খান মাইনউদ্দিন, বরিশাল : অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্য দিয়ে বরিশাল জেলায় চলছে চাল সংগ্রহ কর্মসূচি। জেলার ১০টি উপজেলার ১৯টি চালু রাইস মিল থেকে মানসম্মত চাল সংগ্রহের কথা থাকলেও দুই তৃতীয়াংশ রাইস মিল পরিত্যাক্ত।
কাগজে-কলমে রাইসমিলগুলো চালু দেখালেও বাস্তবে তার উল্টো চিত্র। মূলত বরিশাল জেলা খাদ্য কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে স্থানীয় বাজার থেকে নিম্নমানের চাল ক্রয় করে সরকারকে বুঝিয়ে দিচ্ছে রাইস মিল মালিকরা।
তবে জেলা খাদ্য কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক অনিয়মের কথা স্বীকার করলেও তাদের কিছু করার নেই বলে দাবী করেছেন। তাছাড়া এমন দুর্নীতি সারাদেশেই হচ্ছে বলেও মত দিয়েছেন এই দুই শীর্ষ কর্মকর্তা। তারা জানিয়েছেন, সরকারের চাহিদা পূরণ করতে রাইসমিল দেখিয়ে বাজার থেকে যে চাল সংগ্রহ করা হয় তা দক্ষিণাঞ্চলের মঙ্গলের জন্য। অন্যথায় বরাদ্দ কেটে মন্ত্রণালয়ে ‘উত্তরাঞ্চলে’ নিয়ে যাবে বলেও জানান। তখন আঞ্চলিক যেসব খাদ্য দপ্তর রয়েছে তাতে কাজ করার মত কিছু থাকবে না।
বরিশাল জেলা খাদ্য অধিদফতর জানিয়েছে, জেলার ১০টি উপজেলা-বরিশাল সদর, মেহেন্দীগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, উজিরপুর, বাকেরগঞ্জ, গৌরনদী, বানারীপাড়া, আগৈলঝাড়া, হিজলা ও মুলাদীতে ১৯টি রাইস মিল থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে মোট ১৯৭৮ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে। বরাদ্দের এইপরিমান চাল ইতিমধ্যে সংগ্রহ শুরু হয়েছে।
তবে ১০টি উপজেলা হলেও মোট ৭টি উপজেলার ১৯টি রাইস মিল থেকে চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে।
খাদ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাবুগঞ্জ, বানারীপাড়া ও মেহেন্দীগঞ্জে উপযুক্ত কোন রাইস মিল না থাকায় ওইসব উপজেলায় কোন রাইস মিলকে চাল প্রস্তুতের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। আর আগৈলঝাড়া উপজেলায় ৮টি রাইস মিল, গৌরনদী উপজেলার ৩টি, মুলাদীর ২টি, বাকেরগঞ্জের একটি, হিজলার একটি, উজিরপুরের ৩টি এবং বরিশাল সদরের ১টি রাইস মিল থেকে চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, খাদ্য অধিদফতরের মতে যেসব উপজেলায় রাইস মিলগুলো উপযুক্ত এবং চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে তার দুই তৃতীয়াংশ রাইস মিল অনেক বছর ধরে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তালিকা অনুসারে বরিশাল সদর উপজেলার সাহেবেরহাট বাজারের আমিন রাইস মিল থেকে ২৮৬ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করার কথা। ইতিমধ্যে ৯৬ মেট্রিক টন চাল এই রাইস মিল থেকে ক্রয় করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সদর উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা মোঃ নজরুল ইসলাম। তবে বাস্তবে আমিন রাইস মিল নামে ওই এলাকায় কোন রাইস মিল নেই। যা রয়েছে সেখানে ধান ক্রয় করে গুদামজাত করার জন্য একটি টিনের ঘর ও ধান শুকানোর জন্য একটি চাতাল।
সরেজমিনে কথা হয় ওই গুদাম পাহারায় নিয়োজিত বৃদ্ধ রুস্তম আলী হাওলাদারের সাথে। তিনি জানান, প্রায় পাঁচ বছর আগে কিছুদিন ধান শুকিয়ে এখানে দুটি মেশিনের মাধ্যমে ছাটাই করে চাল তৈরী করা হতো। মাস খানেক চাল ছাটাই চললেও তারপর থেকে তা বন্ধ হয়ে যায়। আমিন রাইস মিলের মালিক আমিনুল ইসলাম জানান, তিনি বরিশাল শহরে একটি প্ইাপ কোম্পানীর ডিলারশিপ নিয়ে চৌমাথায় ব্যবসা করেন। ঠিকমত সময় দিতে না পারায় রাইস মিলটি পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। তাহলে ৯৬ মেট্রিক টন চাল সরকারের কাছে কিভাবে বিক্রি করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্থানীয় বাজার থেকে চাল ক্রয় করে খাদ্য কর্মকর্তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
