অরক্ষিত নৌপথ

৪৩ বছরে ৪৯৩২ জন নিহত

খান মাইনউদ্দিন, বরিশাল: নদী প্রধান বরিশাল বিভাগের নৌ-রুট কেন্দ্র করে ফি বছর ‘আধুনিক’ বিজ্ঞাপনের মোড়কে সুবিশাল যাত্রীবাহী নৌযান নামানো হচ্ছে। সরকারি নৌ-যানগুলোর পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে নামানো বিলাসবহুল এসব নৌযান নদীপথ দাপিয়ে বেড়ালেও যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তায় কথার সাথে কাজের তেমন মিল পাওয়া যায় না। ফলে প্রত্যেক বছর অসংখ্য মর্মান্তিক নৌ-দুর্ঘটনায় প্রান হারাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ, ক্ষতি হচ্ছে ব্যাক্তি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের। কিন্তু চাইলেই এসব দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় বলে মত দিয়েছেন বাংলাদেশ অভ্যান্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বরিশাল অফিস।

বিআইডব্লিউটিএ’র উপ-পরিচালক আজমল হুদা মিঠু সরকার জানিয়েছেন, নৌ-দুর্ঘটনা রোধে নৌযান মালিক, কর্মচারী, যাত্রী এবং প্রশাসনের একযোগে কাজ করতে হবে। অন্যথায় দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, শধু যে যাত্রীবাহী নৌযানের কারনে দুর্ঘটনা হয় তা কিন্তু নয় ইদানিং মালবাহী জাহাজের সাথে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। এর কারন নৌপরিবহন বিভাগে শ্রমিকদের মাঝে অনেকেরই সনদ আছে কিন্তু সনদ প্রাপ্তির পর তারা অসচেতন হয়ে পরেন।

সরকারি হিসেব বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৮ অর্থাৎ ৪৩ বছরে নৌপথে ৬৪১টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর এতে নিহত হয়েছেন ৪৯৩২ জন মানুষ। যদিও সরকারি কোন নৌযান দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছে মর্মে তথ্য পাওয়া যায়নি।

৪৩ বছরের উল্লেখিত হিসেবে প্রথম ১৩ বছর অর্থাৎ ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নৌ দুর্ঘটনা কম সংঘটিত হয়। সরকারি দফতরের তথ্য বলছে হিসেব শুরুর বছর ১৯৭৬ সালে দেশে কোন নৌ দুর্ঘটনা ঘটেনি। আর মানুষও মারা যায়নি একজনও। তবে ১৯৭৭ সালে ৫টি দুর্ঘটনায় ২৯ জন, ১৯৭৮ সালে ৭ দুর্ঘটনায় ২০ জন, ১৯৭৯ সালে ৮ দুর্ঘটনায় ৭৩ জন, ১৯৮০ সালে ১টি দুর্ঘটনায় ৪জন, ১৯৮১ সালে ৩টি দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত হন। তবে ১৯৮২ সালে ২টি দুর্ঘটনায় কেউ মারা যাননি। ১৯৮৩ সালে ৩টি দুর্ঘটনায় ২৯ জন, ১৯৮৪ সালে ৫টি দুর্ঘটনায় ৪২ জন, ১৯৮৫ সালে ১২টি দুর্ঘটনায় ৮০ জন, ১৯৮৬ সালে ১১টি দুর্ঘটনায় ৪২৬জন, ১৯৮৭ সালে ১১টি দুর্ঘটনায় ৫১ জন, ১৯৮৮ সালে ১১টি দুর্ঘটনায় ১০৮ জন নিহত হন।

ওই জরিপের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এরপরের ৩০ বছরে ভয়াবহ আকারে বেড়েছে দুর্ঘটনার পরিমান ও প্রানহানি। বিশ্লেষকরা বলছেন, মালিক পক্ষ আকারে বড় এবং ব্যয়বহুল নৌযান প্রস্তুত করলেও যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিতে তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। তাছাড়া শ্রমিকদের সাথে মালিকদের সর্ম্পকটাও ভালো বজায় না রাখায় দুর্ঘটনার নেপথ্য কারন হতে পারে। ওদিকে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে নৌযানগুলো পর্যবেক্ষণ করেন না-তাদের উদাসীনতায় বছর বছর এত প্রানহানী হচ্ছে বলেও মনে করেন নদী পথ বিশ্লেষকরা। যদিও লঞ্চ মালিকরা বরাবরের মত দাবী করে আসছেন সবকিছু সঠিকভাবে পালনের পরও ‘দুর্ভাগ্যক্রমে’ দুর্ঘটনা ঘটছে। আর তাতে ব্যপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পরছেন তারা।

হিসেব অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালে ৫ দুর্ঘটনায় ৩২জন, ১৯৯০ সালে ১৩ দুর্ঘটনায় ১৬৮ জন, ১৯৯১ সালে ১১ দুর্ঘটনায় ১৯ জন, ১৯৯২ সালে ১৭ দুর্ঘটনায় ৫ জন, ১৯৯৩ সালে ২৪ দুর্ঘটনায় ১৮৩ জন, ১৯৯৪ সালে ২৪ দুর্ঘটনায় ৩০৩ জন, ১৯৯৫ সালে ১৯ দুর্ঘটনায় ৪০ জন, ১৯৯৬ সালে ২০ দুর্ঘটনায় ১৪৭জন, ১৯৯৭ সালে ১০ দুর্ঘটনায় ১০২ জন, ১৯৯৮ সালে ১০ দুর্ঘটনায় ৯১ জন, ১৯৯৯ সালে ৬ দুর্ঘটনায় ১০৪ জন, ২০০০ সালে ৯ দুর্ঘটনায় ৫৫৩ জন, ২০০১ সালে ১৬ দুর্ঘটনায় ৩৩ জন, ২০০২ সালে ১৭ দুর্ঘটনায় ২৯৭ জন, ২০০৩ সালে ৩২ দুর্ঘটনায় ৪৬৪ জন, ২০০৪ সালে ৪১ দুর্ঘটনায় ১২৭ জন, ২০০৫ সালে ২৭ দুর্ঘটনায় ২৪৮ জন, ২০০৬ সালে ২৩ দুর্ঘটনায় ৫১ জন, ২০০৭ সালে ১১ দুর্ঘটনায় ২০২ জন, ২০০৮ সালে ২২ দুর্ঘটনায় ১২০ জন, ২০০৯ সালে ৩৪ দুর্ঘটনায় ২৬০ জন, ২০১০ সালে ২৮ দুর্ঘটনায় ১১৮জন, ২০১১ সালে ২৪ দুর্ঘটনায় ৭৪ জন, ২০১২ সালে ১৪ দুর্ঘটনায় ১৬৩জন, ২০১৩ সালে ১৩ দুর্ঘটনায় ২২ জন, ২০১৪ সালে ১৬ দুর্ঘটনায় ১২৩ জন, ২০১৫ সালে ২২ দুর্ঘটনায় ১২০ জন, ২০১৬ সালে ৮ দুর্ঘটনায় ৩৫ জন, ২০১৭ সালে ২৫ দুর্ঘটনায় ৪৫ জন এবং ২০১৮ সালে ২১ দুর্ঘটনায় ২ জন মানুষ নিহত হন।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, প্রত্যেক দুর্ঘটনার কারন উন্মোচনে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। একইসাথে মামলাও দেওয়া হয় মেরিন আদালতে। বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিকাংশ যাত্রীবাহি লঞ্চ দুর্ঘটনার পিছনে কাজ করে তাদের মাস্টার-সুকানির বেপরোয়া মনোভাব। অর্থাৎ নিয়ম মেনে পন্টুন ত্যাগের পর লঞ্চের সাথে লঞ্চ বা অন্য যেকোন নৌযানের সাথে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়। এখন পর্যন্ত যতগুলো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে তার প্রধান কারন ছিল এটি।

এছাড়াও প্রাকৃতিক ঝড়-বন্যায় লঞ্চডুবির বিষয়টি তদন্তে উঠে এসেছে। বিগত ২০ বছরে মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রানহানী হয় ২০০৩ সালে। ওই বছর ৩২ দুর্ঘটনায় ৪৬৪জনের মৃত্যু হয়। ২০০৩ সালের ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা গেছে দুর্ঘটনায় পতিত অধিকাংশ নৌ-যানের ফিটনেস ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রস্তুতি ছিল না। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্ঘটনার বিষয়ে লঞ্চের মাস্টার ও সুকানির সাথে আলাপ করে জানা গেছে ভিন্ন কারন। অনবরত ঘুমহীনতার কারনে দুর্ঘটনাও ঘটছে। অর্থাৎ লঞ্চ মালিক থেকে বরাদ্দ কেবিন বিক্রি করে দিয়ে লঞ্চস্টাফ অকারনে রাত্রি জাগে। কিন্তু যখন তার ডিউটি আসে তখন সেই ঘুমচোখেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে লঞ্চ নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। যদিও নদীর নাব্য সংকটকেও দায়ী করছেন অনেক নৌ-যান মাস্টার ও সুকানি।

মেসার্স সালমা শিপিং লাইন্সের সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াজুল করিম বেলাল মনে করেন, সারাদেশে যতগুলো নৌযান চলাচল করছে তার সবগুলো প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত নয়। হাতেগোনা কয়েকটি নৌযান আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। কিন্তু অধিকাংশ নৌযান প্রযুক্তি ব্যবহার না করায় দুর্ঘটনার শঙ্কা কমছে না। আর বছর বছর বাড়ছে মৃত্যুর পরিমান। তিনি মেঘনায় লঞ্চ দুর্ঘটনার বিষয়ে বলেন, সেখানে ফারহান-৯ লঞ্চে আধুনিক প্রযুক্তির রাডার ছিল না। কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চে প্রযুক্তি ছিল। তাতে দুর্ঘটনা রোধ হয়নি। দুর্ঘটনা রোধে সকল নৌযানকে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে।

Print Friendly

Related Posts