নলছিটিতে কর্মসৃজন প্রকল্প বাস্তবায়নে হরিলুট

খান মাইনউদ্দিন, বরিশাল: দপদপিয়া ইউনিয়নের লঞ্চঘাট জামে মসজিদের রাস্তা নির্মানে ২০১৯ সালে ৪৩ হাজার ৫শ’ টাকা বরাদ্ধ দেয় সরকার। ঠিক সেই সড়কের ঈষৎ নাম বদল করে চলতি বছর আবারও বরাদ্দ আনেন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান। এবার বরাদ্দের পরিমান বেড়ে দাড়িয়েছে ৪ লাখ ১৪ হাজার ৪০০ টাকায়। এই বাজেটে রয়েছে আশরাফ কারিকরের বাড়ির সামনে বক্স কালভার্ট নির্মান। তবে গত বছরের উন্নয়ন আর চলতি বছরের উন্নয়ন মিলিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী। আর আশরাফ কারিকরের বাড়ির সামনের বক্স কালভার্ট নির্মান কাজই শুরু হয়নি।

প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কাজ শেষ করার নির্ধারিত সময় শেষ হয়েছে। চেয়ারম্যানরা জানিয়েছেন তারা শতভাগ কাজ বাস্তবায়ন করেছেন। এরপরই বিল তুলছেন জনপ্রতিনিধিরা।

এতো শুধু ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় অতিদারিদ্রের জন্য কর্মসৃজন প্রকল্পের কর্মসূচির একটি কাজের নমুনা। উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে বরাদ্দের ৪৩টি কাজে লক্ষ্যমান আরও ভয়াবহ। অনেক কাজে বরাদ্দের টাকা মেম্বার-চেয়ারম্যান পকেটে গুঁজে যাদের বাড়ির সামনে বরাদ্দ তাদের কাছ থেকে টাকা তুলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। আবার কর্মসূচির কাজের সংজ্ঞা বদলে ফেলেছেন কেউ কেউ।

জনপ্রতিনিধিদের মতে, অতিদারিদ্রের নামে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের হাত খরচার টাকা বরাদ্দ দেয় মন্ত্রনালয়। তাই তারা নামেমাত্র কাজ দেখিয়ে বাকি টাকা ভাগ করে নেন বলে স্বীকারও করেছেন অনেকে। বিষয়টি জানেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাও। কারণ, সবারই জানা।

অবশ্য নলছিটি উপজেলা চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান জানিয়েছেন, অতিদারিদ্রের কর্মসৃজন প্রকল্পের কাজ প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধায়নে গরীবের ভাগ্য উন্নয়ন ও গ্রামীন এলাকা উন্নয়নের জন্য আসে। এই প্রকল্প মোটেই চেয়ারম্যান-মেম্বারদের হাত খরচার জন্য মন্ত্রণালয় পাঠায় না। যারা এসব কথা বলে তারা প্রধানমন্ত্রীর ভিশনের সাথে প্রতারণা করছেন।

barisal
আশরাফ কারিকরের বাড়ির সামনে ৪ লাখ ১৪ হাজার ৪০০ টাকা বরাদ্দের বক্স কালভার্ট

জানা গেছে, নলছিটি উপজেলায় কর্মসূচির ৪৩টি কাজের অনুকূলে ১ কোটি ৬৭ লাখ ৬ হাজার ৬৮০ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। দশটি ইউনিয়ন-দপদপিয়া, মগর, কুশংগল, কুলকাঠি, নাচনমহল, রানাপাশা, মোল্লারহাট, সিদ্ধকাঠি, সুবিদপুর ও ভৈরবপাশা ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে প্রকল্প বাস্তবায়ন এলাকায় নূন্যতম পনেরো শতাংশ কাজ হয়নি। এই ৪৩টি কাজের মধ্যে ৭টি রয়েছে বক্স, ড্রেনেজ বা পাইপ কালভার্ট নির্মাণ। ৭টি কালভার্টের মধ্যে ৪টি কালভার্ট নির্মান করেছে স্থানীয়দের কাছ থেকে চাঁদা তুলে, তিনটি কালভার্ট বরাদ্দের টাকায় করলেও মান নিয়ে রয়েছে আপত্তি। আর ফি বছর বরাদ্দ পাওয়া দপদপিয়া ইউনিয়নের লঞ্চঘাট সড়কের কালভার্ট নির্মানই হয়নি।

সূত্র বলছে, তালিকার ৭ নং কাজের বেল্লাল হাওলাদারের বাড়ির উত্তর পাশের নালায় ড্রেনেজ কালভার্ট নির্মাণ ও আধা কিলোমিটার সড়কে মাটি ফেলার জন্য ৪ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বাস্তবতায় কাজটি করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের মহিলা মেম্বারের বাড়ির সামনে। কিন্তু সাড়ে ৪ লাখ টাকার কাজে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে বলে দাবী করেছেন কাজের শ্রমিকরা। ২১ নং কাজের আওতায় আরেকটি বক্স কালভার্ট নির্মানের কথা সুবিদপুর ইউনিয়নের গোপালপুর ইউনুছ আকনের বাড়ির পশ্চিম পাশে। ওই কালভার্টের বরাদ্দ ৬ লাখ ৬ হাজার ১০০ টাকা। এই কালভার্ট করতে ইউনুছ আকনের মাধ্যমে স্থানীয়দের দ্বারা ৫ বস্তা সিমেন্ট ক্রয় এবং নগদ ১৮ হাজার টাকা চাঁদা তুলে কালভার্টটি নির্মান করেন। একই চিত্র ২৪ নং কাজের সিদ্ধকাঠি ইউনিয়নের রাজপাশা ছৈয়দ আইউব আলীর বাড়ির সামনের বক্সকালভার্ট নির্মানে। এই কাজে স্থানীয় ইউপি সদস্য আইউব আলীর কাছ থেকে ৭ বস্তা সিমেন্ট ও ৩০ হাজার টাকা নিয়ে কালভার্ট নির্মান করেন।

স্থানীয় জনৈক যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কাজটি আইউব আলীর বাড়ির সামনে থেকে কেটে অন্যস্থানে কালভার্ট নির্মান করতে চেয়েছিল মেম্বার। শেষে কাজ বরাদ্দের স্থানে ধরে রাখতে উল্লেখিত সিমেন্ট ও নগদ টাকা নেন মেম্বার।

তদ্রুপ অভিযোগ পাওয়া গেল কুশংগল ইউনিয়নের আবুল হোসেন রাঢ়ী বাড়ির মধ্যে ৪ লাখ ১৬ হাজার ১০০ টাকার বক্স কালভার্ট, দপদপিয়া ইউনয়িনের উত্তর জুরকাঠি ডাওরি হাজী বাড়ির রাস্তায় বক্স কালভার্ট ৩ লাখ ১৮ হাজার ৪০০ টাকায় নির্মান, মোল্লারহাট ইউনিয়নের ইলিয়াস খানের বাড়ির পশ্চিম পাশে ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯০ টাকার বক্স কালভার্ট, নাচনমহল ইউনিয়নের দক্ষিণ ভবানিপুর দিলিপ অধিকারীর বাড়ির পূর্বপাশে ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৬০০ টাকার পাইপ কালভার্ট নির্মান, রানাপাশা ইউনিয়নে অরুন কুমারের বাড়ির পাশে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৩০০ টাকায় বক্স কালভার্ট নির্মান কাজের।

ওদিকে ৪৩টি কাজের আওতায় সড়ড়কের দুই পাশে মাটি ফেলার কাজ বাস্তবায়নের মানদন্ড আরও নিচে। স্থানীয়দের সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের দাবী, নূন্যতম ৫% সড়ক সংস্কারের কাজ হয়নি বরাদ্দের।

দরিদ্রদের কর্মস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী কর্মসৃজন প্রকল্পের কাজ শুরু করান। এই কাজে যেমন প্রান্তিক জনপদ উন্নয়ন হওয়ার কথা তদ্রুপ অতিদারিদ্রদের আয়ের পথ সুগম হবে। কিন্তু নলছিটি উপজেলায় স্থানীয় কোন দারিদ্র দ্বারা অতিদারিদ্ররে এই কাজ করানো হয় না বলে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, দিনাজপুর, রংপুর, চুয়াডাঙ্গা থেকে আসা মৌসুমী শ্রমিকরা এসে চুক্তিতে কাজ করে থাকে। এই কাজের মৌসুম শুরু হলেই মোবাইলে ডেকে আনেন স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বাররা।

প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বিজন কৃষ্ণ খরাতি বলেন, আমি অল্প কয়েকদিন হয় এসেছি। এসবের কিছুই জানি না। মূলত আমার আগে যিনি প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ছিলেন তিনি সব কিছু জানেন। আর বিল উত্তোলনের বিষয়, কাজের পরিদর্শন তা তিনিই করেছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি বিলে স্বাক্ষর করেছেন। আমি যুক্ত হয়েছি মার্চে।

নলছিটির সাবেক প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, আমি কোন দুর্নীতির সাথে জড়িত ছিলাম না। তবে কর্মসূচির কাজ আসে জনপ্রতিনিধিদের জন্যই। বছরের পর বছর এই কাজের এমন চিত্রই দেখে এসেছি এবং সারা বাংলাদেশেই একই চিত্র বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুম্পা সিকদার বলেন, অতিদারিদ্রের কাজ মেম্বার-চেয়ারম্যানদের হাত খরচার যে কথাটি বললেন এটি নিঃসন্দেহে কোন ভালো কথা নয়। যারা বলেছেন তারা ভুল সংজ্ঞা দিচ্ছেন। কোন কাজের বিষয়ে অভিযোগ পেলে আমি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

আরেক প্রশ্নের জবাবে রুম্পা বলেন, পূর্বের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আমাকে কয়েকটি কাজ পরির্দনে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে ঠিক পেয়েছি। তবে এই প্রকল্পের কাজে অনেক অভিযোগ রয়েছে এটি সত্য। বিগত দিনেও এসব অভিযোগের কথা আমি শুনেছি।

উপরের ছবি: সিদ্ধকাঠি ইউনিয়নের রাজপাশা ছৈয়দ আইউব আলীর বাড়ির সামনের ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৪০০ টাকা বরাদ্দের বক্সকালভার্ট

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts