বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর। অনুশীলনের আগে মাশরাফি মুর্তজাকে ডেকে নিলেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান। প্রস্তাব দিলেন অধিনায়ক হওয়ার।
বৃহস্পতিবার দলের আরেকটি অনুশীলন সেশনের আগে নাজমুল হাসানকে ফোনে মাশরাফি জানালেন, এবার নামাতে চান ভার। মাঝের সময়টুকুতেই এসেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। যার অন্যতম নির্মাতা অধিনায়ক মাশরাফি।
সাড়ে ৫ বছরের এই সময়টায় মাশরাফির হাত ধরে অনেক স্বপ্ন ধরা দিয়েছে বাস্তব হয়ে। কখনও রচিত হয়েছে রূপকথা। দেশের ক্রিকেটে ছুঁয়েছে নতুন উচ্চতা। মাশরাফিও পা রেখেছেন জনপ্রিয়তার চূড়ায়। নায়ক থেকে হয়ে উঠেছেন মহানায়ক। অধিনায়ক থেকে হয়েছেন নেতা।
হতাশার আঁধারও কিছু এসেছে এই সময়ে। তবে পেছন ফিরে তাকালে, রঙিন পোশাকে আলো ঝলমলে সময়টুকুর ঔজ্জ্বল্যই যথেষ্ট চোখ ধাঁধিয়ে দিতে। তামিম ইকবাল যেমন বলেছেন, এই দেশের ক্রিকেটের জন্য মাশরাফির অবদান, কখনও কারও ভোলার নয়।
প্রস্তাব পাওয়ার পর শুরুতে দ্বিধান্বিত ছিলেন মাশরাফি। এমনিতেই চোটে জেরবার ছিল ক্যারিয়ার। মাঠের ভেতরের চেয়ে বাইরেই বেশি সময় কাটাতে হয়েছে। নেতৃত্বের আগের অভিজ্ঞতাও ভালো ছিল না চোটের কারণেই। অধিনায়কত্বের বাড়তি চাপ কেন নেবেন! কিন্তু বাবা গোলাম মুর্তজার অনুপ্রেরণায় চ্যালেঞ্জটা নিলেন। বুভুক্ষু ক্রিকেট জাতিকে এনে দিয়েছেন অভাবনীয় সব সাফল্যের স্বাদ।
জিম্বাবুয়েকে ৫-০তে হারানো দিয়ে সাফল্য রথ ছোটার শুরু। দেশের ক্রিকেটের ওই সময়ের অবস্থায় জিম্বাবুয়েকে সব ম্যাচে হারানোর বিশ্বাসও ছিল না। অধিনায়ক মাশরাফি বিশ্বাস ফেরালেন। অধিনায়ক মাশরাফি স্বপ্ন দেখাতে শেখালেন।
অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডের কন্ডিশনে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে বিদায় করে বাংলাদেশ পা রাখল কোয়ার্টার-ফাইনালের মঞ্চে। সেমি-ফাইনালে যে ভারতের কাছে হারের যন্ত্রণায় দগ্ধ হলো দেশের ক্রিকেট, সেই ভারতকেই দেশের মাটিতে সিরিজ হারিয়ে মিলল উপশমের আনন্দ। ১৬ বছর ধরে যে দলের বিপক্ষে জয় নেই, সেই পাকিস্তানকেই হোয়াইটওয়াশ করে মাশরাফির দল উপহার দিল আনন্দময় বিস্ময়। পরাভূত হলো এমনকি প্রবল পরাক্রমশালী দক্ষিণ আফ্রিকাও!
ড্রেসিং রুম মাতিয়ে রাখতেন তিনি বরাবরই। অনেকে তাকে বলতেন, ড্রেসিং রুমের অক্সিজেন। অধিনায়ক হওয়ার পর হয়ে উঠলেন আরও অনেক কিছু। কখনও ছিলেন ছায়া। আগলে রেখেছেন দলকে। কখনও বর্ম। আড়াল করেছেন সতীর্থদের। যাবতীয় ক্রিকেটীয় সমস্যা তো বটেই, সতীর্থদের জন্য তার কাছে ছিল যেন সব সমস্যার সমাধান। কারও ব্যক্তিগত ঝামেলা, কারও পারিবারিক সমস্যা, নানা বিষয়ে তাদের বিচিত্র সব আবদার, সব মিটিয়েছেন তিনি। কখনও রাত দুপুরে, কখনও কাক ভোরে।
যে কোনো সিরিজ মানেই তার রুম অঘোষিত ক্লাব ঘর। যে ঘরের দরজা ২৪ ঘণ্টা খোলা, দলের সবার অবারিক যাতায়াত। তুমুল আড্ডা, কখনও তাস পেটানো, হাসি-মজার কারখানা যেটি, পারস্পরিক সম্পর্কের মিথস্ত্রিয়া জমে উঠত যেখানে, কখনও প্রতিপক্ষকে বধের ছক কাটা, সব মিলিয়ে অধিনায়কের রুম যেন প্রাণের মেলা!
এভাবেই দলকে করে তুলেছেন এককাট্টা। ক্রিকেটারদের কাছে তার একটিই পরিচয়, ‘ভাই’, সবাই ‘ভাই’ বললেই বুঝে যেতেন কার কথা বলা হচ্ছে। তবে শুধু বড় ভাই নয়, মাশরাফি সতীর্থদের কাছে ছিলেন বড় নির্ভরতা। মাহমুদউল্লাহর ভাষায়, ‘মাশরাফি অসাধারণ মানুষ, তার চেয়েও অসাধারণ অধিনায়ক।”
এভাবেই দল হয়ে উঠেছে পরিবার। পারফরম্যান্সে পড়েছে প্রতিফলন। ২০ ওভারের ক্রিকেটে সীমাবদ্ধতা জয় করে এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টির ফাইনাল, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমি-ফাইনাল, তামিম-সাকিবকে ছাড়া এশিয়া কাপের ফাইনাল, ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিরিজ জয়, সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হয়েছে আকর্ষণীয় সব পালক। আইসিসি ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের চিরস্থায়ী ঠিকানা ছিল ৯ বা ১০, সেখানে বাংলাদেশ ছয় নম্বরে পর্যন্ত উঠে গেছে!
সাফল্যের পথ ধরেই এসেছে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। ক্রিকেট মাঠ বা ক্রিকেটের গণ্ডি ছাপিয়ে তার আবেদন ছুঁয়েছে দেশের সব সীমানা। ক্রিকেটের ক্যানভাস থেকে হয়ে উঠেছেন জীবন ক্যানভাসের নায়ক।
প্রায় মহামানবে রূপ নেওয়া সেই প্রতিচ্ছবি অনেকের কাছে পাল্টে যেতে শুরু করে রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর। কাকতালীয়ভাবে ক্রিকেট মাঠে বিবর্ণ সময়ের শুরু এরপরই। গত বছরের শুরুতে নিউ জিল্যান্ড সফর ভালো যায়নি। আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে দেশের ক্রিকেটের প্রথম ট্রফি এসেছে তার নেতৃত্বেই। তবে এরপরই এসেছে বিশ্বকাপের হতাশা। আকাশচুম্বি প্রত্যাশা নিয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে দল। চোটের সঙ্গে লড়াইয়ে জিততে না পেরে তার নিজের পারফরম্যান্সও ছিল বাজে।
অধিনায়কত্ব জীবনের উল্টো ছবি এরপরই দেখতে শুরু করেছেন মাশরাফি। সমালোচনার শূলে চড়ানো হয়েছে তাকে। ক্রিকেট অনুসারী বা সংবাদমাধ্যই শুধু নয়, এমনকি বোর্ড কর্তাদের কথায়ও ছিল প্রচ্ছন্ন অপমান। স্বয়ং বোর্ড সভাপতির কথা নানা সময়ে ছিল বিভ্রান্তিকর। দীর্ঘ প্রায় ৭ মাস কোনো ওয়ানডে ছিল না বাংলাদেশ দলের, মাশরাফিকে নিয়ে আলোচনার তবু শেষ ছিল না। এই জিম্বাবুয়ে সিরিজও শুরু হয়েছিল অনেক প্রশ্ন ও কৌতূহলকে সঙ্গী করে। সিরিজ শেষের আগে তিনি মেটালেন কৌতূহল।
অধিনায়ক হিসেবে শেষ ম্যাচটি যখন খেলতে নামছেন, তার সামনে অনন্য এক অর্জনের হাতছানি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটি জিতলেই হবে অধিনায়ক হিসেবে জয়ের ফিফটি! বাংলাদেশের হয়ে আগের সবচেয়ে বেশি জয় ছিল যে অধিনায়কের, সেই হাবিবুল বাশারকে পেছনে ফেলেছেন অনেক আগেই (২৯ জয়)।
নেতৃত্বগুণ, ব্যক্তিত্ব ও সার্বিক প্রভাবের কারণে অনেক সময়ই আড়ালে পড়ে থাকে তার বোলিং। অথচ অধিনায়কত্বের এই সময়টায় দলের সেরা পারফরমারদের একজন হয়েও ছিলেন বরাবরই। এই দফায় অধিনায়ক হওয়ার পর তিনি দলের দ্বিতীয় সফলতম বোলার (৯৫ উইকেট, এই সময়ে মুস্তাফিজের উইকেট ১০৮টি)।