শুধু বরিশাল সদর উপজেলা নয়, বাকেরগঞ্জ উপজেলায় মাত্র দেড়মাস আগে ভান্ডারী হাস্কিং রাইস মিল চালু করেছেন। কিন্তু নভেম্বরের শেষ সপ্তাহেই দেড়শ মেট্রিক টন চাল সরকারকে দিয়েছেন ওই রাইস মিলের মালিক আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব আলম। তিনি জানিয়েছেন, বরিশাল জেলার এক জেলা পর সুদূর বরগুনা জেলার পাথরঘাটা বাজার থেকে ওই চাল তিনি ক্রয় করে এনেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাকেরগঞ্জ উপজেলার খাদ্য কর্মকর্তা মোঃ মোশারেফ হোসেনের বাড়িও পাথরঘাটা উপজেলায়। সেকারনে তার এলাকার মানুষের কাছ থেকে চাল ক্রয় করে এনে ভান্ডারী রাইস মিলের উৎপাদন দেখিয়ে সরকারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে মোশারেফ হোসেন জানান, সরকার যে মাধ্যমে চাল চায় তা দেশের কোন রাইস মিলই দিতে পারবে না। এই কর্মকর্তা জানান, তার উপজেলার ভান্ডারী রাইস মিল থেকে সর্বোচ্চ ৪৩২ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করবে সরকার। কিন্তু বাকেরগঞ্জ থেকে এত পরিমানের চাল উৎপাদন সম্ভব নয় বিধায় বরগুনা জেলা থেকে চাল ক্রয় করে নিয়ে এসেছেন।
খাদ্য দফতরের নির্ধারিত ১৯টি রাইস মিলের মধ্যে ৬টি রাইস মিল চালু রয়েছে। ওই মিলগুলো হলো উজিরপুরের জয় অটো রাইস মিল, গৌরনদীর এলাহী এগ্রো লিমিটেড, আগৈলঝাড়ার রাসেল রাইন মিল-০২, আল-আমিন রাইস মিল, বাকেরগঞ্জের ভান্ডারী রাইস মিল ও উজিরপুরের আলহামদুলিল্লাহ রাইস মিল।
বাকি বরিশাল সদরের আমিন রাইস মিল, উজিরপুরের ব্রাদার্স রাইস মিল, গৌরনদীর মায়ের দান রাইস মিল, আগৈলঝাড়ার হাচান রাইস মিল, হাওলাদার রাইস মিল, রাসেল রাইস মিল, পাপিয়া রাইস মিল, বাবার দান রাইস মিল, জাকের রাইস মিল, মুলাদীর ভূইয়া রাইস মিল, হিজলার সিকদার রাইস মিল, মুলাদীর ফরিদ রাইস মিল, গৌরনদীর আল্লার দান রাইস মিল-১৬টি মিল চাল উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত নয়। অথচ পরিত্যাক্ত সেইসব রাইস মিল থেকে বিপুল পরিমান ধান ছাটাই করে চাল সংগ্রহ করছে খাদ্য অধিদফতর।
জানা গেছে, রাইস মিল মালিকরা উপজেলা, জেলা ও আঞ্চলিক খাদ্য কর্মকর্তাকে নির্ধারিত অঙ্কের ঘুষ দিয়ে স্থানীয় বাজার থেকে কম দামে ও নিম্নমানের চাল ক্রয় করে বেশি দামে সরকারের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। আর এই কৌশলে প্রতি মৌসুমে প্রায় অর্ধকোটি টাকা যাচ্ছে রাইসমিল মালিক ও খাদ্য কর্মকর্তাদের পকেটে।
এ বিষয়ে বরিশাল জেলা খাদ্য কর্মকর্তা রিয়াজুর রহমান রাজু বলেন, আমি মাত্র ৪/৫দিন হলো যোগ দিয়েছি। আমি আসলে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না।
সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অবনি মোহন দাস বলেন, খাদ্য অধিদফতর থেকে পরিদর্শক গিয়ে রাইস মিলগুলো পরিদর্শন করে যথার্থতা নিশ্চিত করে প্রতিবেদন দিলে আমরা সেখান থেকে চাল সংগ্রহ করি। পরিত্যাক্ত রাইস মিল থেকে কিভাবে চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা কিছু জানাতে পারেননি।
এ বিষয়ে আঞ্চলিক খাদ্য কর্মকর্তা ফারুক হোসেন বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি হয়েও থাকে তাহলেও কিছু করার নেই। কারন আপত্তি জানালে মন্ত্রণালয় চাল সংগ্রহের বরাদ্দ দক্ষিণাঞ্চল থেকে কেটে উত্তরাঞ্চলে নিয়ে যাবে। তখন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ বঞ্চিত হবে।
এই কর্মকর্তা বলেন, সারাদেশেই চাল সংগ্রহে একটু এফোঁড়ওফোড় হয়। তা নিয়ে ‘ঝামেলা না পাকানো’ বরিশালবাসীর জন্য মঙ্গলজনক।
ছবি: পরিত্যক্ত একটি রাইস মিল