বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ অস্বাভাবিক ‘ক্যাশব্যাক’ আর ‘মূল্যছাড়’-এর মতো নানা লোভনীয় অফার দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক আলোচনায় এসেছে ডিজিটাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ই-ভ্যালি। মাত্র দুই বছর আগে ৫০ হাজার টাকা পুঁজিতে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
ইতিমধ্যে প্রায় ২৫ হাজার বিক্রেতা যুক্ত হয়েছেন ই-ভ্যালির সঙ্গে। নিবন্ধিত ক্রেতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫ লাখ। বিপুল সংখ্যাক এই ক্রেতার সময় মতো পণ্য না পাওয়ার অভিযোগ হরহামেশাই। অস্বাভাবিক ক্যাশব্যাক ও মূল্যছাড়ের কারণে কার্যত প্রতিষ্ঠানটির ক্রেতার কাছে ঋণি থাকতে হয়। অর্থাৎ পণ্য কিনতে ক্রেতাদের পরিশোধ করা টাকার ওপর নির্ভর করে ই-ভ্যালি।
ফলে ৩৫ লাখ ক্রেতার মধ্যে রয়েছে সন্দেহ-সংশয়। কিন্তু অস্বাভাবিক ক্যাশব্যাক ও ছাড়ের কারণে এখানে পণ্যের অর্ডার দেন তারা। এমনটাই দাবি ই-ভ্যালির একাধিক গ্রাহকের। আর এজন্য নানা হয়রানির মধ্যেও পড়তে হয় ক্রেতাকে।
আরিফুল হক রাকিব নামের একজন নিবন্ধিত গ্রাহক সময় নিউজকে জানান, তিনি গত এপ্রিল মাসে একটি ইয়ামাহা মোটর সাইকেল কিনতে ই-ভ্যালিতে ৮০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। পরে অর্ডারটি ক্যানসেল করতে হয়। ই-ভ্যালি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, অর্ডার ক্যানসেল হলে পেমেন্ট রিফান্ড হতে সাত দিন সময় লাগে। কিন্তু মাস পার হয়ে গেলেও তিনি রিফান্ড পাননি।
রাকিব জানান, আমি করোনায় আক্রান্ত হই। ফলে আমার চিকিৎসার জন্য জরুরী টাকার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাত দিন পার হয়ে গেলে আমি বার বার তাদের কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করি। পরে তারা আমার ফোন ধরা বন্ধ করে দেয়। এক দিনে ৭০ বারও ফোন দিয়েছি। একবারও ফোন রিসিভ করেনি।
পরে অবশ্য ই-ভ্যালির সঙ্গে যুক্ত এমন একজনকে খুঁজে বের করে টাকা রিফান্ড নিতে পেরেছিলেন বলে জানান রাকিব।
ই-ভ্যালির পণ্য দিতে গড়িমশি করা বা টাকা রিফান্ড করার ক্ষেত্রে এমন চিত্র সবক্ষেত্রেই। ফলে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরে ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ জমা পড়ে।
কিন্তু ই-ভ্যালি এক্ষেত্রে তাদের শর্তের (টার্মস এন্ড কন্ডিশনে) অজুহাতে পার পেয়ে যায়। পণ্যের অর্ডার প্লেস করার সময় তাদের শর্তে দেখা যায়, স্টক থাকা স্বাপেক্ষে ডেলিভারি হবে। কিন্তু তাদের কাছে এই পণ্যের কী পরিমাণ স্টক আছে আর কতটি অর্ডার নেয়া হবে তা উল্লেখ করা থাকে না।
বিষয়টি এক প্রকার প্রতারণা বলেই মনে করেন গ্রাহকরা। হাবিবুল্লাহ নামে ই-ভ্যালিতে নিবন্ধিত এক গ্রাহক বলেন, আমি একটি টেলিভিশন কেনার জন্য অর্ডার প্লেস করতে গিয়ে তাদের এই শর্ত দেখে আর অর্ডার করিনি। এখানে তারা স্টক থাকা স্বাপেক্ষে ডেলিভারির কথা বলেছে। কিন্তু তাদের কাছে কতটা স্টক আছে আর তার বিপরীতে কতটা অর্ডার নেবে তা উল্লেখ নেই।
সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে ‘ই-ভ্যালি অফার, হেল্প এন্ড রিভিউ’ নামে ই-ভ্যালির একটি গ্রুপ রয়েছে। এই গ্রুপে সদস্য রয়েছে প্রায় চার লাখ। গ্রুপে গিয়ে দেখা যায় ই-ভ্যালির পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা হয়।
মির্জা হোসাইন শুভ নামের একজন লিখেছেন, আমি নিজেই ৬ মাস প্রডাক্ট পাই না। সকলভাবে যোগাযোগ করেছি। কেউ কোন রেসপন্স করে নাই। আবেগে অনেকেই অনেক কথা বলে। কিন্তু মূলত যারা সমস্যায় পড়ে তারা কেবল বুঝে ই-ভ্যালি কী জিনিস। শুভর প্রডাক্ট কোড: EVL222735859।
সুফিয়ান আহমেদ রোজেম লিখেছেন, ই-ভ্যালিতে পণ্য আছে ১০টা, অর্ডার করবে ১ হাজার জন। ওরা ৯৯০ জনের টাকা দিয়ে ব্যবসা করবে। রিফান্ডের কথা বলবে কিন্তু সেটা কবে ঠিক নেই।
আঞ্জুমান সিদ্দিকি নামে একজন লিখেছে, ই-ভ্যালিতে পণ্য দিতে হয়তো দেরি করে এটা ঠিক। কিন্তু পণ্য দেয়ই না এটা বললে পাপ হবে। মিথ্যা বলে নিজেকে পাপের ভাগীদার বানাবেন না।
আঞ্জুমানের এই লেখায় বহু মানুষ কমেন্ট করেছেন। সেখানে মুসাফির নামে একজন লিখেছেন, তোমরা যে টাকা খেয়ে পোষ্ট দিচ্ছো সেটা খুব ভালো কাজ তাই না?
সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হওয়া অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড পেজে ই-ভ্যালি নিয়ে বলেন, পণ্য আছে ৫টি, যেহেতু কেউ জানে না, তাই টাকা জমা দিলেন হয়তো ১০০ জন। পণ্য পাবেন ৫ জন। বাকি ৯৫ জনের টাকা ঝুলে থাকবে। আর সবার বোঝা উচিত যে বিক্রেতা বা কোম্পানি আপনাকে পণ্যের সঙ্গে ১০০ শতাংশ, ১৫০ শতাংশ টাকা ফেরত দিচ্ছে। নিশ্চয়ই তিনি পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে বা পকেট থেকে দেবেন না। দেবেন নিশ্চয়ই অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বা অন্য কোনো অনৈতিক উপায়ে।
ই-ভ্যালির পুঁজি কত?
ই-ভ্যালির বর্তমান মাসে লেনদেন প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। কিন্তু তাদের নিজেদের পুঁজি মাত্র ৫০ হাজার টাকা। ই-ভ্যালি ডটকম লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে মাত্র ৫০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করে। এখনো সেই মূলধনই রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। তাদের অনুমোদিত মূলধন ৫ লাখ টাকা। পরিশোধিত মূলধনের মধ্যে ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল। বাকি ৪০ হাজার টাকা দিয়েছেন চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন। এই দুইজনই কোম্পানির শেয়ারের মালিক।
ই-ভ্যালির এত অল্প পুঁজির পরও এত বেশি ক্যাশব্যাক কীভাবে দেন তা নিয়ে গণমাধ্যমে মোহাম্মদ রাসেল বলেন, ১০০ টাকার যে পণ্যে ১০০ টাকার ক্যাশব্যাক দেওয়া হয়, তার ৬০ শতাংশ ই-ভ্যালির ব্যালান্সে যোগ হয়। ৪০ শতাংশ নতুন করে টাকা দিয়ে গ্রাহককে নতুন পণ্য কিনতে হয়। এতে ই-ভ্যালির লোকসান দাঁড়ায় ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। তবে ওই গ্রাহক যখন অন্য পণ্য কেনেন, তার লাভ থেকে আমরা লোকসান পুষিয়ে নিই।
ই-ভ্যালির বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষও সচেতন হচ্ছে। ই-ভ্যালির বিষয়ে অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন দুদকের মুখপাত্র প্রণব কুমার ভট্টাচার্য।
বাণিজ্য সচিব মো. জাফরউদ্দীনও বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘পণ্য বেচাকেনার উঠতি পদ্ধতি ই-কমার্সকে আমরা সমর্থন করছি। সামনে বিপুল সম্ভাবনা। তবে ই-কমার্সের নামে প্রতারণা মেনে নেওয়া হবে না। ই-ভ্যালি নিয়ে অভিযোগ পেয়েছি। খোঁজ নিচ্ছি। এর কার্যক্রম তো অনেকটা এমএলএম কোম্পানির মতোই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
কোম্পানি আইনে অভিজ্ঞ আইনজীবী আইনজীবী তানজীব-উল-আলম বলেন, ‘এমএলএম কোম্পানিগুলোর প্রতারণার চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে, ই-ভ্যালিও তাই করছে। ৫০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। কোম্পানির পরিচালকেরা সক্ষম হলে পরিশোধিত মূলধন বাড়াতে পারতেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এখানে মানি লন্ডারিং হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করে দেখতে পারে।’
সূত্র: সময় টিভি