অনির্দিষ্টকালের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা

জাবি প্রতিনিধি: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) দুর্নীতির অভিযোগে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিত হামলা করেছে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ হামলার ঘটনায় ৪ সাংবাদিক ও ৬ শিক্ষক সহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছে। গুরুতর আহত ৮ জনকে সাভারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।

এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক জরুরী সিন্ডিকেট সভা আহবান করে অনির্দিষ্টকালের জন্য হল বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটায় উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবনে অনুষ্ঠিত জরুরি সিন্ডিকেট সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদেরকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ও সিন্ডিকেট সচিব রহিমা কানিজ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে বেলা ১১টার দিকে উপাচার্যপন্থী শিক্ষক, কর্মকর্তা- কর্মচারীরা শহীদ মিনার থেকে একটি মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের দিকে যায়। মিছিলটি উপাচার্যের বাসভবনে প্রবেশ করতে চাইলে সেখানে অবস্থানরত আন্দোলনকারীরা তাদেরকে বাধাগ্রস্ত করেন। এদিকে বেলা পৌনে বারোটার দিকে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বর থেকে একটি বিােভ মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ছাত্রলীগ উপাচার্যের বাসভবনে উপস্থিত হলে উপাচার্যপন্থী আট-দশজন শিক্ষক আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করার জন্য বলে। উপাচার্যপন্থী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ‘ধর ধর’, ‘জবাই কর’ স্লোগান দিয়ে হামলায় উস্কানি দিতে দেখা যায়। একপর্যায়ে আন্দোলনে ‘শিবির’ আছে আখ্যা দিয়ে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এসময় হিন্দু ধর্মাবম্বলী এক আন্দোলনকারীকেও শিবির আখ্যা দিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা মারধর করে।

ছাত্রলীগের হামলায় আহত শিক্ষকরা হলেন- নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাইদ ফেরদৌস, মীর্জা তাসলিমা সুলতানা, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার হাসান মাহমুদ, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা সহ আরো কয়েকজন।

আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে দর্শন বিভাগের মারুফ মোজাম্মেল, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মাহাথির মুহাম্মদ, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সাইমুম ইসলাম, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের রাকিবুল ইসলাম রনি, ইংরেজি বিভাগের আলিফ মাহমুদ, অর্থনীতি বিভাগের উল্লাস,  দর্শন বিভাগের রুদ্রনীল, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সৌমিক বাগচীর নাম জানা গেছে।

এছাড়া সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৪তম আবর্তনের ছন্দা ও ৪৭ তম আবর্তনের সাউদা নামের দুই নারী শিক্ষার্থীকেও মারধর করতে দেখা গেছে।

মারধরের সংবাদ সংগ্রহের সময় আহত সাংবাদিকরা হলেন- প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, মাইদুল ইসলাম, বার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধি আজাদ, বার্তাবাজারের প্রতিনিধি ইমরান হোসাইন হিমু, বাংলা লাইভ টোয়েন্টিফোরের প্রতিনিধি আরিফুজ্জামান উজ্জল।

হামলা চলাকালে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশকে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এদিকে উপাচার্যপন্থী কয়েকজন শিক্ষককে সামনে থেকে হামলায় নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। এসময় প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও শহীদ রফিক জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ সোহেল আহমেদ, পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও আল বেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ আশরাফুল আলম, গণিত বিভাগের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এটিএম আতিকুর রহমান, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী, পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের প্রভাষক ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদুর রহমান জনি, নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. মোসাব্বের হোসেন, ইন্সটিটিউট অব রিমোট সেনসিং- এর মো. মনির হোসাইন সহ কর্মকর্তা- কর্মচারীরা মারধরে অংশগ্রহণ করেন।

ছাত্রলীগের মারধরের বিষয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষক পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খবির উদ্দিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এরকম ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। উপাচার্যপন্থী শিক্ষকদের উপস্থিতি ও প্রত্যক্ষ উস্কানিতে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। ছাত্রলীগ যখন আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে তখন ভিসিপন্থী শিক্ষকরা তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে হাততালি দিয়েছে।’

হামলার বিষয়ে আন্দোলকারীদের মুখপাত্র দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, ‘আন্দোলনে কোন শিবির সংশ্লিষ্টতা নেই। যেকোন শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য শিবির অপবাদ দেয়াটা পুরোনো অপকৌশল। বুয়েটের আবরারকে এভাবেই হত্যা করা হয়েছে, এখানেও একইভাবে অভিযোগ তুলে হামলা চালানো হয়েছে।’ প্রশাসন দুর্নীতি ঢাকার অপকৌশল হিসেবে এ হামলা করিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘হামলা করে এ আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। আমাদের শেষ রক্তবিন্দু অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে।’

হামলার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ.স.ম. ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ‘ঘটনাস্থলে এক ধরণের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা চেষ্টা করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। বড় ঘটনা এড়াতে আমরা তৎপর আছি।’

মারধরের ঘটনার আধাঘন্টা পরে উপাচার্য তার সমর্থক শিক্ষকদের সাথে নিয়ে তার কার্যালয়ে যান। পরে সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার সহকর্মী ও ছাত্রলীগ কর্মীদের ‘গণ অভ্যূত্থান’ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ জানান।’ পরবর্তীতে বিকাল তিনটায় এক জরুরি সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিকাল পাঁচটার মধ্যে সকল শিক্ষার্থীদেরকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়।

এদিকে হল বন্ধ ঘোষণা ও হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার বিকাল চারটায় আন্দোলনকারীরা পাঁচ শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে বিক্ষোভ মিছিল করেছে।

এর আগে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের আলোচনায় কার্যত কোন সমাধান না আসায় অবশেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামকে অবরুদ্ধ করা হয়। সোমবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয় পুরাতন প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে একটি মিছিল বের করে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করে অবরোধ কর্মসূচী শুরু করে।

এমএম/বিডিমেট্রোনিউজ

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts