বরগুনা প্রতিনিধি: নিজের নাম গোলাম রসুল, কিন্তু সন্তানদের নাম রেখেছেন বঙ্গবন্ধুর সন্তানদের নামে। তার পাঁচ সন্তানের নাম যথাক্রমে কামাল, জামাল, রাসেল, হাসিনা ও রেহানা।
এমনই এক বঙ্গবন্ধুর প্রেমিকের নাম গোলাম রসুল। বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার পৌর শহরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের এই পরিবারটি বঙ্গবন্ধুর পরিবার হিসেবেই পরিচিত।
বয়সের কারণে এখন বাড়িতেই দিনকাটে গোলাম রসুলের। বৃক্ষ রোপণ-পরিচর্যা, বিকেলের অবসরে পাড়ার শিশুদের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর গল্প শোনানো- এভাবেই যাচ্ছে দিন। শিশুদের কাছেও তার পরিচয় ‘বঙ্গবন্ধু দাদু’।
গোলাম রসুল বলেন, ‘তখন দূরন্ত কৈশোর, দেশ উত্তাল মুক্তির আন্দোলনে। আর এই আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ একজন ব্যক্তি। সুঠাম দেহের অধিকারী এই ব্যক্তির বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, অসাধারণ বক্তৃতা আর দুর্দান্ত সাহসিকতার প্রেমে পড়েছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘ছেষট্টির ৬ দফা, আটষট্টির আগরতলা মামলা ৬৯’র গণ আন্দোলনের জোয়ারে তার মুক্তি- এসব আমি প্রত্যক্ষ করেছি। ৭০’র নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম তার হয়ে ভোটের জন্য’।
১৯৭১ সালের শুরুর দিকে এক সফরে বঙ্গবন্ধু পাথরঘাটা আসলে সেই স্বপ্ন পুরুষের সাথে দেখা হয়ে যায় গোলাম রসুলের। বঙ্গবন্ধুর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর বামনার বুকাবুনিয়া ৯ নম্বর সাব সেক্টরের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন গোলাম রসুল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর লেগে যান দেশ গড়ার কাজে। দীর্ঘদিন পাথরঘাটা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ গোলাম রসুল বর্তমানে পৌর শহরের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাড়ির সামনে নিজ ওয়ার্ডে দলীয় কার্যালয় করেছেন তিনি। সেখানেই বসেন, কাজ করেন মানবতার সেবায়, আর ছড়িয়ে দেন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর গল্প।
সন্তানদের নামকরণের চরম খেসারতও দিতে হয়েছে তাকে। বিএনপির শাসনামলে তৎকালীন সাংসদ নুরুল ইসলাম মনির রোষের শিকার হন তিনি। একের পর এক মামলায় জড়ানো হয় তাকে। মামলা চালাতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির স্বীকার হতে হয় গোলাম রসুলকে।
তিনি বলেন, ‘তখন যে কোনো রাজনৈতিক মামলায় আমাকে আসামি করা হতো, আমি ছিলাম এক প্রকার নির্ধারিত ব্যক্তি। অনেক হয়রানির শিকার হয়েছি, তবু এক বিন্দুও টলিনি কখনো। জানতাম একদিন সু সময় আসবেই। মা হাসিনা দেশের হাল ধরবেন। আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, আমার মা দেশের হাল ধরে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন, এই তো আমার শান্তি’।
বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন গোলাম রসুল। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমার মা কেমন আছে খুব জানতে ইচ্ছে হয়েছিল, অনেক কষ্টে শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল । আমার মায়ের (শেখ হাসিনার) নামে এক টুকরো জমির দলিল রেখেছি। সেই জমির দলিল দিয়ে ওপারে যেতে চাই, ওই জমিটুকুতে বঙ্গবন্ধুর নামের চিকিৎসালয় হোক, যাতে দরিদ্র অসহায় মানুষেরা বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাবে। শেখ হাসিনার নামে একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র হবে, যার এক কোনে একটা লাইব্রেরি থাকবে মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনককে জানার।’
গোলাম রসুলের শেষ ইচ্ছা মৃত্যুর আগে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে সেই জমির দলিল তার হাতে দিয়ে আসা।
নাম নিয়ে ছেলে মেয়েরাও কম বিড়ম্বনার শিকার হননি। বিএনপি ও জোট সরকারের আমলে মানুষজন খুবই তাচ্ছিল্য করত। তামাশা করত এই নাম নিয়ে। তিরস্কারের শিকার হতে হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহপাঠিদের কাছেও। প্রতিবেশীরাও ব্যঙ্গ করত।
বড় মেয়ে হাসিনা বললেন, ‘বাবার ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধায় কোনো কিছুতে মন খারাপ হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমার বিয়েও ভেঙেছে একাধিকবার এই নামের বিড়ম্বনায়, কিন্তু ভালোবাসার কাছে তো হার মানে সবই।’
বড় ছেলে কামাল বলেন, ‘নামের কারণে আমাদের পরিবার বিএনপির আমলে অযথাই রোষের শিকার হয়েছিল। মামলা হামলার শিকার হয়েছিল। তবু ভালো লাগত, আমাদের নিজেদের গর্বিত মনে হত, তাই কোনো কিছুতেই মন খারাপ করিনি।’
কামাল ও জামাল বাড়িতেই থাকেন, ব্যবসা করেন বাজারে। হাসিনার বিয়ে হয়েছে, তিনি শ্বশুর বাড়িতেই থাকেন। আর রাসেল ও রেহানা দুজনে বরগুনা সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত।