হাসনাত আব্দুল হাই
সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, সফিউর, অহিউল্লা, আওয়াল – এই শিরোনামে সাতটি ছোট গল্প লিখেছেন বহুমাত্রিক লেখক কাজী জহিরুল ইসলাম। নামগুলি গল্পের নায়কের, তাঁরা ইতিহাসের চরিত্রও বটে। আমাদের ‘জাতিসত্তার উত্থানপর্বের নায়ক’ এই সাত ভাষা শহীদের মধ্যে পাঁচজনের নাম এখনো উচ্চারিত হয়, বাকি দুজন – রিকশাচালক আউয়াল এবং রাজমিস্ত্রি- পুত্র অহিউল্লা প্রায় বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বসেছে। এই সাতজনকেই রক্ত-মাংসের শরীরে এবং কল্পনার সাহায্যে তুলে এনেছেন লেখক পরম শ্রদ্ধায় এবং ভালবাসায় সিক্ত করেছেন তার গল্পে। বাস্তব এবং কল্পনার এমন নিপুণ এবং বিশ্বাসযোগ্য মেলবন্ধন লেখকের শক্তিমত্তার পরিচয় দেয়। ফলশ্রুতিতে উঁচু মানের যে সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে তা শুধু অনবদ্য নয়, অভূতপূর্ব। ভাষা-শহীদদের নিয়ে অনেকে লিখেছেন, কিন্তু এমন মুন্সিয়ানা আর কেউ দেখাতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। গল্পগুলি পড়তে গিয়ে যুগপৎ ইতিহাস এবং সৃজনশীল সাহিত্য পাঠের যে অভিজ্ঞতা হবে পাঠকের তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
(ক) বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে ‘পুত পুত পুত পুত’ করে ডাকতে ডাকতে একটি আইড়াকুপি পাখি বেরিয়ে আসে।দাঁড়কাকের চেয়ে বড়, গোলগাল, কালো রং- এর একটি পাখি। পিঠের ওপর হালকা খয়েরি রং-এর পোঁচ। উঠান পেরিয়ে পাখিটা দৌড়াতে দৌড়াতে অন্যপাশের জঙ্গলে চলে যায়। (সালাম)
(খ) টিনের বাড়িতে কাঠের গেট, গেটের ওপর মাধবীলতার ডাল, সবুজ পাতার উঁকি প্রাণের জানান দিচ্ছে। গেট খোলে বাইশ বছরের এক যুবক। ওর পরনে হাতে বোনা নীল সোয়েটার, সোয়েটারের ভেতর থেকে সাদা শার্টের হাতা বেরিয়ে এসে কব্জি ঢেকে রেখেছে। লম্বাটে মুখ, টিকালো নাক, কিছুটা ম্রিয়মান চোখ, ফর্সা এই যুবকের নাম আলাউদ্দিন। (বরকত)
(গ) তাম্বুলরসে ঠোঁট লাল করা তিন তরুণীর খোলা চুল উড়ছে শীতলক্ষ্যার হাওয়ায়। কুড়ির আশেপাশে বয়স, হাতাকাটা ব্লাউজের ওপর কোনো রকমে পেঁচানো ক্যারোলিনের শাড়ি। মুখের ওপর পাউডারের ঘন প্রলেপ কারো হাতের, ঠোঁটের, দেহের স্পর্শে ফিকে হয়ে এসেছে। ফুলের নামে ওদের নাম – বেলি, জুঁই, বকুল। (জব্বার)
এই কয়েকটি উদ্ধৃতির উল্লেখ করা হল, এমন আরো আছে। কাজী জহিরুল ইসলাম যে ইতিহাসের বাস্তবতা নিয়ে উঁচুমানের সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে? এমন ডিটেইলস যিনি দিতে পারেন তিনি ভাষাশিল্পী।
লেখক প্রবাসী, তাই তাঁর প্রচার নেই। এমন আরও প্রবাসী লেখক আছেন যারা স্বীকৃতির তোয়াক্কা না করে নিরলসভাবে বাংলাভাষা এবং সাহিত্যের চর্চা করে যাচ্ছেন। তাঁদেরকে ধন্যবাদ দিই এবং অভিনন্দন জানাই।
(লেখক হাসনাত আব্দুল হাইয়ের ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে)