খান মাইনউদ্দিন, বরিশাল: বরিশাল মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে নগরীর রূপাতলী থেকে পাঁচজন রোগীর দালালকে আটক করা হয়েছে। শনিবার অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করেন এসআই অরবিন্দু বিশ্বাস।
পাঁচ দালালকে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী হাকিম শাহাদাৎ হোসেনের আদালতে সোর্পদ করলে একজনকে তিন মাসের ও অপর চারজনকে একমাসের কারাদন্ড প্রদান করেন। কিন্তু ধরাছোয়ার বাইরে রয়ে গেছেন এই সিন্ডিকেটের মুল হোতা রশিদ খাঁন।
স্থানীয় প্রভাবশালীদের সাথে সখ্যতা ও মাসোহারা দিয়ে দালাল সিন্ডিকেট পরিচালনা করলেও অভিযানে তার আটক না হওয়ার ঘটনায় নানাবিধ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, বরিশাল নগরীতে দালাল নির্ভর জমজমাট ডায়াগনস্টিক ব্যবসা পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন এই অটো চালক রশিদ খান। নগরীর ২৫ নং ওয়ার্ডের সোহরাফ খান হাউজিংয়ে ভাড়া বাসায় থেকে রুপাতলীর দালাল ও ছিনতাই চক্র নিয়ন্ত্রণ করেন দালাল কমান্ডার রশিদ।
তিনি কাউনিয়া থানার ৫ নং চরবাড়িয়া ইউনিয়নের বেলতলা চর আবদানী এলাকার বাসিন্দা মৃত খালেক খানের পুত্র। তার অপর পুত্র শহিদ খানও বড় ভাই রশিদের সাথে রোগীর দালালী করে থাকেন।
এছাড়াও শহিদের বিরুদ্ধে ব্যাটারী চুরি, ছিনতাইয়ের অভিযোগ রয়েছে। ওদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর বরিশাল অফিস জানিয়েছে নগরীতে মাত্র ১২১টি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক, হাসপাতাল ও ব্লাড ডোনার ক্লাবের অনুমতি রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সরকারি এই হিসেবকে তুচ্ছ করে অলি-গলিতে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে কমপক্ষে আড়াই শ’ প্রতিষ্ঠান। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার/হাসপাতাল পুরোপুরি দালাল নির্ভর।
উল্লেখযোগ্য হাসপাতাল যেমন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল জেনারেল হাসপাতাল থেকে বিভিন্ন কৌশলে রোগী বাগিয়ে নিয়ে থাকে এসব প্রতিষ্ঠানের দালালরা। তারচেয়েও ভয়াবহ অবস্থা পরিবহন ভিত্তিক রোগীর দালাল সিন্ডিকেটের দরুন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর পরিবহন স্ট্যান্ড তিনটিতে তিনভাগে ৬৫জন দালাল সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রোগীরা এলে তাদের ফাঁদে ফেলে নাম সর্বস্ব ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে সুচিকিৎসার চেয়ে অপচিকিৎসাই হয় বেশি। ফলে প্রায়শই নগরীর এসব ব্যক্তি উদ্যোগের দালাল নির্ভর প্রতিষ্ঠানে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।
মূলত, কয়েকজন প্রভাবশালীর মদদে রোগী ধরার দালাল চক্র বিস্তৃতি লাভ করেছে। রুপাতলী, নথুলাবাদ ও লঞ্চঘাট এলাকায় তিনটি দালাল চক্র সক্রিয়ভাবে কাজ করায় নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন এরা। অভযোগ রয়েছে, প্রশাসনের নিরবতার সুযোগে এসব দালালরা মানুষকে ভুল চিকিৎসার মুখে ঠেলে দিয়ে ফায়দা লুটে নিচ্ছে নিজেরা। দালালরা ‘কন্ট্রাক’ ও ‘সাব কন্ট্রাকে’ রোগী নিয়ে থাকে। এই দুই গ্রুপের তিনজন কন্ট্রাকে শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। বাস স্টেশন ও লঞ্চ স্টেশনে যেকোন রোগী নিতে তাদের মাধ্যমে নিতে হয়। রুপাতলী, নথুল্লাবাদ ও লঞ্চঘাটে এই তিন স্থানে কন্ট্রাক্ট গ্রুপে রয়েছে মোট ১৫ জন দালাল।
