তাওরাত তানিজ: শীতকাল আসলেই প্রকৃতিতে হরেক রকমের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। নতুন ধানের আমেজ, নতুন নতুন পিঠা তৈরি, শাক-সবজিসহ অনেক কিছুই দেখা যায়। তার মধ্যে অন্যতম আরেকটি অনুষঙ্গ হচ্ছে খেজুর গাছ থেকে ‘রস’ সংগ্রহ।
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু প্রমাণ করেছিলেন ‘গাছেরও প্রাণ আছে, অনুভূতি আছে, সুখ-দুঃখ, অভিমান সবটাই আছে’। যেমনটি মানুষের আছে। খেজুর গাছ অনেক কষ্টই সহ্য করে শীতকালে। যেমনটি শীত আসলে মানুষ করে থাকে। তবে খেজুর গাছের কষ্টটাই অন্যরকম।
যিনি খেজুরের রস আহরণে ব্যস্ত থাকেন, তিনিই জানেন গাছের কষ্টটা কতটুকু হয়। জ্যান্ত একটি গাছের ছাল ছাড়িয়ে, সেখানে পেরেক কিংবা সূক্ষ্ম কাঠি ঢুকিয়ে হাঁড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এই কষ্ট মানুষ কেমনে বুঝবে, যদি না এই বিষয়ে জ্ঞান থাকে! খেজুর গাছের আরেক নাম হলো ‘ক্ষত বৃক্ষ’ বা ‘Wounded Tree’। হাজারো কষ্ট সহ্য করে হলেও খেজুর গাছ আমাদের সুস্বাদু রস দিয়ে থাকে।
এখন অনেকের মনে প্রশ্ন থাকতেই পারে, কেনোইবা শীতকালেই খেজুর গাছের রস বের হয়? গ্রীষ্ম, বর্ষাকালে কেন হয় না?খেজুর গাছ এক ধরনের তাল জাতীয় বৃক্ষ। ডাব, তাল, সুপারি এসব গাছের মতোই খেজুর গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো ‘Phoenix dectylifera’। খেজুর গাছের বৈজ্ঞানিক নামের দ্বিতীয় অংশ dactylifera দুটি ভাষা থেকে এসেছে, একটি অংশ dactulos এটি গ্রিক ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে, যার অর্থ ‘খেজুর’। অপর অংশ fero, এটি ল্যাটিন ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘আমি বহন করি’। তাহলে dactylifera শব্দের পূর্ণ অর্থ হয় ‘খেজুর বহনকারী’।
খেজুর গাছের কাণ্ড নরম, রসালো। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কাণ্ড শক্ত হতে থাকে। শুষ্ক মরুভূমিতে এরা ভালো জন্মে। তবে বিশ্বের নাতিশীতোষ্ণ ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলেও এদের ব্যাপক বিস্তৃতি লক্ষ করা যায়।
খেজুর গাছের রস প্রক্রিয়াকরণ-
সাধারণত সব গাছ মূলের মাধ্যমে পানি শোষণ করে। এই পানি পাতায় পৌঁছে গেলে পাতায় সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি হয়। সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে যে খাবার তৈরি হয়, তা গ্লুকোজ। গ্লুকোজ পরে সুক্রোজ বা চিনিতে রূপান্তরিত হয়। গাছের বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার জন্য এই চিনি খরচ হয়ে যায়।
খরচ হওয়ার পর যদি চিনি বেঁচে যায়, তাহলে চিনিগুলো স্টার্চ নামক অদ্রবণীয় জটিল শর্করা হিসেবে জমা থাকে। চিনি মিস্টি হলেও স্টার্চ কিন্তু মিষ্টি নয়। বর্ষাকালে মাটিতে প্রচুর পানি থাকে, তাই মূলের মাধ্যমে প্রচুর পানি শোষণ করে পাতায় প্রচুর খাদ্য তৈরি হয়। শীতকালে মাটিতে পানি কম থাকে, তাই পানির অভাবে পাতায় কম খাদ্য তৈরি হয়। শীতকালে স্বাভাবিক বৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য খেজুর গাছ অতিরিক্ত খাদ্য মজুদ করে রাখে।
তাপমাত্রা কমতে শুরু করলে মূল থেকে পানির শোষণ কম হতে থাকে। তাপমাত্রা কমে যাওয়ার সংকেত খেজুর গাছের কোষে এক ধরনের এনজাইম ক্ষরণ হতে থাকে এই এনজাইমের প্রভাবে জমিয়ে রাখা স্টার্চ ভেঙ্গে আবার চিনিতে পরিণত হয়। মূল থেকে উঠে আসা পানির সাথে এই চিনি মিশে একটি মিষ্টি সরবত তৈরি হয়। এটাই হলো খেজুরের রস। যেহেতু মূল থেকে উঠা পানি উপরের দিকে ধাবিত হয়, তাই রস উপরের অংশে থাকা কোনো ক্ষত দিয়ে বের হয়। যেটা আহরণকারীরা গাছের ডগার ঠিক নিচের অংশে কেটে বের করে।
শীতকালে গাছের প্রস্বেদন কম হয়, তাই গাছ থেকে খুব কম পরিমাণ পানি বাষ্পাকারে বের হয়। গাছে ক্ষত থাকলে সেই ক্ষত দিয়ে চিনি মিশ্রিত রস বের হয়। রস যত বের হবে, তত ব্যাপন চাপ ঘাটতি সৃষ্টি হয়, এই চাপ ঘাটতির কারণে একটি চোষণ শক্তির উদ্ভব হয়। চোষণ শক্তির প্রভাবে মাটি থেকে পানি শোষিত হয় এবং শীতকালজুড়ে রস বের হতে থাকে।
একটি খেজুর গাছের বয়স কমপক্ষে ৫ বছর না হলে রস উৎপাদন করতে পারে না। একটি পূর্ণ বয়স্ক খেজুর গাছ শীত মৌসুমে ১৫০-১৬০লিটার রস উৎপাদন করতে পারে। গাছের গোড়ায় যদি ছিদ্র করা হয়, তাহলে রস আহরণ করা যাবে না।
লেখক: শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক, পোর্টসিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম।