বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ পলাশ আহমেদ ওরফে মাহিবির পৈত্রিক সম্পত্তির খতিয়ান শুনে তাকে বিয়ে করেছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী অভিনেত্রী সামসুন নাহার সিমলা; বয়সের পার্থক্য ২০ বছর, মাত্র আট মাসেই তার সেই ভুল ভাঙে। চিত্রনায়িকা সিমলা ছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী।
পলাশ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি খেলনা পিস্তল উঁচিয়ে বিমানের একটি বোয়িং-৭৩৭ উড়োজাহাজ ছিনতাই করতে গিয়ে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে কমান্ডো অভিযানে নিহত হন। তার আগে তিনি ‘স্ত্রীর বিষয়ে’ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন বলে সে সময় জানিয়েছিলেন কর্মকর্তারা। পরে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের দুধঘাটা এলাকার পিয়ার জাহান সরদারের ছেলে পলাশের নাম রয়েছে র্যাবের ক্রিমিনাল ডেটাবেইজে।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কার্যালয়ে হাজির হয়ে পলাশের সঙ্গে আট মাসের দাম্পত্যের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন সিমলা, যিনি সিনেমার প্রয়োজনে মুম্বাইতেই বেশি থাকেন ইদানিং। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া সকাল ১০টা থেকে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা সিমালাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সিমলা আমাদের সাথে বেশ কিছু কথা বলেছে। তবে তা আমাদের যাচাই বাছাই করতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বেরিয়ে সিমলা উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, পলাশ কেন বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা করতে গেলেন, তা তিনি জানেন না। তিনি বলেন, আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের পর মনে হয়েছিল ওর মানসিক সমস্যা আছে। তাই তিক্ত হয়ে ডিভোর্স দিই।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, পলাশের সঙ্গে পরিচয়, বিয়ে, জটিলতার সূত্রপাত এবং বিচ্ছেদ নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন সিমলা। জিজ্ঞাসাবাদে এই অভিনেত্রী বলেছেন, ২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর গুলশানের একটি কফি শপে এক প্রযোজকের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে পলাশের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনি সে সময় জেনেছিলেন, পলাশ থাকেন ইংল্যান্ডে, দেশে সিনেমার প্রযোজনার সঙ্গে তিনি জড়িত। ওই অনুষ্ঠানেই দুজনের মধ্যে মোবাইল নম্বর দেওয়া নেওয়া হয়। তারপর বিভিন্ন সময়ে দেখা হয় দুজনের। এক পর্যায়ে পলাশকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় সিমলা।
২০১৮ সালের ৬ মার্চ পরিবারকে না জানিয়েই বিয়ে করেন তারা দুজন। ওই বছরের ৫ নভেম্বর পলাশকে তালাকের নোটিস পাঠান সিমলা। পলাশ শুরুতে নিজেকে ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন; বলেছিলেন, তার বাবা ইংল্যান্ডে ব্যবসা করেন। উত্তরায় তাদের বাড়ি আছে, যেখান থেকে ভাড়া পান। পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জে তাদের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি বানানো হচ্ছে। তবে বিয়ের কয়েক মাস পর সিমলা জানতে পারেন- ‘সব মিথ্যা’। পলাশের ‘প্রতারণার’ বিবরণ দিতে দিতে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন অভিনেত্রী সিমলা।
পরিচয়ের সময় তিনি পলাশকে চিনতেন মাহিবি জামান নামে। পরে জানতে পারেন, তার নাম পলাশ। প্রথমে শুনেছিলেন, ভালো ভালো কয়েকটি প্রযোজনা করেছে মাহিবি। তাই বয়সে ছোট হওয়ার পরও পলাশকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিয়ের পর বনানীতে পলাশের ভাড়া করা বাসায় থাকতে শুরু করেন সিমলা। পলাশ বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিক ডেকে বিয়ের বিষয়টি প্রকাশ করার জন্য চাপ দিতেন। তবে সিমলা এড়িয়ে যেতেন।
বিয়ের ১৫ দিন পর শুটিংয়ের কাজে সিমলা ভারতে যাওয়ার কথা বললে পলাশও তাকে ইংল্যান্ডে যাবেন বলে তাকে জানান। সে কারণে সিমলা বনানীর ওই বাসা ছেড়ে দিতে বলেন পলাশকে। বিয়ের চার মাসের মাথায় পলাশ একদিন মুম্বাইয়ে তার বাসায় গিয়ে হাজির হন। বলেন, ইংল্যান্ডে যাওয়ার পথে ট্রানজিটে সিমলার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। কিন্তু তিন দিন মুম্বাইয়ে থেকে যাওয়ায় সিমলার সন্দেহ হয়। তিনি প্রশ্ন করলে পলাশ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পাসপোর্ট দেখতে চাইলে পলাশ অস্বীকৃতি জানান। তখন থেকেই তাদের মধ্যে ঝামেলার সূত্রপাত।
এরপর পলাশ আরও একবার মুম্বাইয়ে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। বিভিন্ন সময়ে ভালো ভালো হোটেল থেকে ফোন করে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন যে ইংল্যান্ডেই আছেন। ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে সিমলা দেশে এসে পলাশের সঙ্গে তাদের নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে যান। তখনই পুরোপুরি নিশ্চিত হন, পলাশ তাকে যা কিছু বলেছেন, তার সবই মিথ্যা। এরপর থেকে সিমলা এড়িয়ে চলতে শুরু করেন পলাশকে।
সিমলা পুলিশকে বলেছেন, পলাশ একদিন ফোন করে গুলশান মোড়ে তাকে দেখা করতে যেতে বলেন। আগে থেকে ঘুমের ওষুধ খেয়ে পলাশ সেদিন সেখানে যান। এক পর্যায়ে মাটিতে পড়ে গেলে লোকজন তাকে তুলে হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে যায়। এরপরও পলাশ বিভিন্ন সময়ে ফোন করেছেন। তবে সিমলা রিসিভ করতেন না বলে জানিয়েছেন। তবে এসএমএস দিলে তা পড়তেন।
পলাশের কারণে বিরক্ত হয়ে সিমলা একবার বনানী থানায় অভিযোগ করতেও গিয়েছিলেন। থানা থেকে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হলে ‘পলাশের প্রতি মায়ার কারণে’ লিখিত অভিযোগ করা থেকে বিরত ছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন সিমলা। নভেম্বরে তালাকনামা পাঠানোর পরও বিভিন্ন সময়ে পলাশ তাকে ফোন করতেন। ফেব্রুয়ারিতে মুম্বাইয়ে থাকা অবস্থায় টেলিভিশনের খবরে বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে পলাশের নিহত হওয়ার তথ্য তিনি জানতে পারেন।