৩৭ লাখ টাকার পর্দার আসল ঘটনা

ফরিদপুর সংবাদদাতা: আলোচিত ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ (ফমেক) হাসপাতালে কোরিয়া থেকে কেনা হয়েছে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা দামের পর্দা ব্যবহার হয়নি কয়েক বছরেও।

কেবল পর্দাই নয়, একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ভিএসএ অনসাইড অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্ট কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে পাঁচ কোটি ২৭ লাখ টাকা। অভাবনীয় দাম দেখিয়ে কেনা সে যন্ত্রও ফেলে রাখা হয়েছে।

এ হাসপাতালের জন্য ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনায় আর্থিক অনিয়মের ঘটনায় হাইকোর্ট ২০ আগস্ট ছয় মাসের মধ্যে দুদককে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই সময়ে মেসার্স অনিক ট্রেডার্স ৫১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার ১৬৬টি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। অনিক ট্রেডার্স ৪১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার বিল পেলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১০ কোটি টাকা যন্ত্রপাতির দাম বেশি দেখানোসহ বিভিন্ন অসঙ্গতির কারণে আটকে দেয়। এ প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১ জুন অনিক ট্রেডার্স বকেয়া আদায়ে হাইকোর্টে একটি রিট করে। রিটের পর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের কাছে অনিক ট্রেডার্সের সরবরাহ করা ১০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতির একটি তালিকা চেয়ে পাঠান।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক কামদা প্রসাদ সাহা ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ওই ১০ কোটি টাকার বিপরীতে দামসহ ১০ আইটেমের যন্ত্রপাতির একটি তালিকা দেন। ওই তালিকার সঙ্গে  সরেজমিনে পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ভিএসএ অনসাইড অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্ট কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে পাঁচ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এ যন্ত্রটি হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডের পেছনে পশ্চিম পাশের রুমে স্থাপন করা হয়েছে। তিন বছর ধরে ওই কক্ষটি তালাবদ্ধ। তালায় জং ধরে যাওয়ায় হ্যাক্সো ব্লেড দিয়ে তালার কড়া কেটে কক্ষে ঢুকতে হয়েছে।

এ ছাড়া কোরিয়ায় তৈরি হাসপাতাল সার্টেইন সিসটেম ফর আইসিইউ/সিসিইউ শয্যা কিনতে তৈরি খরচ দেখানো হয়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। পরিচালক তার তালিকায় শয্যার পরিমাণ ‘একটি’ উল্লেখ করলেও এই ওয়ার্ডে ১৬টি শয্যা রয়েছে। ১৬টি শয্যার জন্য সাড়ে ১২ হাত দৈর্ঘ্য ও সাড়ে চার হাত প্রস্থ বিশিষ্ট আধুনিক পর্দা রয়েছে। ওই পর্দার দাম ৩৭ লাখ ৫০ হাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে যন্ত্রপাতি থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারী না থাকায় গত তিন বছর ধরে সিসিইউ ইউনিটটিতে কোনো কার্যক্রম নেই। ওই ওয়ার্ডের দায়িত্বে নিয়োজিত জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স রাজিয়া সুলতানা জানান, তিনি প্রতিদিন এ কক্ষটি খোলেন দেখাশোনা করেন আবার বন্ধ করে দেন।

পরিচালকের প্রতিবেদন অনুযায়ী তিনটি ডিজিটাল প্রসেসর সিস্টেম যা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি উল্লেখ করে দাম দেখানো হয়েছে ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকা। প্রকৃতপক্ষে ডিজিটাল প্রসেসর সিস্টেম যে মেশিনটি সরবরাহ করা হয়েছে সেটি কোরিয়ার তৈরি। এ যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে না।

একইভাবে ভ্যাকুয়াম প্ল্যান্ট এর দাম দেখানো হয়েছে ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এটি পুরোনো, স্থাপন করা হয়েছে দন্ত বিভাগে। এই কক্ষটিও খোলা হয় না এবং এই যন্ত্রটিও ব্যবহৃত হচ্ছে না।

বিআইএস মনিটরিং সিস্টেম কেনা হয়েছে ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকায়। এই মেশিনটি অপারেশন থিয়েটারে স্থাপন করা হয়েছে বলা হলেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে স্টোরকিপার আব্দুর রাজ্জাক দাবি করেছেন, ‘এই মেশিনটি আছে, হয়তো অন্য কোনো নামে কোথাও পড়ে আছে।’

চারটি থ্রি হেড কার্ডিয়াক স্টেথিসস্কোপের দাম দেখানো হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার পাঁচ’শ টাকা। এর দুটি সিসি ওয়ার্ড ও দুটি মেইল মেডিসিন ওয়ার্ডের দুই ইউনিটে আছে। এগুলোর ব্যবহার হয়।

দুটি ফাইবার অপটিক ল্যারিনগোসস্কোপ সেটের একটি প্রসূতি ওটিতে এবং একটি জেনারেল ওটিতে রয়েছে। এ দুটির দাম দেখানো হয়েছে ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

ছয়টি টোমেটিক স্কাব সিসটেম চালু আছে, যার দাম দেখানো হয়েছে ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ১০টি চাইনিজ সাকশন মেশিন অপারেশন থিয়েটারে আছে। দাম দেখানো হয়েছে তিন লাখ টাকা। বর্তমানে সেটি চালু আছে।

২০টি ড্র সিস্টেম ইকুইপমেন্টের দেখানো হয়েছে চার লাখ ৮৭ হাজার পাঁচ’শ টাকা। আইসিইউ ওয়ার্ডে স্থাপিত। বর্তমানে ওয়ার্ড চালু না থাকায় কোনো কাজে লাগছে না।

মেডিকেল কলেজ উন্নয়ন ও বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয়সংক্রান্ত প্রকল্পের অধীনে এ যন্ত্রপাতি কেনা হয় বলে জানা গেছে।

২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত মোট পাঁচজন চিকিৎসক প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

এরা হলেন- আ স ম জাহাঙ্গীর চৌধুরী, এ বি এম শামসুল আলম, মো. ওমর ফারুক খান, গণপতি বিশ্বাস ও আবুল কালাম আজাদ। এর মধ্যে ওমর ফারুখ খান মারা গেছেন বলে জানা গেছে।

হাসপাতালটির তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক ডা. গণপতি বিশ্বাস জানান, তিনি প্রকল্প পরিচালক থাকা অবস্থায় যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতির কোনো ঘটনা ঘটেনি। তিনি জানান, আদালতে কোনো বিষয়ে মামলা হয়েছে কিংবা আদালত কী নির্দেশনা দিয়েছেন তা তার জানা নেই।

ফমেকের তৎকালীন প্রজেক্ট ডিরেক্টর ডা. আ স ম জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেন, ‘আমি প্রথম প্রকল্প পরিচালক ছিলাম। যে কেনাকাটার কথা বলা হচ্ছে তা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। যা প্রকল্পের বিষয়ই ছিল না তার দায়ভার প্রকল্পের ওপর কেন বর্তাবে তা আমার বোধগম্য নয়।’

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক কামদা প্রসাদ সাহা জানান, আদালতের নির্দেশনা তিনি পাননি। পেলে তিনি আদালতের নির্দেশনা মেনে চলবেন। দুদক যদি তদন্ত করে তবে তাকে তিনি সহযোগিতা করবেন। তিনি জানান, ১০ কোটি টাকায় যে সব যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে তার মূল্য কিছুটা অতিরিক্ত দেখানো হয়েছে বলে তার ধারণা। তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts