খান মাইনউদ্দিন, বরিশাল : বরিশাল নদী বন্দরে প্রকাশ্যেই চলছে চাঁদাবাজি। আর বন্দরের কর্মচারীরা দৈনিক অর্ধলাখ টাকা আত্মসাত করছে টিকিটসহ বিভিন্নভাবে। পুরো বিষয়টি বন্দর কর্মকর্তা জানলেও কিছু করার নেই বলে জানিয়েছেন।
আর বছরের পর বছর এমন চাঁদাবাজিতে হয়রানির যাতাকলে পিষ্ঠ যাত্রী ও ব্যবসায়ীরা। যাত্রীরা সরকারি কর্মচারীদের হাতে জিম্মিদশা থেকে পরিত্রাণ চান।
অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএর জমিতে অবস্থিত দুটি বাজারে স্থানীয় নেতা পরিচয়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজী চললেও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে ব্যবসায়ীরা গুনছে অতিরিক্ত টাকা। সেই সাথে টোলের নামে অনির্ধারিত টাকা গুনছে মালামালবহনকারী পরিবহনগুলো।
এই অব্যবস্থাপনা চলছে বিআইডব্লিউটিএ’র মালিকানাধীন ডিসিঘাট এলাকা থেকে শুরু করে পোর্টরোড এলাকা পর্যন্ত।এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয় বন্দরের প্রবেশের টিকিট নিয়ে।
জানা গেছে, বিআইডব্লিউটিএ’র শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃত্বে প্রবেশ টিকিট আত্মসাতের বৃহৎ একটি চক্র গড়ে উঠেছে। এই সংগঠনের অর্ন্তভুক্ত কর্মচারীরা প্রতিদিন চারটি গেটে দায়িত্ব পালনকালে একই টিকিট দফায় দফায় বিক্রি করে থাকে। নিয়ম হলো প্রবেশ টিকিট (মূল্য ১০ টাকা) যাত্রীদের কাছে বিক্রির পর তা আবার রেখে তাৎক্ষনিক ছিড়ে ফেলবে। কিন্তু তা না করে লোক দেখানো হাতেগোনা কিছু টিকিট ছিড়ে নিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখে। বাকি প্রবেশ টিকিটগুলো সংগ্রহ করে পকেটে জমিয়ে আবার তা কাউন্টারে ফেরত দেয়। এভাবে একটি টিকিট কয়েক দফায় বিক্রি করে সেই টাকা কর্মচারীরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, দিনভর টিকিট জমিয়ে তা বিক্রি করে কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কর্মচারীরা। যার মাধ্যমে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
সরেজমিনে (৬ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭ টা) দেখা গেছে, শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের একজন ১নং ঘাটের কাউন্টারে বসে আছেন। তার সামনের একজন কর্মচারী ডেকে ডেকে যাত্রীদের ১০ টাকার বিনিময়ে টিকিট সংগ্রহ করতে উদ্বুদ্ধ করছেন। যাত্রীরা টিকিট সংগ্রহ করে সেই টিকিট ছেড়ার জন্য ওই কর্মচারীর হাতে ফেরৎ দিলেও তিনি তা না ছিড়ে নিজের পকেটে রাখছেন। কিছুসময় পরে টিকিট বেশি জমলে তা আবার ফেরৎ দিচ্ছেন ইউনিয়ন নেতার কাছে। এভাবে একই টিকিট কয়েক দফায় বিক্রি করা হচ্ছে। বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে ওই নেতা কোন কথা বলতে রাজি হননি। তিনি সিবিএ সভাপতির মোবাইল নাম্বার দিয়ে তার সাথে কথা বলতে বলেন। এ বিষয়ে সভাপতির সামনাসামনি কথা বলার অনুরোধ জানিয়ে বলেন- তিনি ঢাকা থেকে আসবেন। তার আগে যেন সংবাদ প্রকাশ না করা হয়। তিনি এসে ‘রফাদফা’ করবেন।
বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তার কার্যালয়ে যোগাযোগ করলেও নিয়মিত কতটাকা টিকিট ও টোলবাবদ উত্তোলন করা হয় তার সুনির্দিষ্ট কোন হিসেব কেউ দেখাতে পারেনি। বন্দরে কর্মরত কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বন্দর কর্মকর্তা আজমল হুদা মিঠুর সাথে যোগাযোগ করার জন্য বলেন। তাকে মুঠোফোনে জিজ্ঞাসা করলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
যদিও এর আগে বন্দর কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, টিকিট না ছেড়ার বিষয়ে শুধু বরিশালের নেতারা নন, কেন্দ্রও ওয়াকিবহাল। কিন্তু এ বিষয়ে যাত্রীরা সচেতন না হলে প্রতিরোধ সম্ভব নয়। তিনি জানান, টিকিট ও টোল বাবদ নূন্যতম দিনে কত আদায় হয় তা না হিসেব করে বলতে পারবেন না।
ওদিকে সিটি মার্কেট সংলগ্ন পাইকারী কাঁচাবাজারের সামনে বিআইডব্লিউটিএর নির্ধারিত টোল নামেমাত্র রশিদ দিয়ে উত্তোলন করেন দায়িত্বরতরা। অভিযোগ রয়েছে প্রতিদিন কয়েকটি পরিবহনে রশিদের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করলেও পরে রশিদ ছাড়াই টাকা উত্তোলন করে বিআইডব্লিউটিএর কর্মচারীরা। সেই টাকার হিসেবে অফিস পায় না।
এছাড়া পাইকারী এই কাঁচাবাজারে বিআইডব্লিউটিএর কর্মচারীদের সাথে চাঁদা উত্তোলন করেন স্থানীয় কিছু নেতা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাঁচাপন্য পরিবহনের জন্য আকার ভিত্তিতে টাকা দিতে হয়। এরমধ্যে হলুদ অটো, মাহিন্দ্রা প্রতি ৩০ টাকা, পিকআপ ৫০ টাকা, মাঝারি ট্রাককে ১০০ টাকা করে দিতে হয়। ভ্যান বা রিকশা প্রতি ১০ টাকা করে দিতে হয়। রশিদ ছাড়া এই হারে টাকা যেমন উত্তোলন করেন বিআউডব্লিউটিএ’র কর্মচারীরা তেমনি উত্তোলন করেন আবুল, শাহাদাৎ, মানিক, সাদ্দাম নামের কয়েকজন। এরমধ্যে মানিক উত্তোলন করেন ডিসি ঘাট এলাকায়। আবুল টাকা উত্তোলন করেন নাবিক বিশ্রামাগার এলাকায়। আর সাদ্দাম টাকা উত্তোলন করেন খেয়াঘাট এলাকায়। ওদিকে পোর্ট রোডের মুখে আরও একটি গ্রুপ নিয়মিত গাড়ি থেকে টাকা উত্তোলন করে থাকেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পাইকারী কাঁচা বাজারে প্রতিদিন কমপক্ষে শতাধিক ট্রাক পন্য আনা নেওয়া করে। সেই পন্যগুলো নগরীর বিভিন্ন বাজারে বয়ে নিয়ে যেতে আরও কমপক্ষে দেড়শতাধিক থ্রি-হুইলার ওই এলাকায় আসে। আর ভ্যান-রিকশার বিষয়ে সঠিক কোন পরিমান জানা যায়নি। এইসব পরিবহন থেকে নিয়মিত নামে বেনামে টাকা উত্তোলিত হয়।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত মানিক জানিয়েছেন, আমি কারও কাছ থেকে জোর করে টাকা উত্তোলন করি না। রাতে তরকারির গাড়ি পাহারা দেই। সেইজন্য খুশি হয়ে যে যা দেয় সেই টাকা রাখি। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, পাইকারী বাজার এলাকায় নির্ধারিত হারেই ১০, ৩০, ৫০ ও ১০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে বিভিন্ন পরিবহন থেকে।
ওদিকে পোর্টরোড এলাকায় পরিবহন থেকে টাকা আদায় করা হলেও সেখানেও কোন রশিদ দেওয়া হচ্ছে না। পরিবহন শ্রমিকরা জানিয়েছেন, বিআইডব্লিউটিএ’র এলাকায় বিভিন্ন অজুহাতে অনির্ধারিতভাবে টাকা দিতে হয়।
খুলনার রুপসা এলাকা থেকে আসা ট্রাক চালক সোহরাফ মীর জানান, এক সপ্তাহ আগে ট্রাক থেকে ৫০ টাকা রাখা হয়েছিল। আজ (৭ জানুয়ারি) রাখা হয়েছে ১০০ টাকা। রশিদ চাইলাম। কিন্তু কোন রশিদ দিল না। এই চালক বলেন, আমরা টোল দিতে রাজি। কিন্তু তাতো একটি নিয়মের মধ্যে থেকে দিব। যখন যা খুশি তা আদায় করে আমাদের হয়রানি করা হয়।
এ বিষয়ে বন্দর কর্মকর্তা আজমল হুদা মিঠু বলেন, বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মচারীদের রশিদ দিয়ে টাকা উত্তোলনের নির্দেশনা দেয়া আছে, নিয়ম না মানলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।