বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বৃহস্পতিবার বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানিকে কেন্দ্র করে ২১০ মিনিটের ‘নজিরবিহীন’ হট্টগোল হয়ে গেল।
আপিল বিভাগের পূর্বের আদেশ অনুযায়ী আদালতে খালেদা জিয়ার সর্বশেষ স্বাস্থ্যগত অবস্থার মেডিকেল প্রতিবেদন দাখিলের কথা ছিল। কিন্তু সকাল ৯ টা ৪৫ মিনিটে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত প্রতিবেদন দিতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সময় আবেদন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এরপর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ আগামী ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে মেডিক্যাল প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়ে খালেদা জিয়ার জামিন শুনানির জন্য ১২ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) দিন ধার্য করেন।
এসময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাই লর্ড বৃহস্পতিবার না, শুনানিটা রোববার দিন, না হয় সোমবার দিন। এসময় বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা বলতে থাকেন বৃহস্পতিবার না, বৃহস্পতিবার না। রোববার শুনানির দিন ধার্য করা হোক। একপর্যায়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা তুমুল চিৎকার ও হট্টগোল করতে থাকেন। এর কাউন্টারে আদালতে উপস্থিত আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরাও চিৎকার করতে থাকেন। পরবর্তীকালে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা বলতে থাকেন; আমারা কোর্ট থেকে যাব না, আজ কোর্ট ছাড়ব না। এরকম চিৎকার ও হট্টগোলের প্রেক্ষাপটে ঠিক সকাল ১০ টায় এজলাস থেকে উঠে চলে যান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। কিন্তু বিচারপতিরা চলে যাওয়ার পরও বিএনপি-সমর্থক আইনজীবীরা আদালত কক্ষে বসে থাকেন।
এরপর সকাল ১০ টা ৪৫ মিনিটে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস সহ আওয়ামীলীগ পন্থী আইনজীবীরা আপিল বিভাগ থেকে বেরিয়ে যান। এসময় আদালত কক্ষেই বিএনপি পন্থী আইনজীবীদের মধ্যে চলকেট বিতরণ চলে। সেই সাথে চলে খালেদার জামিনের পক্ষে বিভিন্ন শ্লোগান।
বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এজলাসে আসেন। এসময় কার্যতালিকায় থাকা অন্য মামলা শুনানির জন্য কল করা হয়। তখন আদালত কক্ষে অবস্থান করা বিএনপি-সমর্থক আইনজীবীরা আবার হইচই শুরু করেন। তারা উই ওয়ান্ট জাস্টিস, খালেদা জিয়ার জামিন চাই বলে স্লোগান দিতে থাকেন। এসময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন আবার ডায়াসে দাঁড়িয়ে বলেন: ‘মাই লর্ড আগের অর্ডারটা রিভিউ করুন প্লিজ। আগামী শুনানির দিন রোববার করে দিন।’
এর উত্তরে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘অর্ডার তো হয়ে গেছে, এখন আর নতুন করে কিছু করা সম্ভব নয়। আমরা এখন আর কিছু শুনব না।’ আদালতে থাকা বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা এসময় আবার চিৎকার শুরু করেন। তখন প্রধান বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে উদ্দেশ করে বলেন; ‘বাড়াবাড়ির একটা সীমা থাকা দরকার। আজ কোর্টে যে অবস্থা হল সেটা নজিরবিহীন।’
এসময় খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি শেষবারের মতো একটা কথা বলতে চাই।’ তখন আদালত তাকে বলেন, ‘আমরা এবিষয়ে আদেশ দিয়েছি। এখন আর কোনো কথা শুনব না।’ তখন খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন শুনানির তারিখ এগিয়ে আনার প্রার্থনা জানালে আদালত বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত দিয়েছি, তাই জামিন শুনানির বিষয়টি বৃহস্পতিবার শুনব।’
এরপর আজকের কার্যতালিকায় থাকা অন্য মামলার শুনানির জন্য কল করা হলে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা আবার চিৎকার করে বলতে থাকেন: ‘অন্য কোনো মামলা শুনানি নয়। উই ওয়ান্ট জাস্টিস। খালেদা জিয়ার জামিন চাই।’ একপর্যায়ে তারা সিট থেকে সবাই দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে দিতে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে তুমুল হইচই করতে থাকেন। এসময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, খন্দকার মাহবুব হোসেন, জমিরুদ্দিন সরকার, মওদুদ আহমদ, নিতাই রায় চৌধুরী, মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ অন্য আইনজীবীরা আদালত থেকে বের হতে গেলে বিএনপিপন্থী জুনিয়র আইনজীবীরা তাদের যেতে না দিয়ে আগলে রাখে।
বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে আদালতের কার্যতালিকায় থাকা তার ৯ নাম্বার মামলা শুনানির জন্য ডায়াসে দাঁড়ান আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি। এসময় বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা টেবিল চাপড়ান। এবং চিৎকার করে বলতে থাকেন খালেদা জিয়ার জামিন শুনানি ছাড়া আর কোনো শুনানি আজ হবে না। এরকম হৈচৈর মাঝেই সরকার সমর্থক ও বিএনপিপন্থী কিছু আইনজীবীর মধ্যে হালকা ধাক্কাধাক্কি হয়। ওদিকে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে টানা চলতে থাকে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের স্লোগান। একপর্যায়ে ১২ টা ১৫ মিনিটে তুমুল হৈচৈর প্রেক্ষাপটে আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি তার শুনানি বন্ধ করে ডায়াসে দাঁড়িয়ে থাকেন। আর এজলাসে বসে থাকেন আপিল বেঞ্চের ছয় বিচারপতি।
এসময় বিএনপিপন্থী এক তরুণ আইনজীবী দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেন, ‘আমার ফাঁসি দিন, তবু খালেদা জিয়ার জামিন দিন।’ আবার আদালতের সামনের সারিতে থাকা এক নারী আইনজীবী হাত জোড় করে বলতে থাকেন যে, ‘আপনারা ন্যায় বিচার করুন। খালেদা জিয়ার জামিন দিন।’ এরকম দৃশ্যপটের পর দুপুর ১ টা ১৫ মিনিটে আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি যে মামলা শুনানির জন্য দাঁড়িয়েছিলেন, সেটি শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করে এজলাস ত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। এরপর আদালত কক্ষ থেকে বের হন বিএনপি ও আওয়ামীলীগ পন্থী আইনজীবী। এর মধ্য দিয়েই খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানিকে কেন্দ্র করে আপিল বিভাগে ২১০ মিনিটের ‘নজিরবিহীন’ হট্টগোল শেষ হয়।
এর আগে গত ২৮ নভেম্বর খালেদা জিয়ার অসুস্থতার বিষয়টি উল্লেখ করে তাকে চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় মানবিক কারণে জামিন দিতে তার আইনজীবী আপিল বিভাগে আবেদন করেন। এরপর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আদালতে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে মেডিক্যাল বোর্ডের প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। এবং ৫ ডিসেম্বর এবিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করা হয়। সে অনুযায়ী আজ বিষয়টি শুনানির জন্য আসে।
এর আগে এই মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে দেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ। সে খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে গত ১৪ নভেম্বর আপিল বিভাগে আবেদন করে জামিন চান খালেদা জিয়া।
গত বছরের ১৮ নভেম্বর এ মামলায় ৭ বছরের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন খালেদা জিয়া। সে আপিলে বিচারিক আদালতের দেয়া সাজার রায় বাতিল এবং মামলা থেকে খালাস চাওয়া হয়। সেই সাথে জামিন আবেদনও করা হয়।
এর আগে ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আখতারুজ্জামান খালেদা জিয়াকে এ মামলায় ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন। মামলার বাকি সব আসামিকেও একই সাজা দেয়া হয় এবং ট্রাস্টের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের ঘোষণা করেন আদালত।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা লেনদেনের অভিযোগে বেগম খালেদা জিয়াসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন।
এ মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে ছিলেন, বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর সাবেক এপিএস জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার এপিএস মনিরুল ইসলাম।
সর্বশেষ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ বছরের সাজার রায় ঘোষণার পর বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়া হয়। বর্তমানে তিনি চিকিৎসার জন্য বিএসএমএমইউ হাসপাতালে রয়েছেন।