেমিটেন্স প্রেরনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলছেন। শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে বর্তমানে দেশের রেমিট্যান্স আয় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বলে জানা গেছে।
তবে সৈনিক-নাগরিক পারস্পরিক মেলবন্ধন বা যোগাযোগ কেবল সশস্ত্র বাহিনী দিবসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নিয়মিত আন্ত:যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা যেতে পারে। সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপনের দিনে বা স্বাধীনতা,বিজয় দিবসে অথবা সামরিক মহড়া চলাকালে সর্বস্তরের নাগরিকদের নিয়ে যুদ্ধ অনুশীলন করা যেতে পারে। নিয়মিত যুদ্ধ অনুশীলনের মাধ্যমে সম্পূরক সিটিজেন আর্মি তৈরি হবে। এতে একদিকে সৈনিক-নাগরিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হবে অন্যদিকে যুদ্ধকালিন সময়ে মুুক্তিযুদ্ধের মত প্রশিক্ষিত জনগণ সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহন করতে পারবে।
মোদ্দাকথা, একজন তাত্ত্বিক বলেছেন-জনগণ হচ্ছে পানিতুল্য এবং সেনাবাহিনী হচ্ছে পানিতে সাতার রত মাছের ন্যায়। অর্থাৎ সেনাদের আশ্রয়স্থল হচ্ছে জনগণ। এবং যার ব্যবহারিক প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম গ্রহন করা আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। সৈনিক-নাগরিক বন্ধনে সৃষ্ট আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সাথে জনসাধারনের মেলবন্ধন অটুট থাকবে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধকালের মত দেশ মাতৃকার যেকোন দুর্যোগ, দুঃসময়ে, শান্তিতে-সমরে সেনাবাহিনী-জনগণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পথ চলবে-এটাই সশস্ত্র বাহিনী দিবসের প্রত্যাশ্যা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট