প্যালকা, সোলকা, শিদল- উত্তরের তিন জনপ্রিয় খাদ্য উপকরণ

ফারুক আলম: রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি, লালমনিরহাটসহ উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় ব্যাপক লোভনীয় খাবার হচ্ছে প্যালকা, সোলকা ও শিদল।

এ অঞ্চলের বাসিন্দারা বলেন, ভাতের পাতে এক চামচ শিদল আর সঙ্গে সোলকা অথবা প্যালকা থাকলে খাওয়া হয়ে উঠবে আরো রুচিসম্মত।

মুখরোচক এসব খাবারে রয়েছে আদি-অকৃত্রিম ভালোবাসার টান। তেমনি বহন করে নিজ ঐতিহ্য। এই মৌসুমে এ অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় খাদ্য উপকরণ হচ্ছে, নাফা শাকের সোলকা আর সঙ্গে শিদল ভর্তা। সোলকার সাথে শিদল এসব অঞ্চলের মানুষের কাছে জিভে জল এনে দেওয়ার মতই খাবার। ভাতের সঙ্গে সোলকা, প্যালকা, শিদল হয়ে ওঠে তৃপ্তির পরম অনুসঙ্গ।

শীত মৌসুমের কয়েক মাস উত্তরাঞ্চলে প্রতিটি এলাকার ক্ষেতে এমন কি বাড়ির উঠোনের সামান্য ফাঁকা জায়গাতেও দেখা মিলবে নাফা শাকের চাষ। নাফা শাকের ভাজি, ঝোলতো রয়েছেই- তবে নাফা শাকের বেশি ব্যবহার হয় সোলকা তৈরিতে।

লালমনিরহাটের স্থানীয় অনেকেই জানান,সোলকা তৈরিতি নানান রকম শাক ব্যবহার হয়। তবে,এই মৌসুমে নাফা শাকই বেশি ব্যবহার করা হয়। নাফা শাকের জন্য পানি গরম করতে হয়। সেই পানিতে খাবার সোডা, কাঁচামরিচ, রসুন দিতে হবে। এসব দিয়ে পানি আবারও ফুটিয়ে সেখানে নাফা শাক দিতে হবে। শাক দেওয়ার পরে ১৫ মিনিট ঝাল দিয়ে নরম হলে সামান্য ঘেঁটে দিলেই তৈরি হবে সোলকা।

প্যালকা তৈরির নিয়মটা প্রায় একই। তবে এতে যে কোনো শাকের পরিবর্তে ব্যবহার হয় সজনে পাতা আর ভাজা চালের গুড়া। সজনে পাতা ডাটা থেকে আলাদা করে নিয়ে একই নিয়মে সোডা, মরিচ, রসুন, লবণ দিয়ে ঝাল করতে হয়। হয়ে গেলে পরিমান মত ব্যবহার করতে হয় ভাজা চালের গুড়া আর কাঁঠালের মৌসুমে কাঁঠালের বিচি।

লালমনিরহাটের স্থানীয় ফাতেমা বেগমের কাছ থেকে জানা গেলো শিদল তৈরির নিয়ম। এই সময় খাল-বিলের পানি শুকিয়ে গেলে ধরা পরে পুটি জাতীয় ছোট মাছ। এসব মাছ ধুয়ে বেছে রোদে শুকাতে হয়। শুকানোর পরে মিহি গুড়ো করতে হবে। আধা শুকানো কঁচুর ডাটা থেতলাতে হবে। কঁচুর ডাটা একদম গলে যাবার মত হলে দিতে হয় অল্প কয়েকটি রসুন আর মিহি করা শুটকির গুড়ো।মিশ্রনগুলো শক্ত হলে হলুদের গুড়া মিশ্রিত সরিষার তেল হাতে মেখে গোলাকার, লম্বাটে আকৃতির শিদল তৈরি হবে। দীর্ঘদিন ভালো রাখার জন্য ছাইয়ের কলশিতে বা পটে রাখা হয়।

স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠরা জানান,এক সময় এসব অঞ্চলের খাল বিল শুকানোর সময় আর বর্ষার সময় প্রচুর দেশী প্রজাতির ছোট মাছ পাওয়া যেতো। সেই সব ছোট মাছ পরিবারে দৈনন্দিন চাহিদা মিটিয়ে বেশির ভাগ দিয়ে শুটকি তৈরি হতো। সেই শুটকি থেকেই তৈরি হত শিদল।

স্থানীয় ময়েন উদ্দিন ও রঞ্জিত কুমার বলেন, মাছ মাংসের মত দামি খাবারের চেয়ে প্যালকা আর শিদল দিয়ে বেশি ভাত খাওয়া যায়। নাফা শাকের সোলকার সঙ্গে শুটকি ভর্তা বা শিদলের ভর্তা হলে আর কোনো কথাই থাকেনা,অতুলনীয় তৃপ্তি পাওয়া যায়।

রুহুল আমিন বলেন, প্যালকার সঙ্গে শিদল হলে আমি এক গামলা ভাত খাইতে পারি।

জনসম্মুখে নতুন করে এসব খাবারের পরিচিতি ঘটাতে চাইছে তরুণরা। এরই মধ্যে তরুণদের অনলাইন, সোস্যাল মিডিয়ার গ্রুপ, পেজ ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে সিদলের ব্যবসায়। অনেকেই সিদলের ব্যবসায়টাকে ব্যবসায়িক চিন্তা থেকে না করে, ভাবছেন ঐতিহ্যগত বিবেচনায়।

Print Friendly

Related Posts