নিকোলাস বিশ্বাস
প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশ সরকার, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ইউএনডিপি -এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (২য় পর্যায়) প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের মূল ভিত্তি হচ্ছে, গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ (সংশোধন ২০১৩) এবং গ্রাম আদালত বিধিমালা ২০১৬। এ আইন বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ মানুষ বিশেষভাবে নারী, দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মানুষ অল্প সময়ে ও স্বল্প ব্যয়ে সঠিক বিচার পাবেন।
আবেদনকারীর অবস্থা: চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা-পশ্চিম ইউনিয়নের মদনের গাঁও গ্রামের বাসিন্দা ছলেমান তপাদার (৬০)। ছলেমান তপাদারের ২ ছেলে ও ৩ মেয়ে। ১ ছেলে ও ১ মেয়ে অবিবাহিত। তিনি তার পৈত্রিক বাড়িতে থাকেন। তিনি এলাকায় ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তার মাসিক আয় প্রায় ৭,০০০ (সাত হাজার) টাকা।
ঘটনার সূত্রপাত: ছলেমান তপাদারের মেয়ে আঁখি আক্তারকে একই বাড়ির বাসিন্দা রেজ্জাক তপাদার তাদের গৃহস্থালীর কাজের জন্য নেয়। কাজে নেওয়ার সময় শর্ত ছিল যে, তার মেয়ের যাবতীয় দেখভাল ও বিয়ের সময় খরচাদি রেজ্জাক তপাদার বহন করিবেন। কিন্তু দীর্ঘ দিন যাবত গরীব ও অসহায় মেয়েটি রেজ্জাক তপাদারের গ্রহস্থালীর কাজ করার পরেও শর্ত অনুযায়ী যে প্রাপ্য দেওয়ার কথা তা দিচ্ছিল না। তাই নিয়ে বিরোধ শুরু হয়।
গ্রাম আদালতের ধারণা লাভ: এমতাবস্থায়, তার মেয়ের অসহায়ত্বের কথা কাঁদতে কাঁদতে এলাকার গণ্যমান্য, সমাজসেবী ও ব্যবসায়ী নূরে আলম মাসুদ মিয়াজীর কাছে বিস্তারিতভাবে খুলে বলেন। নূরে আলম মাসুদ মিয়াজী গ্রাম আদালত বিষয়ক ‘কমিউনিটি মত বিনিময় সভা’র মাধ্যমে জানতে পারেন গ্রাম আদালত কি, গ্রাম আদালতের এখতিয়ার ও কোন কোন বিষয়ে গ্রাম আদালত বিচার করতে পারে। এরই প্রেক্ষাপটে তিনি অসহায় ছলেমান তপাদারকে বলেন, আপনি কোনো চিন্তা না করে সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত সহকারী উম্মে তামিমা আপার কাছে চলে যান। সেখানে আপনি আপনার সমস্যার সমাধান খুঁজে পাবেন।
দেরি না করে পরদিনই ছলেমান ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থিত গ্রাম আদালতে আসেন এবং গ্রাম আদালত সহকারীকে বিরোধীয় বিষয়টি বিস্তারিত বলেন। সব কিছু শুনে গ্রাম আদালত সহকারী উম্মে তামিমা বলেন, এটি গ্রাম আদালতের আওতাভূক্ত একটি মামলা। আপনি চাইলে ইউনিয়ন পরিষদের এই গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন।
গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের: ছলেমান তপাদার বালিথুবা-পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত সহকারীর সহায়তায় ১০ (দশ) টাকা ফিস প্রদান সাপেক্ষে ৭৫,০০০ (পঁচাত্তর হাজার) টাকা ক্ষতিপূরণ দাবী ক’রে ১) রেজ্জাক তপাদার, ২) আছমা এবং ৩) ফাতেমা গঙদের বিরুদ্ধে ১৮/১০/২০১৮ তারিখে একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন। অতপর; মামলাটি আদালতের রেজিস্টারে ৫২/২০১৮ নং মামলা হিসেবে নথিবদ্ধ করা হয়। ঐ দিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ শফিকুর রহমান পাটওয়ারী প্রতিবাদীগণের প্রতি আদালতের আইন অনুযায়ী সমন জারি করার আদেশ দেন। আদালত সহকারী গ্রাম পুলিশের মাধ্যমে প্রতিবাদীগণের প্রতি সমন জারি করেন।
আদালত গঠন প্রক্রিয়া: সমন পাওয়ার পর ২১/১০/২০১৮ তারিখে প্রতিবাদীগণ ও আবেদনকারী আদালতে হাজির হন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ শফিকুর রহমান পাটওয়ারী প্রতিবাদীগণকে আবেদনকারীর অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত করলে প্রতিবাদীগণ তা অস্বীকার করায় পক্ষদ্বয়কে আদালত গঠন করার নিমিত্তে বিচারকদের প্যানেল গঠনের জন্য সদস্য মনোনয়ন করার নির্দেশ দেন। গ্রাম আদালত সহকারী তাদেরকে সদস্য মনোনয়ন ফরম দিয়ে সদস্য মনোয়নের বিষয়টি বুঝিয়ে দেন। ২৫/১০/২০১৮ তারিখে আবেদনকারীর পক্ষে ১) জাকিয়া বেগম, ইউপি সদস্য; ২) নূরে আলম মাসুদ মিয়াজী, স্থানীয় ব্যক্তি এবং প্রতিবাদীর পক্ষে ১) মোঃ আমির হোসেন কিরণ, ইউপি সদস্য; ২) মুন্না তপাদার, স্থানীয় ব্যক্তিকে গ্রাম আদালতের বিচারক প্যানেলের সদস্য হিসেবে মনোনিত করেন। অতপর সংশ্লিষ্ট বালিথুবা-পশ্চিম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ শফিকুর রহমান পাটওয়ারী ও পক্ষদ্বয় কর্তৃক মনোনীত বিচারক প্যানেল সদস্যদের নিয়ে দায়েরকৃত মামলার জন্য গ্রাম আদালত গঠন করা হয়। এরপর গ্রাম আদালত ৩১/১০/২০১৮ তারিখে অত্র মামলার প্রথম শুনানীর জন্য দিন ধার্য্য করে।
মামলার শুনানী: ৩১/১০/২০১৮ তারিখে উভয় পক্ষ ও প্যানেল সদস্যগণ মামলার শুনানীতে হাজির হন। আদালতের কাঠ-গড়ায় দাঁড়িয়ে উভয় পক্ষ তাদের নিজ নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। পক্ষদ্বয়ের বক্তব্য অনুযায়ী আবেদনকারী কর্তৃক প্রতিবাদীর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের প্রাথমিক ভিত্তি পাওয়া যায়। অতপর বিচারক প্যানেল থেকে পক্ষদ্বয়কে প্রাক-বিচারের মাধ্যমে মামলা নিস্পত্তি করার বিষয়টি অবহিত করেন। কিন্তু পক্ষদ্বয় প্রাক-বিচারের মাধ্যমে মামলা নিস্পত্তি করতে রাজি না হওয়ায় মামলার পরবর্তী শুনানীর জন্য ৫/১১/২০১৮ তারিখ নির্ধারণ করা হয়।
মামলার রায় ঘোষণা: ০৫/১১/২০১৮ তারিখে পক্ষদ্বয় ও গ্রাম আদালতের মনোনীত প্যানেল সদস্যগণ হাজির হন। পক্ষদ্বয় ও সাক্ষীদের জবানবন্দীর আলোকে ও মামলার প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় প্রতিবাদীর বিরুদ্ধে আবেদনকারীর আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হয়। আবেদনকারী ও প্রতিবাদীর সামাজিক অবস্থা ও পুনর্মিলনের বিষয় বিবেচনা করে পক্ষদ্বয়ের মনোনীত সদস্যগণ সর্ব সম্মতিক্রমে বা ৫ঃ০ ভোটে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, প্রতিবাদী কর্তৃক আবেদনকারীকে মোট ৭৫,০০০ (পঁচাত্তর হাজার) টাকা পরবর্তী ৭ দিনের মধ্যে অর্থ্যাৎ ১২/১১/২০১৮ তারিখের মধ্যে ক্ষতিপূরণ হিসেবে গ্রাম আদালতের মাধ্যমে পরিশোধ করার আদেশ দেওয়া হয়।
রায় বাস্তবায়ন: গ্রাম আদালতের আদেশক্রমে ১২/১১/২০১৮ তারিখে প্রতিবাদী রেজ্জাক তপাদার গং আবেদনকারী ছলেমান তপাদারকে ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতের মাধ্যমে ৭৫,০০০ (পঁচাত্তর হাজার) টাকা বুঝিয়ে দেন। এর ফলে গ্রাম আদালতের ঘোষিত রায় যথাসময়ে কার্যকর হয়।
আবেদনকারীর অভিব্যক্তি: মামলার রায় পেয়ে আবেদনকারী যারপরনাই সন্তুষ্ট হন। তিনি বলেন, “ইউনিয়ন পর্যায়ে সঠিক বিচার পাওয়ার নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হচ্ছে গ্রাম আদালত। আমি সাধারণ মানুষ হিসেবে ভাবতেও পারিনি আমার এই অসহায় মেয়ের প্রাপ্য মজুরী এত সহজে ফিরে পাব যা আমার মত অসহায় ও দরিদ্র পরিবারের কাছে মহামূল্যবান অর্জন। আমি আশা করি এই রায় সমাজের কাছে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।”
বিচারিক-সেবা মূল্যায়ন: হিসেব অনুযায়ী ৫ দিনের মধ্যে মাত্র দুটি শুনানীর মাধ্যমেই মামলাটি নিস্পত্তি হয় এবং ৭ দিনের মধ্যে মামলার রায় শতভাগ বাস্তবায়িত হয়। মামলাটির জন্য আবেদনকারীকে মোট ৪ বার আদালতে আসতে হয়েছে। এরমধ্যে, মামলা দায়েরের জন্য একদিন, বিচারক প্যানেল সদস্য মনোনয়নের জন্য একদিন এবং দু’বার শুনানীর জন্য দুইদিন আদালতে আসতে হয়েছে। বিচার পাবার জন্য মামলার ফিস বাবদ আবেদনকারীর খরচ হয়েছে মাত্র ১০ (দশ) টাকা যেহেতু মামলাটির ধরণ ফৌজদারী প্রকৃতির। তাই দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য স্বল্প সময়ে ও অতি অল্প খরচে ন্যায়-বিচার পাওয়ার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে চাঁদপুরের গ্রাম আদালত। ফলে সাধারণ মানুষ গ্রাম আদালতের সুফল পেতে শুরু করেছে।
(তথ্যসূত্র: ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা-পশ্চিম ইউনিয়নের গ্রাম আদালতের নথি)