এরমধ্যে রুপাতলীতে রশিদের কন্ট্রাক্টে কাজ করছেন মনির, জহির, সহিদ, লিটন, রুহুল ও কালা মানিক।
নথুল্লাবাদে কাজ করছে কাদের ও রিপন এবং লঞ্চঘাটে কাজ করছে চান্দু, জামাল, স্বপন (১), ছালাম, আনোয়ার এবং স্বপন (২)। এদের সাথে সাবকন্ট্রাক্টে প্রায় ৫০ জন কাজ করছেন নগরীর বিভিন্ন এলাকায়।
দালালরা জানিয়েছে, এই যে তিনটি গ্রুপ রয়েছে এদের মাধ্যমে ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা ডাক্তারদের চেম্বারে সরাসরি রোগী দিলে বেশি পার্সেন্টিস পাওয়া যায়। আর সাব কন্ট্রাকে যারা কাজ করেন তাদের পার্সেন্টিসের হার আবার কম। একজন দালাল (কন্ট্রাক্টে) প্রতি রোগী থেকে ডাক্তারের মারফত পাবেন ১৫০ টাকা এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ৩০%। অর্থাৎ রোগী এনে দিলে ডাক্তার ১৫০ টাকা দিবে আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যত টাকার টেস্ট করাবেন ওই রোগী সেখান থেকে শতকরা ৩০ টাকা করে পাবেন।
ওদিকে যারা সাব কন্ট্রাক্টে কাজ করেন তারা ডাক্তারের কাছ থেকে ১০০ ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ১৫ পার্সেন্ট পান।
রুপাতলীর দালাল কমান্ডার রশিদ ও সহিদ জানান, প্রতিমাসে স্থানীয় সাংবাদিক, নেতা, ডিবি ও পুলিশের বিভিন্ন টিমকে চুক্তি ভিত্তিক মাসোহারা দিয়েই তারা রোগী ধরার দালালি করেন।
লঞ্চঘাটের দালাল আনোয়ার জানান, কয়েকদিন আগে সিআইডি তাকে আটক করেছিল। দিন পনেরো কারাগারে ছিল। যেদিন ছাড়া পেয়েছেন সেদিনই অটো নিয়ে লঞ্চঘাটে চলে এসেছে।
আনোয়ারের দাবী, আটকের পর তার পরিবারের খরচ ও তার মামলার খরচ সবই দিয়েছে ডায়াগনস্টিক মালিক। অপর দালাল স্বপন ও ছালাম বলেন, শহরের সবগুলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল রয়েছে। একটা রুটিনমত সবাইকে রোগী দিতে হয়। না হলে ঝামেলা করে।
বরিশাল জেলার সিভিল সার্জন ও জেনালে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মনোয়ার হোসেন জানান, চিকিৎসা সেবায় দেশে প্রথম স্থান অধিকারী ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের দালাল চক্রও নিরোধ করতে পারেনি কেউ। বরিশালেও যে দালালদের দৌরত্ম নেই তেমন নয়; আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি দালালদের সনাক্ত করে আইনের হাতে তুলে দিতে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দালাল যেহেতু এক প্রকারের প্রতারক। প্রতারক দমনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে পুলিশ-প্রশাসন।
কোতয়ালী মডেল থানার ওসি নুরুল ইসলাম জানান, দালালরোধে সব সময় আমরা সক্রিয়। এর আগে দালালদের তালিকা করেও তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সেই প্রক্রিয়া এখনো চলমান।
তিনি বলেন, পুলিশ কমিশনার স্যারের নির্দেশে আমরা তৎপর রয়েছি। কেউই প্রতারণা করে রেহাই পাবেন না। সবাইকে আইনের আওতায় আসতেই হবে।
প্রসঙ্গত, শনিবার দালাল কমান্ডার রশিদ খানের ছোট ভাই শহিদ খাঁন (৩৫), তাদের সিন্ডিকেট সদস্য মনির হোসেন সরদার (৪৯), রবিউল ইসলাম মৃধা (২৫), জহিরুল ইসলাম (৫৫) ও জামাল হোসেন মোল্লা ওরফে নুরুজ্জামানকে আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।