ঢাকার বইমেলা

কাজী জহিরুল ইসলাম
ঢাকার বইমেলায় গিয়ে অনেক গুণী মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। অনেক প্রকাশক, লেখক, সাংবাদিক, পাঠকের সঙ্গে আন্তক্রিয়ার একটি সুযোগ ঘটেছে। এ ছাড়া যারা আমার লেখা পড়তে চান, পড়েন এবং ভালোবাসেন তেমন অনেকের সঙ্গেও দেখাটা হয়ে গেল এবার। স্কুলের বন্ধুরা, ব্যাচমেটরা আমার ঢাকায় অবস্থানকালীন সময়টাকে আনন্দময় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, আমি ওদের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
মেলায় এবং মেলার বাইরে যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং যাদের নাম মনে আছে বলি, ভাষাসৈনিক আনোয়ারুল হক, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা, কবি ফরিদ আহমেদ দুলাল, বহুমাত্রিক লেখক হাসনাত আবদুল হাই, কবি আমিনুল ইসলাম, শিক্ষামন্ত্রী ও সম্পাদক ডা. দীপু মনি, কবি তুষার দাশ, কবি মতিন রায়হান, কবি জাহিদুল হক, কবি জাহিদ হায়দার, কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ, কবি মাহবুব হাসান, কবি আতাহার খান, কবি হাসান মাহমুদ, লেখক অনিন্দিতা মুক্তা, কবি হাসানাত লোকমান, কবি জরিনা আখতার, কবি নাসরীন নঈম, কবি ব্রাত্য রাইসু, কবি মুহম্মদ আবদুল বাতেন, কবি ফেরদৌস সালাম, কবি ফজলুল হক তুহিন, চিন্তাবিদ সলিমুল্লাহ খান, সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, গোলাম কুদ্দুস, কবি শামস আল মমিন, কবি তুষার দাশ, নাট্যজন সরওয়ার হারুণ, প্রাবন্ধিক আহমাদ মাযহার, কবি কবির হোসেন, কবি রহিমা আখতার কল্পনা, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মীর বরকত, জাঁ-নেসার ওসমান, কবি রেজা অনিরুদ্ধ, জাহানারা বুলা, নীলা হাসান, হাবিবা হুদা, মাসকুর-এ সাত্তার কল্লোল, সাংবাদিক শামসুদ্দিন হিরা, সিরাজ ভাই (সাবেক এমপি), প্রজ্ঞা লাবনী, প্রকাশকদের মধ্যে আগামীর ওসমান গণি, অনিন্দ্যর আফজাল হোসেন, অনন্যার মনিরুল হক, স্কলারসের চৌধুরী শামীম, অগ্রদূতের মনি এবং রনি, এশিয়ার আশরাফুল ইসলাম তুষার, স্বরে-অর রাজু, নালন্দার জুয়েল, শব্দঘরের সম্পাদক মোহিত কামাল, সাম্প্রতিক দেশকাল পত্রিকার সম্পাদক ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ, নাসরিন আখতার, জলধির নাহিদা আশরাফী, রোকন রেহান, অধ্যাপক কিশওয়ার কামাল, অধ্যাপক সোনিয়া আমিন, মহিউস সুন্নাহ প্রমূখ।
আমার বন্ধুদের মধ্যে মাসুম রাব্বানী, সুবিনয় আনোয়ার নমী, জসীম মাহমুদ, আহসান হাবীব পিয়াল, সোহেল রানা, মনির, কামরুল, জ্যোতি, রাজ্জাক খান, মহুয়া আহমেদ, মিজান, মাসুম, দোলনা, নাসরিন, আশরাফ, ইসবাত, আনার কলি, নন্দিনী, গীতিকার আহমেদ রিজভী প্রমূখ।
এ ছাড়া আরো অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে যাদের নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না।
লেখকেরা মিথ্যচারও করছেন প্রচুর, প্রকাশকেরাও পিছিয়ে নেই। কোনো কোনো বই মেলায় আসার আগেই ৩/৪ এডিশন শেষ, এইরকম অভিযোগও শুনছি। কারো পাঁচ কপি বিক্রি হলেই বলছেন, আজ ২০০ কপি গেল। যেন কোনোভাবে প্রচার করতেই হবে “আমি খুব বড়ো লেখক”। ফেইকের আধিপত্যই অধিক চোখে পড়ছে। টিভি ক্যামেরাগুলো সেজে-গুজে আসা সুন্দরী নারীদের ইন্টারভিউ নিচ্ছে, ভালো বই প্রসঙ্গে তারা অজ্ঞতাবশত বিব্রত হচ্ছেন অথবা বিভ্রান্ত তথ্য দিচ্ছেন। অনেক রিপোর্টারের সৃজনশীল এবং মননশীল গ্রন্থ-জ্ঞান খুব সীমিত। তারা লেখকদের বালখিল্য প্রশ্ন করছেন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সুবিশাল বইমেলার ভেতরে নিজেকে খুব লস্ট মনে হচ্ছিল। প্রথম দিন মনে হচ্ছিল খুব