বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ সংসদের লিখিত শোক প্রস্তাবে এরশাদকে ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি’ ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তার জীবনী তুলে ধরে বলা হয়, “হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে দেশ একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ, সফল রাষ্ট্রনায়ক এবং নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবককে হারাল।” আলোচনার পর এক মিনিট নীরবতা পালন ও মোনাজাত করা হয়। পরে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী রেওয়াজ অনুযায়ী সোমবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত সংসদের বৈঠক মুলতবি করেন।
আলোচনায় শেখ হাসিনা বলেন, “পঁচাত্তরে জাতির পিতার হত্যার পর জিয়া ক্ষমতা দখল করে। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এরশাদ প্রথমে মার্শাল ল‘ জারি করে এরপর নিজেই ক্ষমতা দখল করে নেন।
“উচ্চ আদালত এই ক্ষমতা দখলটাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। অবৈধ যখন ঘোষণা করেছেন, তখন আর এই দুজনের কেউ আর রাষ্ট্রপতি হিসেবে থাকেন না। হাই কোর্টের রায় অনুযায়ী, তাদের রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করা বৈধ নয়। এটাই বাস্তবতা।”
স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতার পটপরিবর্তনে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়া। তিনি এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর তখনকার সেনাপ্রধান এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন।
১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে এরশাদ ক্ষমতা হারানোর পরও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এরশাদ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পর পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূতও হন তিনি।
জিয়া ও এরশাদের ক্ষমতা দখলে আওয়ামী লীগের বিরোধিতার তথ্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “এক মিলিটারি ডিক্টেটর থেকে আরেক মিলিটারি ডিক্টেটর আসুক, সেটা কখনও আমাদের কাম্য ছিল না। এর বিরুদ্ধে আমরাই প্রতিবাদ করেছি। আমরা চেয়েছি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।”
এরশাদের ক্ষমতা দখলের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “জেনারেল এরশাদ সাহেব যে ১৯৮২ সালে যে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, সেই ক্ষমতা দখলের সুযোগটাই কিন্তু খালেদা জিয়াই করে দিয়েছিলেন। এই কারণেই তিনি খালেদা জিয়াকে শুধু দুটি বাড়িই না, নগদ ১০ লাখ টাকাসহ অনেক সুযোগ সুবিধা দিয়েছিলেন।
“যে কারণে জিয়ার হত্যার ব্যাপারে যে মামলা হয়েছিল, সেই মামলাটা বিএনপি চালায়নি। তবে, বহু বছর পরে ১৯৯১ সালে বা তার পরে খালেদা জিয়া জেনারেল এরশাদকে তার স্বামী হত্যার জন্য দায়ী করেছেন।”
এরশাদের আমলে আওয়ামী লীগের সংসদ নির্বাচনের অংশগ্রহণের প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত চেয়েছি বলেই অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। ওই নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হলে এ ধরনের বিতর্কিত হতে হত না। একটি গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠিত হতো। আবার নিজেই সেই সংসদ ভেঙে দিয়ে আবার বিতর্কিত হয়ে যান। এরপর ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে কোনো দল অংশগ্রহণ করেনি। তখন আন্দোলনের মুখে তিনি ১৯৯০ সালে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।”
বিএনপিসহ অধিকাংশ দলের বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য রওশন এরশাদকে ধন্যবাদ জানান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
“২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই নির্বাচনে যদি জনগণের অংশগ্রহণ না থাকত, আমরা ৫ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারতাম না।”
শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া কখনোই গণতান্ত্রিক ধারা মজবুত হয় না- মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে শুরু করে সকলে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু অংশগ্রহণ করেও তারা এই সংসদকে অবৈধ বা অনেক কিছু বলেও তারা সংসদে ফিরে এসেছেন। এজন্য তাদের সাধুবাদ জানাই। তাদের অংশগ্রহণে বিরোধী দল সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়েছে। গণতান্ত্রিক ধারাটা অব্যাহত আছে।
“তবুও তারা সংসদে বসেন, আবার বলেন নির্বাচনে ভোট দেয়নি। ভোট না দিলে তারা জনগণকে সাথে নিয়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির সরকারকে আমরা যেভাবে উৎখাত করেছিলাম, তারাও সেইভাবে সরকারকে উৎখাত করতে পারত। কিন্তু জনমর্থন নেই বলে তারা তা পারছে না।”
১৯৯১ সালে বিএনপির শাসনামলে এরশাদকে কারাবন্দি করার প্রসঙ্গ ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “এরশাদ সহেব যখন পদত্যাগ করেছিলেন, তাকে গ্রেপ্তার করা, বন্দি রাখা, রওশন এরশাদকে বন্দি করে দিনের পর দিন যে অকথ্য নির্যাতন করেছিল, কারাগারের ভেতরও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানকে হেয় করা হয়েছে।
“আমরা তো সেই ধরনের অভদ্র আচরণ করছি না। আমরা যথেষ্ট উদারতা দেখাচ্ছি। দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামি হলেও খালেদা জিয়াকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে।”
বঙ্গবন্ধুর শুরু করা সাভারে জাতীয় স্মৃতি সৌধ এবং শহীদ মিনারের কাজ সম্পন্ন করাসহ এরশাদের কিছু কাজের প্রশংসাও করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “এরশাদ সাহেবের অমায়িক আচরণ ছিল। মানুষের প্রতি তার দরদ ছিল।”
শোক প্রস্তাবের উপর আলোচনায় এরশাদের স্ত্রী বিরোধীদলীয় উপনেতা রওশন এরশাদ, তার ভাই জিএম কাদেরও অংশ নেন।
এছাড়াও আলোচনা করেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, শাজাহান খান, জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, মুজিবুল হক চুন্নু, পীর ফজলুর রহমান, তরীকত ফেডোরেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, বিএনপির হারুনুর রশীদ।