জামিন হয়নি খালেদা জিয়ার

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জামিন হয়নি বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। ‘মানবিক কারণে’ করা জামিন আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।

গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৬ সদস্যের বেঞ্চ আবেদনটি খারিজ করে দেন। তবে খালেদা জিয়া সম্মত হলে উন্নত চিকিৎসা করাতে মেডিক্যাল বোর্ডকে নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। বেলা ১টা ১৬ মিনিটে আদালত সর্বসম্মতভাবে এই আদেশ দেন।

জামিন আবেদন নাকচ করে দেয়ার পর রাজধানীসহ সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি।

বৃহস্পতিবার খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানিকে কেন্দ্র আদালত অঙ্গনসহ সারাদেশে ছিল উত্তেজনা। এজলাসের ভেতরে গতকাল কোনো হট্টগোল না হলেও এজলাসের বাইরে আইনজীবীদের হট্টগোল, মিটিং, মিছিল, সংবাদ সম্মেলন, পাল্টা সম্মেলন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নামে চলে ব্যাপক তল্লাশি, প্রতিবাদ সভা ও মিছিল।
পাল্টা মিছিল করে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের মুখোমুখি অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরাও।
বিচারাঙ্গনের বাইরে রাজধানীসহ সারাদেশে বিক্ষোভ করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন। নিরাপত্তার নামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। ঘটে গ্রেফতারের ঘটনাও। ৫ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতির এজলাসে অচলাবস্থা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে গতকাল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয় আদালতের ভেতর। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানোর পাশাপাশি ওই আদালতে আইনজীবীদের প্রবেশে আরোপ করা হয় কড়াকড়ি। গণমাধ্যমকর্মীদেরও প্রবেশ করানো হয় পরিচয় নিশ্চিত হয়ে। দেহ তল্লাশি করে। গোয়েন্দা সংস্থার বাড়তি সতর্কতা ছিল। প্রধান বিচারপতির এজলাসের প্রবেশদ্বারে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ।

পূর্বনির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ১২ নম্বরে ছিল খালেদা জিয়ার জামিন শুনানির বিষয়টি। সকাল সোয়া ৯টায় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ এসলাসে ওঠেন। এজলাসজুড়ে বিপুলসংখ্যক আইনজীবী দেখে তিনি প্রথমেই গত ৫ নভেম্বর সৃষ্ট অচলাবস্থার কথা উল্লেখ করেন। আদালত বলেন, এজলাসের ভেতর এত আইনজীবী কেন? আমরা তো আজ আইনজীবীদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেছি। আপিল বিভাগের তালিকাভুক্ত আইনজীবী ছাড়া বাকিরা প্রবেশ করতে পারবে না।

এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আপিল বিভাগে আইনজীবীদের শুনানি শ্রবণ নিয়ে একটি রায় রয়েছে। অনুমতি পেলে সেটি পড়ে শোনাতে চাই। আদালত তখন বলেন, সবার এই শুনানির প্রয়োজন আছে কি? আমরা উভয় পক্ষের (খালেদা জিয়া এবং সরকারপক্ষীয় আইনজীবী) ৩০ জন করে আইনজীবীকে অনুমতি দেবো। বাকিরা এজলাসের বাইরে থাকবেন। এ জন্য ৫ মিনিট সময় দিয়ে খাস কামরায় চলে যান আদালত। এ সময় খালেদা জিয়ার সমর্থক আইনজীবীদের কেউ কেউ এজলাসের বাইরে চলে গেলেও সরকার সমর্থক আইনজীবীরা অনড় থাকেন। অ্যাটর্নি জেনারেল কাউকে কাউকে চলে যেতে বললেও তারা ভেতরেই অবস্থান করেন। ১০ মিনিট পর আদালত ফের এজলাসে ওঠেন। তখনও বিপুল সংখ্যক আইনজীবীর উপস্থিতি দেখে আদালত বলেন, আপনারা কেউ কথা রাখলেন না। তবে ১২ নম্বর আইটেমের (খালেদা জিয়ার জামিন) শুনানিকালে আপনারা কিন্তু ৩০:৩০ জন আইনজীবীর বাইরে কেউ থাকতে পারবেন না। পরে ১২ নম্বরের শুনানির সময় প্রধান বিচারপতির এজলাস আবারো জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে। খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মো. জয়নুল আবেদীন ও খন্দকার মাহবুব হোসেন। সরকারপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান।

জামিন আবেদনের শুরুতেই আদালতের কাছে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য বিষয়ে মেডিক্যাল বোর্ডের প্রতিবেদন জমা দেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর। পরে খালেদা জিয়ার আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও খন্দকার মাহবুব হোসেন। জামিনের আবেদনের বিরোধিতা করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। দাখিলকৃত প্রতিবেদনের আলোকে খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার বিষয়টি শুনানিতে উঠে আসে। এরপর মানবিক বিবেচনায় খালেদা জিয়াকে জামিনের আবেদন জানিয়ে তার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন শুনানিতে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ প্রসঙ্গ টেনে আনেন।

তিনি বলেন, মাই লর্ড, যে পাকিস্তানকে আমার বর্বর দেশ বলে জানি সেই পাকিস্তানের উচ্চ আদালতই মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে সে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জামিন দিয়েছেন পাকিস্তান কোর্ট। এমনকি জামিনে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠিয়েছে। তাই আমরাও আপনাদের কাছে মানবিক বিবেচনায় খালেদা জিয়ার জামিন চাইতে পারি। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত অবস্থা এমন যে, তার শরীরে মেডিসিন পুশ করা যাচ্ছে না। এভাবে আর ৬ মাস পর হয়তো কারাগার থেকে তার লাশ বের হবে। তাই আমরা মানবিক বিবেচনায় জামিনের জন্য আপনাদের কাছে এসেছি। ওপরে আল্লাহ ছাড়া আর আপনারা ছাড়া আমাদের তো যাবার আর কোনো জায়গা নেই। তাই বারবার আপনাদের কাছে আসি। আপনারা ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্তকেও জামিন দিয়েছেন। আপনাদের এই আদালতেরই সিদ্ধান্ত আছে নারী ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে জামিন বিবেচনা করার। উনি অসুস্থ, হাঁটাচলা করতে পারেন না। উনি তো আর পালিয়ে যাবেন না। তাই ওনাকে মানবিক বিবেচনায় জামিন দেয়া হোক।

পরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম খালেদা জিয়ার জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, ওনার যথাযথ চিকিৎসা চলছে। যে সমস্ত অসুখ-বিসুখের কথা বলছেন এসব পুরনো। আগে থেকেই তার ট্রিটমেন্ট চলছে। তার অসুখগুলো ভালো হবে না। আমৃত্যৃ তার ট্রিটমেন্ট চালিয়ে যেতে হবে।

উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত বেলা ১টায় জানান যে, আজই (বৃহস্পতিবার) আদেশ দেয়া হবে। এ জন্য বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরগণের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। এ কথা বলেই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ৬ বিচারপতি খাস কামরায় চলে যান। ৮ মিনিটের মাথায় তারা এজলাসে ফিরে আসেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে উপরোক্ত আদেশ দেন। আদেশের পর উভয় পক্ষের আইনজীবীরা জানান, মেডিক্যাল রিপোর্টে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসা বা ‘অ্যাডভান্স বায়োলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট’-এর পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

Print Friendly

Related Posts