অচেনা একটি জায়গায় ঢুকে পড়েছি। আস্তে আস্তে কিছুটা চেনা হয়ে উঠেছে। মেলায় ঘুরে ঘুরে আমার যা মনে হয়েছে, কিছু পপুলার বই হয়ত প্রকৃত ক্রেতারাই কেনেন তবে অধিকাংশই লেখকদের মুখচেনা ক্রেতার উপস্থিতি। তারা (অ)লেখককে ঘিরে কৃত্রিম জটলা তৈরি করছেন। অধ্যাপকদের বই তাদের ছাত্র-ছাত্রীরা, ব্যাংকার বা আমলার বই অধস্তনেরা, ফেইসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ আছে, সেইসব গ্রুপের লোকেরা নিজেদের বই কিনছেন। আমার ধারণা এইসব ক্রেতারা শুধু ফেইসবুকে ছবি পোস্ট দেবার জন্য এবং লেখককে খুশি করার জন্যই বই কিনছেন। অবশ্য এসব বইয়ের অধিকাংশই পাঠযোগ্য কিছু নয়।
লেখকেরা মিথ্যচারও করছেন প্রচুর, প্রকাশকেরাও পিছিয়ে নেই। কোনো কোনো বই মেলায় আসার আগেই ৩/৪ এডিশন শেষ, এইরকম অভিযোগও শুনছি। কারো পাঁচ কপি বিক্রি হলেই বলছেন, আজ ২০০ কপি গেল। যেন কোনোভাবে প্রচার করতেই হবে “আমি খুব বড়ো লেখক”। ফেইকের আধিপত্যই অধিক চোখে পড়ছে। টিভি ক্যামেরাগুলো সেজে-গুজে আসা সুন্দরী নারীদের ইন্টারভিউ নিচ্ছে, ভালো বই প্রসঙ্গে তারা অজ্ঞতাবশত বিব্রত হচ্ছেন অথবা বিভ্রান্ত তথ্য দিচ্ছেন। অনেক রিপোর্টারের সৃজনশীল এবং মননশীল গ্রন্থ-জ্ঞান খুব সীমিত। তারা লেখকদের বালখিল্য প্রশ্ন করছেন। মিডিয়ার কাছে দর্শক শ্রোতারা প্রত্যাশা করেন সর্বাধিক বিক্রিত বই, ভালো বই কোনগুলো সেই তথ্য, কিন্তু বিভ্রান্তিই মিলছে বেশি। বইমেলাকে, ভালো বইকে, প্রোমোট করার প্রবণতা মিডিয়ার বেশ কম। আগের মতো ৩০ মিনিট ধরে মেলার লাইভ এখন আর কোনো টিভি প্রচার করছে না।
স্টলগুলোর ওপরে নবীন লেখকদের বিশাল সব ছবি লাগানো। অপেক্ষাকৃত প্রবীন এবং প্রাজ্ঞ লেখকদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সংস্কৃতি প্রায় তিরোহিত। যারা অতি তরুণ, দুর্বল লেখায় সমৃদ্ধ বই বের করছেন, তারা সিনিয়র লেখকদের হাতে নিজেদের বই তুলে দিয়ে অভিযোগ করছেন তিনিও কেন তাদেরকে বই উপহার দিচ্ছেন না। বই কেনার চেয়ে উপহার পাওয়ার প্রবণতা বেশি।
অধিক বিক্রি হচ্ছে ভাষা শেখা, ব্যাবসা শেখা, মোটিভেশনাল বক্তব্য, ধর্মজ্ঞান, রাজনৈতিক বক্তব্য (ভুল তথ্যে ভরা) সমৃদ্ধ বই। নতুন লেখকেরা নিয়মতান্ত্রিক চর্চার মধ্য দিয়ে নিশ্চয়ই একদিন ভালো লেখক হয়ে উঠবেন। কিন্তু দেখা যায় নিয়মতান্ত্রিক চর্চায় অধিকাংশেরই তেমন আগ্রহ নেই। আমি প্রচুর বই উপহার পেয়েছি। সবগুলোই কিছু কিছু পড়ার চেষ্টা করেছি। হাতে গোনা দুয়েকটি ছাড়া অধিকাংশই অতিমাত্রায় মানহীন। বিভিন্ন স্টলে ঘুরে ঘুরে অচেনা লেখকদের বই ঘেঁটে দুয়েক প্যারাগ্রাফ পড়ে দেখেছি, মানহীন বইয়ের সংখ্যাই বেশি। অথচ বইগুলোর ছাপা, বাঁধাই, প্রচ্ছদ কী অসাধারণ। ওজন সমস্যার কারণে উপহার পাওয়া সব বই আমি নিউইয়র্কে নিয়ে যেতে পারবো না। ভেবেছি কাউকে কাউকে দিয়ে যাই। পরে দ্বিধায় পড়ে গেলাম। এইসব মানহীন বই পড়ে ওরা আমার ওপর অসন্তুষ্ট হবে অথবা সাহিত্যের মান সম্পর্কে ওদের ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হবে। এই বইগুলো নিয়ে আমি এখন কি করবো?
মেলায় একটি হৈ-হুল্লোড় এবং হুলুস্থুল ব্যাপার থাকবে। দর্শনার্থীরা আনন্দে মেতে থাকবেন এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু বইমেলায় আগত দর্শনার্থীদের মুখে জ্ঞানতৃষ্ণা এবং জ্ঞানান্বেষণের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি দেখতে পাবো এই প্রত্যাশাই থাকে বেশি, সেটি খুব কমই চোখে পড়েছে।
লেখক: কবি ও ভাষাশিল্পী এবং জাতিসংঘ সদর দফতরে কর্মরত আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা।
Print Friendly, PDF & Email

Related Posts