বাংলাদেশের নরম মাটিতে ভূমিকম্প-প্রতিরোধী মোড়ানো বাঁধের উদ্ভাবন

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ বাংলাদেশের মতো নদীবিধৌত অঞ্চলের নরম মাটিতে মোড়ানো বাঁধ ভূমিকম্পে কীরকম আচরণ করবে তা একটি গবেষণায় উদ্ভাবিত হয়েছে। মোড়ানোবাঁধ মূলত Geotextile দ্বারা মোড়ানো বালুর বাঁধ যা খাড়াভাবে তৈরি করা হয়। বর্তমানে প্রচলতি বাঁধের দু’পাশে ঢালুু করে তৈরি করা হয়, যেকারণে বাঁধ তৈরিতে অনেক জায়গার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু মোড়ানোবাঁধে সেক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কম জায়গা লাগবে। এতেকরে খরচও অনেক কমে আসবে।

সম্প্রতি ড. রিপন হোড় গবেষণা কাজটি পরিচালনা করেন। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষণা সম্পন্নকৃত প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং বর্তমানে এলজিইডিতে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত।

ড. রিপন হোড় বলেন, আমার গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভূমিকম্প নরম মাটির ওপর মোড়ানো বাঁধের গতিশীল আচরণ বিশ্লেষণকরা এমন একধরনের বাঁধ নির্মাণ করা যা ভূমিকম্প-প্রতিরোধী হবে এবং প্রচলিত বাঁধের তুলনায় কম খরচে নির্মাণ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি এটি নির্মাণে কম জায়গার প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশের নরম মাটিতে মোড়ানো বাঁধ ভূমিকম্পে কিরকম আচরণ করবে সেটা পূর্বে জানা ছিল না। ফলে এধরনের মোড়ানো বাঁধ ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন অনুসারে নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। আমার এই গবেষণায় উদ্ভাবিত বাংলাদেশের নরম মাটিতে মোড়ানো বাঁধের গতিশীল আচরণ উদ্ভাবন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। এখন আর বাংলাদেশের নরম মাটিতে এধরনের মোড়ানো বাঁধ ডিজাইন অনুসারে নির্মাণ করতে আর কোনো সমস্যা থাকল না। ফলে মোড়ানো বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের ব্যাপক জমি অধিগ্রহণ ব্যয় হ্রাস করবে। এমনকি এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলে সড়ক ও জনপথসহ অন্যান্য সকল নির্মাণ কাজের আওতাভুক্ত ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় বিশাল অংশে কমিয়ে নিয়ে আনা সম্ভব হবে।

ড. রিপন হোড় তার গবেষণার ফলাফলে দেখিয়েছেন যে, প্রচলিত পদ্ধতিতে বাঁধ নির্মাণে যে পরিমাণ ভূমির প্রয়োজন হয়ে থাকে, এ নতুন পদ্ধতিতে বাঁধ নির্মাণ করা হলে প্রায় তার ৭০ ভাগ কম ভূমি প্রয়োজন।
গবেষণাতে তিনি মাটির নমুনার ওপর মোড়ানো বাঁধের মডেল প্রস্তুত করে শেকটেবিল-টেস্টের সাহায্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ভূকম্পন চালনা করলে এর ওপর কি কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সেটি পরীক্ষা করেন এবং প্ল্যাক্সিসথ্রিডি (PLAXIS3D) নামক একটা মডেলিং সফটওয়্যারে এ কাজটি কেসিমুলেশনের মাধ্যমে পরবর্তী যাচাই ও নিরীক্ষা করেন। এ পরীক্ষার জন্য প্রথমে মোড়ানো বাঁধের একটি প্রোটোটাইপ মডেল প্রস্তুত করা হয়েছে, যেখানে দুটি ভিন্নধরনের মাটি (কাদামাটি, বালু) ব্যবহার করা হয়েছে।

এ গবেষণার ফলাফল পরবর্তীতে এলজিইডি সড়ক ও জনপথ বিভাগসহ রেলওয়ে এবং অন্যান্য বিভাগেও যেসব পূর্তকাজ হয়ে থাকে, সেগুলোর ডিজাইনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘বিশেষকরে বাংলাদেশের মতো একটি দেশ যেখানে অর্থনৈতিক অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এক্ষেত্রে এই পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা একদিকে যেমন ভূমিকম্পের বিপরীতে শক্তিশালী অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারব, একইভাবে স্বল্প পরিমাণে ভূমি অধিগ্রহণ করে ব্যয়ও কমিয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হব। এরকম একটি পদ্ধতির বাস্তবায়ন আমাদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে নিয়ে আসবে। কোনো প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় যদি ১০০ কোটি টাকা হয়ে থাকে, যেখানে আমাদের এখন ব্যয় হবে মাত্র ৩০ কোটি টাকা। এ পদ্ধতি ইতোমধ্যে জাপানসহ অন্য দেশগুলোতে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’

এ প্রসঙ্গে ড. রিপন হোড় আরো জানান, আমাদেও দেশে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে ভূমিকম্পের ফলে মাটির গতিশীল আচরণ বিবেচনাতে রেখে ডিজাইন করা হয় না।এগুলো ডিজাইন করা হয় স্থির ওজন বিবেচনাতে রেখে, যা কিনা ভূমিকম্প কিংবা এধরনের যে কোনো দুর্যোগের বিপরীতে নাজুক থাকে।’

গবেষক ড. রিপন হোড় বলেন, ‘নরম মাটির মোড়ানোবাঁধের ওপর ভূকম্পন চালনা করে এর প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল নিরূপণকারী কোনো গবেষণা আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত হয়নি।’

বিশেষজ্ঞদের কাছে থেকে পাওয়া উপাত্ত অনুযায়ী, অতিসম্প্রতি সিলেটে চারটি মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, যা আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। ভূমিকম্পের বিষয়ে সব নির্মাণ কাজের সময় আমাদের বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

গবেষকদল গত ছয় বছর ধরে তিনটি ধারাবাহিক ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে নরম মাটির ওপর মোড়ানোবাঁধের জন্য ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়ায় গতিশীল বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করেছেন। তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল বিভিন্ন দেশের উন্নতমানের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

Print Friendly

Related Posts