আরিফুল ইসলাম, টাঙ্গাইল প্রতিনিধি: প্রতারণা করে বড় ভাইয়ের নাম নিজের বলে চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উত্তোলন করার অভিযোগ উঠেছে নবাব আলীর বিরুদ্ধে। বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম খসরু প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত থাকার সুযোগে ছোট ভাই নবাব আলী তার নাম খোরশেদ আলম দাবি করে নিজের ছবি মুক্তিযোদ্ধা কার্ডে লাগিয়ে ভাতা উত্তোলন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাটি ঘটেছে টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ফুলকী মধ্যপাড়া গ্রামে। তারা ওই এলাকার মৃত নূর মোহাম্মদ মিয়ার ছেলে।
জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম প্রায় ২৫ বছর আগে প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হন। বর্তমানে তিনি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। খোরশেদ আলম বিছানা থেকে উঠতে না পেরে ওই সময় থেকে তার আপন ছোট ভাই নবাব আলীকে দিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধার ভাতাকার্ড পাবেন কিনা এ সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন। এসময় নবাব আলীর কাছে খোরশেদ আলমের মুক্তিযোদ্ধাসংক্রান্ত কাগজপত্র দেন।
খোরশেদ আলম ভাতা সম্পর্কে মাঝে-মধ্যে নবাব আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি ভাতা সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য দিতেন না। গত ২০০০ সাল থেকে খোরশেদ আলমের নামে মুক্তিযোদ্ধা ভাতাকার্ড চালু হলেও নবাব আলী বিষয়টি গোপন রেখে কার্ডে নিজের ছবি লাগিয়ে ও নিজেকে খোরশেদ আলম দাবি করে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উত্তোলন করছেন। খোরশেদ আলমের নামে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা চালু হয়েছে কিনা ওই সময় তিনি জানতেন না। পরবর্তীতে গত ৩ বছর আগে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে বয়স্ক ভাতাকার্ড করতে গিয়ে তার নামে মুক্তিযোদ্ধা ভাতাকার্ড রয়েছে এমন তথ্য জানতে পারেন। পরে বিষয়টি সম্পর্কে সমাজসেবা কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করেন।
এরপর ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে খোরশেদ আলমের ছেলে মান্নান মিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর নবাব আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন। ওই সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তার (খোরশেদ আলম ) মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা স্থগিত করেন। এরপর প্রায় এক বছর ভাতা উত্তোলন স্থগিত থাকলেও রহস্যজনক কারণে আবার ভাতা চালু হয়। পরবর্তীতে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে খোরশেদ আলম বাদি হয়ে টাঙ্গাইলের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বাসাইল আমলী আদালতে মামলা দায়ের করেন।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৮ ভাই-বোনের মধ্যে খোরশেদ আলম তৃতীয় ও নবাব আলী চতুর্থ। ন্যাশনাল ভোটার আইডি কার্ডসহ বিভিন্ন জরুরি কাগজপত্রে খোরশেদ আলম ও নবাব আলীর নাম রয়েছে আলাদা আলাদা। এছাড়াও খোরশেদ আলম ও নবাব আলীর সন্তানদেরও কাগজপত্রে রয়েছে আলাদা নাম। স্থানীয় ফুলকি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কর্তৃক ওয়ারিশ সনদ ও প্রত্যয়ন পত্রেও দেখা গেছে খোরশেদ আলম ও নবাব আলী পৃথক ব্যক্তি।
স্থানীয়রাও জানান খোরশেদ আলম ও নবাব আলী আপন দুই ভাই। খোরশেদ আলমের ডাক নাম খসরু ওরফে খোরশেদ আলম ও নবাব আলীর কোনো ডাক নাম নেই। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম বাবুলের উপস্থিতিতে এলাকায় একাধিকবার সালিশি বৈঠক হলেও সেখানে কোনো মীমাংসা হয়নি।
এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম বাবুল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
খোরশেদ আলমের স্ত্রী মরিয়ম বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী প্রায় ২৫ বছর আগে প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধার ভাতা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য আমার দেবর নবাব আলীর কাছে কাগজপত্র দেয়া হয়। মাঝে-মধ্যে নবাব আলীর কাছে জিজ্ঞাসা করলেও তিনি এ সম্পর্কে কিছু জানায়নি। প্রায় তিন বছর আগে আমার স্বামীর নামে বয়স্ক ভাতাকার্ড করতে গিয়ে জানতে পারি তার নামে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা চালু হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে দেখা যায় নবাব আলী প্রতারণা করে আমার স্বামী খোরশেদ আলমের ছবি পরিবর্তন করে ভাতা উত্তোলন করছে। পরে বিষয়টি সমাজসেবা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানো হয়। কিন্তু এতেও কোনও কাজ হচ্ছে না। নবাব আলী এখনো আমার স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উত্তোলন করছে।’
খোরশেদ আলমের মেয়ে বিলকিস বেগম বলেন, ‘আমার বাবা অসুস্থ্য ও অশিক্ষিত থাকায় ছোট চাচা নবাব আলীকে দিয়ে ভাতা সম্পর্কে খোঁজ নিতেন। কিন্তু প্রতারণা করে আমার বাবার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নবাব আলী উত্তোলন করছেন। এঘটনায় নবাব আলীর বিরুদ্ধে প্রতারণা করার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছি। এছাড়াও বিভিন্ন দপ্তরের অভিযোগ দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নবাব আলী প্রভাবশালী থাকায় জোর খাটিয়ে আমার বাবার নামের ভাতা এখনো তুলে খাচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও কোনও প্রতিকার পাচ্ছি না।’
অভিযুক্ত নবাব আলীর বাড়িতে গিয়ে তার ভোটার আইডি কার্ডসহ বিভিন্ন কাগজপত্র দেখতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাগজপত্র আমার মেয়ের জামাইয়ের কাছে রয়েছে। আপনারা কিছু জানতে চাইলে ইউএনও’র সাথে যোগাযোগ করেন।’ কথাটি বলে তিনি দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়ে যান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামছুন নাহার স্বপ্না বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলমের নামে ভাতা চালু রয়েছে। ভাতাও উত্তোলিতও হচ্ছে। পরবর্তীতে খোরশেদ আলমের পরিবার অভিযোগ করে- তার ছোট ভাই নবাব আলী প্রতারণা করে ভাতা উত্তোলন করছেন। পরে বিষয়টি নিয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের তদন্তে উঠে আসে খোরশেদ আলম ও নবাব আলী একই ব্যক্তি।’
এদিকে ইউএনও খোরশেদ আলম ও নবাব আলী একই ব্যক্তি বললেও পিবিআই বলছে তারা দুজন ভিন্ন ব্যক্তি। আদালতের নির্দেশে পিবিআই খোরশেদ আলমের দায়েরকৃত মামলাটি তদন্ত করে। তদন্ত শেষে পিবিআই-এর এসআই ফরিদ আহমেদ তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন- খোরশেদ আলম ও নবাব আলী একই ব্যক্তি নন। নবাব আলী খোরশেদ আলমের আপন ছোট ভাই।
এলাকাবাসীর দাবি, খোরশেদ আলম ও নবাব আলী দুই ভাই। খোরশেদ আলম বড়। নবাব আলী ছোট। অথচ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সমাজসেবা কার্যালয়ের তদন্তে দুজনকে একই ব্যক্তি অভিহিত করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এলাকাবাসী।