রাত্রি শেষে’র কবি

শাহ মতিন টিপু

 

সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে আহসান হাবীবের খ্যাতি ছিল প্রায় প্রবাদতুল্য। এ দেশের বহু লেখক ও কবির জীবনের প্রথম রচনা তার হাত দিয়েই প্রকাশিত হয়। সর্বদাই জীবন যাপনে ছিলো তার দার্শনিক বোধ।

আহসান হাবীব ছিলেন আধুনিক কবি। যশস্বী কবি, সাংবাদিক ও সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীব ১৯৬৪ থেকে মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত দৈনিক পাকিস্তান থেকে দৈনিক বাংলায় রূপান্তরিত পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

এই কবির ১০৬তম জন্মদিন আজ। ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি তিনি পিরোজপুরের শঙ্করপাশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা হামিজুদ্দীন হাওলাদার, মা জমিলা খাতুন। পাঁচ ভাই চার বোনের পরিবারে সচ্ছলতা ছিলোনা। এই পরিবারে তিনিই প্রথম সন্তান। পারিবারিকভাবে আহসান হাবীব সাহিত্য-সংস্কৃতির আবহের মধ্যে বড় হয়েছেন৷

পড়ালেখা পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ও বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে৷ অর্থনৈতিক সংকটে কলেজের পাঠ অসমাপ্ত রেখেই কলকাতা পাড়ি জমান৷ কলকাতা গিয়ে শুরু হয় আহসান হাবীবের সংগ্রামমুখর জীবনের পথচলা।

তার প্রথম কবিতার বই ‘রাত্রি শেষে’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে কমরেড পাবলিশার্স থেকে। প্রকাশক ছিলেন বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। পরবর্তী সময়ে ‘ছায়া হরিণ’, ‘সারা দুপুর’, ‘আশায় বসতি’, ‘মেঘ বলে চৈত্রে যাবো’, ‘দুই হাতে দুই আদিম পাথর’ এবং ‘প্রেমের কবিতা’সহ বেশকিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

শিশুকিশোর রচনায় তিনি নিয়ে আসেন নতুন ব্যঞ্জনা। ‘ছুটির দিনদুপুরে’, ‘পাখিরা ফিরে আসে’ এ দুটি বাংলা শিশু সাহিত্যে তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এছাড়া শিশুকিশোরদের জন্য লেখা অন্য গ্রন্থগুলি হলো ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’, ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম’, ‘রাণীখালের সাঁকো’, ‘জোস্না রাতের গল্প’, ‘ছোট মামা দি গ্রেট’ ইত্যাদি। আহসান হাবীবের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৮টি। অন্যান্য লেখাসহ সব মিলিয়ে তার গ্রন্থের সংখ্যা ২৫।

সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ আহসান হাবীব ১৯৬১ সালে ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৭৮ সালে লাভ করেন একুশে পদক। এর বাইরেও অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

আহসান হাবীব কলকাতায় ১৯৩৩-৩৪ সাল থেকে ১৯৪৯-৫০ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। বলতে গেলে তার সাহিত্যচর্চার স্বর্ণযুগ ছিল ওই সময়ই। বিশেষ করে ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এক দশক তিনি নিরলসভাবে লিখে গেছেন। জীবনের অধিকাংশ সেরা ও বিখ্যাত কবিতা ও গল্পগুলো তিনি লিখেছেন ওই সময়েই।

আহসান হাবীবের কবিতায় একদিকে রয়েছে গভীর সংবেদনশীলতার স্নিগ্ধ সুর, অন্যদিকে রয়েছে বিনয়ী প্রতিবাদময় সমাজ মনস্কতা। এক পর্যায়ে কবি বেশ কিছু সাড়া জাগানো ব্যাঙ্গ কবিতা লিখেছেন। সব মিলিয়ে তার কবিতায় রয়েছে শান্ত, নিরুপ্রদব জীবনের জন্য মমতা ও আর্তি।

‘আনন্দ’ কবিতায় তিনি লেখেন-

আনন্দ রে আনন্দ বল, কোথায় রে তোর বাসা,
তুই কি আমার মা, নাকি তুই মায়ের ভালবাসা?
বাবার হাতে তুই কি উথাল মাটিতে ধান বোনা?
মায়ের হাতে কুলোয় ভরা ধানের মত সোনা?
তুই কি আমার ঘরের চালে ফুরিয়ে যাওয়া রাত?
তুই কি আমার সান্কি ভরা ফুলের মত ভাত?

‘এই মন–এ মৃত্তিকা’ কবিতায় লেখেন-

চেনা পৃথিবীকে ভালোবাসিতাম জানাজানি ছিলো বাকী
জানতাম না তো সে পরিচয়েতে ছিল অফুরান ফাঁকি।

‘সেই অস্ত্র’ কবিতায় লেখেন-

সেই অস্ত্র আমাকে ফিরিয়ে দাও/সে অস্ত্র উত্তোলিত হলে/পৃথিবীর যাবতীয় অস্ত্র হবে আনত/সে অস্ত্র উত্তোলিত হলে/অরণ্য হবে আরো সবুজ।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts