কাজী জহিরুল ইসলাম
পৈত্রিক সম্পত্তির ওপর নির্মিত বহুতল ভবনের নিচে,সিঁড়িঘরের মতো অন্ধকার এক প্রকোষ্ঠ। ছোট্ট একটি টেবিল, টেবিলের পেছনে একটিমাত্র প্লাস্টিকের চেয়ার। তার পেছনে অপরিচ্ছন্ন বিছানা। দেয়ালের দিকে মুখ করে চেয়ারে বসে আছে আমার বন্ধু পিয়াল। অন্ধ চোখ দুটি কালো চশমার আড়ালে লুকানো। ডানদিকে, পায়ের নিচে, ফ্লোরের ওপরে রাখা একটি ফ্লাস্কে চা এবং একটি পানির বোতল। সারাদিন এই ঘরেই ওর দিন কাটে। খাবারের জন্য অপেক্ষা করে, রাত্রির জন্য অপেক্ষা করে। কে জানে হয়ত এক দীর্ঘ রাত্রি, এক দীর্ঘ নিদ্রার অপেক্ষায় বসে আছে পিয়াল। মাঝে মাঝে পায়ের কাছ থেকে ফ্লাস্ক তুলে, ফ্লাস্কের ছিপিতে ঢেলে চা খায়, তেষ্টা পেলে বোতল খুলে পানি খায়।
আমি ঘরে ঢুকে ওর কাঁধে হাত রাখি।
– চিনতে পেরেছিস?
– তোফায়েল।
– উম হুম। হয়নি, ভেবে বল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে পিয়াল। বুঝি স্মৃতির কোনো গভীর গিরিখাদ থেকে তুলে আনার চেষ্টা করছে চেনা কোনো কণ্ঠস্বর। হঠাৎ ওর মুখে হাসির আভাস।
– জহির।
আমি বলি, হ্যাঁ। প্রায় কুড়ি বছর দেখা নেই। কন্ঠ শুনেই চিনে ফেলেছিস?
ও কোনো কথা বলে না। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। আমার অবয়ব লক্ষ করে এগিয়ে আসে। আমরা দুই বন্ধু পরস্পরকে বুকে জড়িয়ে ধরি। আমি ছাড়তে চাই, কিন্তু ও কিছুতেই বিচ্ছিন্ন হতে চায় না।
– আমি জানি তুই আমার খোঁজ নিস। কেমন আছিস?
– আমি তো ভালোই আছি। তুই?
– আছি।
নমী এবং সোহেল একটু আড়ালে গেলেই জিজ্ঞেস করি, নিপার কথা মনে পড়ে?
তখনই ওর পাগলামিটা শুরু হয়ে যায়।
– মার্কিন দূতাবাস ওকে মেরে ফেলেছে।
– তাই নাকি?
– হুম। জানিস তো ওর গর্ভে জন্ম নেয়া আমার দুটি ঔরশজাত সন্তান আছে। একজন রবীন্দ্রনাথ, অন্যজন নজরুল।
– ওরা কোথায়?
– আছে, পার্বত্য এলাকায়। তুই আমাকে নিয়ে যাবি? অনেকদিন ওদের দেখি না। ভ্রমণটা গাড়িতেও হতে পারে আবার ইথারেও হতে পারে।
– তাহলে ইথারেই হোক। বেশ দ্রুত যাওয়া যাবে।
– আমি গাড়িতে যাবো, তুই ইথারে আসবি। তোর সঙ্গে গাড়ি আছে তো?
– আছে
– তাহলে কথা দিচ্ছিস, তোর গাড়িতে আমি যাচ্ছি। সম্ভব হলে আজ রাতেই।
আমি প্রসঙ্গ পাল্টাই।
– লিখছিস কিছু?
– হ্যাঁ, বনেট লিখছি।
– বনেট?
– হ্যাঁ বনেট। সনেটের চৌদ্দ লাইনের প্রথম অক্ষর দিয়ে আরো একটি চৌদ্দ অক্ষরের লাইন। ১৫ লাইনের বনেট। রাজা পিয়াল গুলশানী-উদ্ভাবিত নতুন ধারার কবিতা।
– একটি শোনা তো দেখি।
পিয়াল আমাকে বনেট শোনাতে শুরু করে। আমি আঙুলে মাত্রা গুনছিলাম। একটি লাইনেও মাত্রার কোনো হেরফের নেই। আমার বিস্ময় ও বুঝে ফেলে।
– আঙুলে গুনে কোনো লাভ নেই বন্ধু, মাত্রায় ভুল পাবি না।
– তুই দেখতে পাস?
– না।
– তাহলে বুঝলি কিভাবে আমি আঙুল গুনছি?
– তুই জহির না। তোর কাজই তো ছন্দের ভুল ধরা। ভুলে গেছি ভেবেছিস জসীম উদদীন পরিষদের সেই দিনগুলি? সাহিত্য সভাগুলোতে তুই ছিলি এক তুখোর সমালোচক।
– কিছুই দেখতে পাস না?
– শুধু আলোটা টের পাই।
– মানুষের অবয়ব?
– তাও বুঝি না।
– লিখিস কিভাবে?
– মাথায় লিখি।
– আর সবাইকে শোনাস?
– না, কাউকে শোনাই না। তোকেই শোনালাম। আর কাকে শোনাব বল, কেউ তো আসে না।
– কেউ আসে না? বন্ধুরা? আমরা যারা একসঙ্গে লিখতাম?
– না, কেউ আসে না। শোন তুই আমার ওয়েবসাইটটা দেখেছিস?
– না দেখিনি তো? ওয়েবসাইটের এড্রেস কি?
– রাজা পিয়াল গুলশানি ডট কম।
– ও আচ্ছা।
– তুই কি জানিস আমি সাহিত্যে নোবেল পেয়েছি?
– না, জানি না তো? কবে পেলি?
– ২০১০ সালে। ফিজিক্সেও পেয়েছি।
– ও আচ্ছা।
– তোর কি অবিশ্বাস হচ্ছে?
– একদম না।
– নোবেল কমিটির ওয়েবসাইটে গেলেই দেখতে পাবি।
প্রথমে মনে হয়েছিল, মাথাটা বুঝি একটু ঠিক হয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ কথা বলেই বুঝে ফেলি, যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই আছে।
আরো একবার বন্ধুর কাঁধে সৌহার্দ্যের হাত রাখি।
– বন্ধু, যাই রে।
– তোর গাড়িতে আমি কিন্তু যাচ্ছি পার্বত্য অঞ্চলে।
– আচ্ছা।
পিয়াল আবারও এগিয়ে আসে।
– আরেকটু বোস। চা খেয়ে যা।
– না রে, একটা শিডিউল আছে। এক্ষুনি উঠতে হবে।
পিয়াল আরো কাছে এগিয়ে আসে। আবার আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার কানের কাছে মুখ এনে বলে, তুই যে আমার খোঁজ-খবর নিস সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ।
– তোকে নিয়ে আমি একটি কবিতা লিখেছি।
– পড়েছি। দুঃখিত পড়িনি। ওরা পড়ে শুনিয়েছে। তোকে অনেক ধন্যবাদ।
– ভালো থাকিস বন্ধু।
ফিরতে ফিরতে নমীকে বলি। ও খুব একা রে নমী। যেসব বন্ধু ঢাকায় আছে ওরা কি মাসে একবার করে এসে ওকে দেখে যেতে পারে না?
ঢাকা। ২ মার্চ ২০২২।
লেখক: কবি ও ভাষাশিল্পী এবং জাতিসংঘ সদর দফতরে কর্মরত আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা।