রুদ্র হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বলল, বাবা গ্যারেজে একটা লোক বসিয়ে রেখেছি। তুমি তাকে বাড়ির জন্য কেয়ারটেকার হিসেবে রেখে দিতে পারো। দেখে মনে হচ্ছে লোকটা খুবই দরিদ্র। ঢাকায় নিজের বলতে কেউ নেই। বয়স অনেক, ষাটের ওপর হবে। তবে চলতে ফিরতে পারে।
বাড়িতে একজন কেয়ারটেকারের কত রকমের কাজ থাকে, এমন মাজুর শ্রেণীর একজনকে কেয়ারটেকার হিসেবে আবার রাখে কি করে! ছেলের অপরিপক্কতায় বিরক্ত হন মহিউদ্দিন সাহেব, বোকার মতো কথা বলো না রুদ্র, একজন শক্ত-সামর্থ্য লোক খুঁজে দেখো। তোমার বোঝা উচিত বাড়িটা ছ’তলা। ছাদের উপর কতো কাজ! লিফট নাই, এমন বয়সের একজন কী করে ছাদে উঠানামা করবে?
কিন্তু রুদ্র তার কথাতে অটল। লোকটার ওপর তার মায়া পড়ে গেছে। মহিউদ্দিন সাহেব ত্যক্ত-বিরক্ত ছেলের ওপর। একমাত্র সন্তান, রাগ করেও বেশিক্ষণ থাকতে পারেন না। অগত্যা মেনেই নেন সবকিছু। তবে এর প্রভাব গড়িয়ে গিয়ে পড়ে স্ত্রীর ওপর, শোনো, জীবন কী তা এখনো তোমার ছেলে বোঝে না! মন এতো দুর্বল হলে চলে না, জীবন বড়ো নির্মম বুঝিয়ে বলো।
এমবিএ করা রুদ্র চাকরি করে একটা সরকারি ব্যাংকে। ইদানিং কী হয়েছে তার, মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা গাদা গাদা বই, জার্নাল এসব কিনে আলমারি ভরে ফেলেছে। ছেলের এই একটি বিষয় মহিউদ্দিন সাহেবের খুব ভালো লাগে। তিনি নিজে যুদ্ধে যেতে পারেননি, বয়স ছিলো মাত্র আট কি নয়। তবে মা-বাবা-ভাই-বোনসহ পরিবারের সবার ছোটাছুটিতে দেশে কিছু যে একটা হচ্ছে আঁচ করতে পেরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তার যা-কিছু অর্জন তা বই আর পত্র-পত্রিকা পড়ে। এটি দেশের প্রতিটি নাগরিকেরই জানা দরকার, নিজেদের ভেতর ধারণ করা উচিত। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সূর্যসন্তান। আমাদের অনুভবের মধ্যে সবসময়ই জাগ্রত রাখতে হবে তাঁদের। মহিউদ্দিন সাহেব কিছু বলেন না ছেলেকে।
রুদ্র একদিন রাতে খাবার টেবিলে বসে বলল, বাবা, আমার এই লাইব্রেরীটাকে আমি মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা বই আর পত্র-পত্রিকা দিয়ে খুব রিচ করতে চাই।
মহিউদ্দিন সাহেব খেতে খেতে মুখ তুলে বললেন, এটা ভালো একটা উদ্যোগ।
সমর্থনের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ বাবা। আমাদের ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাহেব একজন মুক্তিযোদ্ধা। উনি ব্যাংকের সিএসআর ফান্ড থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। নতুন একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কে কোথায় কিভাবে আছেন সারা দেশ থেকে খুঁজে তার একটা তালিকা করে বই আকারে প্রকাশ করবেন। আমার মতো একজন ছ্টো অফিসারকেও উনি কমিটিতে রেখেছেন। খোঁজ-খবরের জন্য কিছুদিনের মধ্যে আমরা বাইরে বের হবো।
নিশ্চয়ই কয়েকজনে মিলে গ্রুপ করে যাবে?
হ্যাঁ।
তাহলে অসুবিধা নাই।
কেয়ারটেকারের নাম খলিলুর রহমান। রুদ্র ডাকে খলিল মিয়া বলে। বয়সের ভারে কাজকর্ম তেমন গুছিয়ে করতে পারে না। তবে সারাদিনই লেগে থাকে, চেষ্টা করে। রুদ্র কিছু বলে না। কেনো জানি বৃদ্ধটার ওপর তার মায়া পড়ে গেছে। একটা মানুষ বেঁচে থাকার জন্য এতোটা কাকুতি করতে পারে! নিজের বলতে তার কেউ নেই পৃথিবীতে। বউটা ছিলো, কিছুদিন হলো সেও নাকি মারা গেছে হাঁপানি রোগে। নিজের কেউ না থাকলে এ বয়সে কে কাকে দেখে। নিরুপায় হয়ে চলে আসে ঢাকা শহরে। শহরটা এমন- দেশের সবগুলো মানুষকে যেনো আপন করে বুকের ভেতরে টেনে নেয়ার জন্য মুখিয়ে আছে সে। কোনো রকমে ভেতরে ঢুকে যেতে পারলেই হলো, বেঁচে থাকার সাহস আপনা থেকেই শরীরে এসে ভর করে।
ক’দিন বাদেই আসে ছাব্বিশ মার্চ, স্বাধীনতা দিবস। অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে ভোরে ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে সাভার যায় রুদ্র। স্মৃতিসৗধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় স্বাধীনতার অকুতোভয় বীর সেনানীদের। স্মৃতিসৌধের চূড়ার দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে আসে তার। এতো ত্যাগ, এতো তিতিক্ষা- সব আমাদেরই জন্যে!
দুপুরের বাসায় ফিরে এসে খলিল মিয়াকে নিয়ে বাড়ির ছাদে উঠে রুদ্র। ফুল দিতে তো কতবারই সাভার গিয়েছে, কিন্তু আজকের দিনটা কেন যেন একটু অন্যরকম লাগছে রুদ্রর কাছে। শত সহস্র মানুষের ভিড়। গাদাগাদি ঠাসাঠাসি বেদি চত্বর। ফুলের তোড়া রাখতে গিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত সবাই। নেতা গোছের কেউ কেউ আবার ব্যস্ত বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ইন্টারভিউ দেয়া নিয়ে। সেলফি তুলতেও কম ব্যস্ত নয় অনেকে। কিন্তু রুদ্রকে টানছিলো স্মৃতিসৌধের স্তম্ভগুলো। দূরে দাঁড়িয়ে থেকে বারংবার শুধু তাদেরই কথা মনে হচ্ছিলো, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজ দৃপ্তপদে দাঁড়িয়ে আছি এই ভূখন্ডে। আচ্ছা, ওরা কেমন ধারার মানুষ ছিলো? নিজেদের জীবন বিপন্ন করে স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে-বাবা-মা এদের মমতার টান পেছনে ফেলে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। লক্ষ্য ছিলো একটিই- ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইলের এই দেশ আমাদের, এখানে আমরাই থাকবো বুক চিতিয়ে। লড়বো; লড়তে লড়তে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো, তবুও মাথা নোয়াবো না।
বিশাল ছাদ। চারদিকটা গাছপালায় ঠাসা। আশেপাশের বাড়িঘর কিংবা দূরে রাস্তার মোড় থেকে বিল্ডিংটার দিকে তাকালে ছাদের উপর গাছপালার সবুজ ঝোপঝাড়গুলোকে মনে হয় ছোটোখাটো একটা বন। এককোণে পানির ট্যাংক ঘেঁষে লোহার এঙ্গেল আর টিনের ছানি দিয়ে বানানো হয়েছে কবুতরের থাকার জন্য একটা ঘর। নানান রঙের দেশি-বিদেশি ৪০/৫০টি কবুতর সারাক্ষণই ছোটাছুটি দাপাদাপি করছে ঘরটায়। কবুতর পালা রুদ্রর সখ। ছেলের সখ পুরণের জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও কবুতরের ঘর বানিয়ে দিয়েছেন মহিউদ্দিন সাহেব।
খলিল মিয়া, কবুতরগুলোর যত্ন নিবেন খুব ভালো করে।
একটা কবুতর হাতের তালুতে নিয়ে আদর করতে করতে বলে রুদ্র। পেছন থেকে খলিল মিয়া বলল, জ্বী স্যার।
খলিল মিয়ার এই স্যার বলাটা পছন্দ নয় রুদ্রর। প্রথমদিনই তাকে বলে দিয়েছে আঙ্কেল ডাকতে। কিন্তু মনিব-পুত্র বলে কথা, এসব ক্ষেত্রে খলিল মিয়াদের থিতু হতে খানিকটা সময় লাগে। রুদ্র মুখের দিকে তাকাতেই সঙ্গে সঙ্গে থতমত খেয়ে বলে উঠে, জ্বী আঙ্কেল।
গুড, ভেরি গুড।
জ্বী আঙ্কেল।
রুদ্র বলল, খলিল মিয়া, আজ আমার কেন যেন মনে হচ্ছে কবুতরগুলোকে আটকে রেখে আমি কাজটা ঠিক করছি না। প্রতিটি প্রাণীই, সে মানুষ কিংবা হোক অন্য কিছু- চায় নিজের করে ইচ্ছেমতো থাকতে, তাই না?
খলিল মিয়া মাথা নাড়ে, আপনে ঠিক কতাই কইছেন আঙ্কেল।
বেশ, তাহলে আপনি একটা কাজ করেন, দরজাটা খুলে দিয়ে কবুতরগুলোকে ছেড়ে দেন। ওরা ওদের খুশিমতো চলে যাক।
খলিল মিয়া দরজা খুলে দিলে ডানায় পত পত শব্দ তুলে একে একে সবক’টা কবুতর মনের আনন্দে বেরিয়ে পড়ে খোলা আকাশে। রুদ্র তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ না দৃষ্টির অগোচর হচ্ছে কবুতরগুলো।
আজ আপনে বিরাট একটা ভালা কাম করলেন আঙ্কেল!
রুদ্র মধ্যদুপুরের সূর্যস্নাত আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাথার পেছনে দু’হাত রেখে। ‘বিরাট একটা ভালা কাম’- বাতাসে ছেড়ে দেয়া খলিল মিয়ার কথাটা বারংবার কানে এসে লাগছে তার।
রুদ্র হঠাৎই জিজ্ঞেস করে, খলিল মিয়া আমিতো মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, আপনার বয়স তখন কত ছিলো?
খলিল মিয়া খানিকটা দম নিয়ে হাতের আঙুলের কড় গুণে হিসেব করে বলল, এই বিশ-পঁচিশ বছর হইব।
রুদ্র পুলকিত হয়ে ওঠে, তাহলে আপনি নিশ্চয়ই যুদ্ধে গিয়েছিলেন? আপনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা!
রুদ্রর কথায় খলিল মিয়া মনে হয় খানিকটা ধাক্কা খায়, আমি মুক্তিযোদ্ধা কিনা কইতে পারি না, তবে দেশের জন্য যুদ্ধ করছি। মিলিটারিগো গুলি খাইয়া একবারতো মইরাই গেছিলাম, আল্লার ইচ্ছায় অহনো বাঁইচা রইছি।
খলিল মিয়া, আপনি একটু সোজা হয়ে দাঁড়ান।
বলেই রুদ্র দু’হাত দিয়ে খলিল মিয়াকে ধরে সোজা করে দাঁড় করায়। তারপর খলিল মিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই রুদ্র ডান হাত উঁচিয়ে স্যালুট দেয় তাকে।
অতর্কিত এমন একটা ঘটনায় খলিল মিয়ার চোখ-মুখ লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে, এইটা আপনে কী করলেন আঙ্কেল!
না, কিছুই করিনি খলিল মিয়া। এটা আপনার প্রাপ্য। আপনি এই দেশের একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান। আপনারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন বলেইনা আমরা আজ রুদ্র হয়ে উঠেছি। কিন্তু খলিল মিয়া আমি বুঝতে পারছি না, আপনার এ অবস্থা কেনো? একজন মুক্তিযোদ্ধার অবস্থাতো এমন হওয়ার কথা না! সরকার যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে এখন। আপনি মাসে মাসে ভাতা পান না? জানেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা এখন যে পরিমান ভাতা পায় ছোটোখাটো চাকরি করেও একজনে তা পায় না।
খলিল মিয়া ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, শীর্ণ গলা দিয়ে তার স্বর বেরোয় না। তবে বোকার মতো প্রশ্ন করে আবার নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে যায় রুদ্র। ভাতা কিংবা সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলে কি আর অন্যের বাড়িতে কেয়ারটেকারের কাজ করতে আসে সে? নিজেকে ভৎসর্ণা করে রুদ্র। পরে আলাপচারিতায় বোঝা গেছে সমস্যা অন্যখানে। খলিল মিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা ঠিকই, কিন্তু তার কোনো কাগজপত্র নেই। সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেতে হলে প্রমাণপত্র লাগে। ছিটেফোঁটা কোনকিছুই নেই খলিল মিয়ার কাছে। আছে শুধু স্মৃতি, তাও আবার ঝাপসা হয়ে গেছে অনেকটাই। মনে করতে পারে না অনেককিছুই। তবে ২৫ মার্চ রাতে পাকিবাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সংবাদ শুনে নিজের ভেতরে প্রতিশোধের স্পৃহা জেগে ওঠার উত্তেজনার কথা ভুলতে পারেনা খলিল মিয়া। ভীত সন্ত্রস্ত মানুষজন উপায়ান্তর না দেখে শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। দেখতে দেখতে দুই-তিন দিনের মধ্যে বলতে গেলে শহরের প্রায় সব লোকই যেন গ্রামে চলে আসে। যারা কোনদিন গ্রামে থাকেনি, তবে শেকড় এখানেই ছিলো- প্রাণভয়ে অপরিচিত তেমন অনেক মুখও চলে আসে। আরো অপরিচিত অনেকেই আসে যাদের গ্রামের বাড়ি অন্য জেলায় অনেক দূরে, হেঁটে যাওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়- এ গ্রামেরই এমন অনেকের ঘনিষ্ট বন্ধু-বান্ধব কিংবা শহরের প্রতিবেশী হবে।
সহসাই গ্রামে একটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। খবর আসে সারাদেশের সাধারণ মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। গ্রামের নেতৃস্থানীয় লোকজনও তরুণদের নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। তখন খলিল মিয়াও নেমে পড়ে সবার সাথে। সামনে কী অপেক্ষা করছে দেখার সময় কারোরই নেই। ঠিক যেন উইপোকার দল, যন্ত্রনায় ছটফট করছে- সামনে আগুনের লেলিহান শিখা, মৃত্যু অনিবার্য, তবুও ভ্রুক্ষেপ নেই।
অল্পদিনের মধ্যেই একটি দলের সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যায় খলিল মিয়া। সামরিক প্রশিক্ষণ নেয় মেলাঘর ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণ শেষে দেশের মাটিতে ফিরে এসে অমিত সাহস নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা শুরু করে। গণবাহিনীর একটা ইউনিট কমান্ডারের দায়িত্ব নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ করে পাকিবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে তুলে। শরীরের রক্ত তখন গরম, টগবগ করতো শুধু শত্রু-সৈন্য নিধনের জন্য। তারপর দেশ স্বাধীন হয়, অস্ত্র জমা দিয়ে খলিল মিয়া গ্রামে ফিরে আসে শূন্য হাতে। এসে দেখে মা নেই, বাবা নেই। বাড়িঘর বিধ্বস্ত, চারিদিকে শুধুই অন্ধকার!
খলিল মিয়া বলল, আঙ্কেল, আমগোর কাম আছিল দেশের লাইগ্যা যুদ্ধ করনের। যুদ্ধ করছি, দেশ স্বাধীন করছি। একটা ব্রিজ উড়াইতে গিয়া মেলিটারিগো গুলি খাইয়া মইরাই গেছিলাম। বাঁচনের আশা এক ফোঁডাও করি নাই। কাগজপত্র দিয়া কি করমু কন? যুদ্ধ যে করছি, এইটা তো আর মিছা না!
তারপরও যে কাগজপত্রের প্রয়োজন আছে তা খলিল মিয়াকে বুঝিয়ে লাভ নেই। কারণ খলিল মিয়াদের কাছে যুদ্ধটাই বড়ো, দেশটা স্বাধীন হয়েছে এটাই বড়ো, এর জন্যে যে কিছু একটা পেতে হবে তার আশা কোনদিনই তাদের ভেতরে জন্মেনি।
রুদ্র জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা খলিল মিয়া, আপনাদের এলাকায় এমন কেউ আছে যারা যুদ্ধ করে নাই অথচ সব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে?
আছে!
আপনারা কিছু বলেন না তাদের?
কি যে কন আঙ্কেল, আমগোর কি কুনু দাম আছে তাগোর কাছে?
সেদিনের পর থেকে খলিল মিয়ার ঘুম আর খুব একটা বেশি হয় না। সে এ বাড়ির একজন কেয়ারটেকার মাত্র। বাড়ি পাহাড়া দেবে, গাড়ি আসলে গেট খুলে দেবে, কিছু ফাইফরমায়েশ শুনবে- এইতো! বিনিময়ে পাচ্ছে থাকা-খাওয়ার একটা নিরাপদ আশ্রয়। সে একজন মুক্তিযোদ্ধা এটা জানার পর থেকে রুদ্রর বাবা মহিউদ্দিন সাহেব তার প্রতি অনেকটাই আলাদা করে কেয়ার নেন মনে হচ্ছে। শরীর কেমন, খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে কিনা ঠিকমতো- এসব জিজ্ঞেস করেন প্রায়শই। এগুলো খলিল মিয়ার মনে দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে। এ দুনিয়ায় নিজের একেবারে আপন বলতে কেউ নেই, কপালগুণে বাড়িটায় কাজ পেয়েছে। এখন যদি কোনো কারণে এখানে থাকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয় তাহলে কী হবে! ভাবতে গিয়ে কোনই কুলকিনারা খুঁজে পায় না খলিল মিয়া।
কিছুদিনের জন্য অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছিল রুদ্র। একেবারেই অফিসের রুটিন ডিউটির বাইরের একটা কাজ। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা কে, কোথায় এবং কিভাবে আছেন তাঁদের তথ্য সংগ্রহ করা। তথ্য সংগ্রহ করে পুস্তকাকারে সংরক্ষণ করা। বিশাল কাজ। সময়ও লাগবে অনেক। তবে শুরু করে দিয়েছে ওরা। সরকারি গেজেট অনুযায়ী দেশে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৬৭৬ জন। এদের একটা বড় অংশ গ্রামীণ জনপদে বাস করে। বেশিরভাগই অস্বচ্ছল। তাদের উত্তরাধিকারীগণের প্রায় সবই নিরক্ষর। কাজ করতে গিয়ে রুদ্্রর কাছে মনে হচ্ছে, রাষ্ট্রকাঠামোর অযত্ন অবহেলায় তাঁদের মন ভোঁতা হয়ে গেছে। তাঁরা ভুলে গেছে নিজেদের অমিত তেজের কথা। দেশের মাটিতে ফিরে এসে তাঁরা হয়েছে নিজ দেশে পরবাসি। দুর্বৃত্ত রাজাকারের দল সপরিবারে মেরে ফেলেছে দেশের স্থপতিকে। তাদের গাড়িতে ওড়েছে জাতীয় পতাকা। শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলে-ফেঁপে উঠে তাদের শরীর। পায়ের নিচে ঠিক যেন পিঁপড়ে মারার মতো গুণে গুণে পিষে ফেলছিল দেশের জন্য যারা অস্ত্র ধরেছিলো তাদেরকে- এ হেন অবস্থায় নিজেদের অস্বচ্ছল থাকা আর উত্তরাধিকারীগণের নিরক্ষর থাকাটা খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কী করার ছিলো খলিল মিয়াদের। তখনতো কারোরই মাথায় এসব ঢোকেনি। চিন্তা ছিলো একটিই- শত্রু নিধন করো, দেশ স্বাধীন করো। একটিবারের জন্যও ভাবনায় আসেনি স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যের বাড়িতে গতর খাটিয়ে সংসার চালাতে হতে পারে, না খেয়েও দিনাতিপাত করা লাগতে পারে, মৃত্যুর পর তাদের সন্তানদের রেলস্টেশন কিংবা বাজারে কুলির কাজ করে জীবন বাঁচাতে হতে পারে!
মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, খেতাবপ্রাপ্ত এত মুক্তিযোদ্ধার সবাইকে নক্্ করাতো তোমাদের জন্য একটা ভীষণ চ্যালেঞ্জ। সেই তেয়াত্তর সালের গেজেট, কত বৎসর আগের কথা! গেজেটের নাম-ঠিকানায় এখন কি সবাইকে খুঁজে পাবে? তাছাড়া অনেকেতো এখন বেঁচেও নেই।
রুদ্র বলল, তুমি ঠিকই বলেছ বাবা। তবুও চেষ্টা করে তাঁদের বর্তমান অবস্থাটা দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরে যায় কিনা, চেয়ারম্যান সাহেবের ইচ্ছেও সেটাই।
এতে কি কোনো বেনিফিট আছে?
আছে বাবা, বেনিফিট আছে। চেয়ারম্যান সাহেব বলেছেন মুক্তিযোদ্ধারা বাঙালি জাতির গর্বিত ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের মূল চরিত্র, তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁরা হারিয়ে গেলে জাতির ইতিহাস হারিয়ে যাবে। যত অবজ্ঞাই করা হোক না কেন, একদিন তাঁদের প্রয়োজন হবেই।
মহিউদ্দিন সাহেব লক্ষ করেন কথা বলতে বলতে রুদ্রর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। তার কাছে ভালো লাগে এরা, এ প্রজন্মের ছেলেপেলে কতোটা সচেতন। পাশাপাশি তারা এবং যুদ্ধ-অব্যবহিত পরের প্রজন্ম যেন ঠিক ততটাই নষ্ট। কতটা পরিমান নষ্ট হলে মানুষ সরকারি সুবিধা ভোগের জন্য যুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে পারে! আর জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করা খলিল মিয়াদের সার্টিফিকেট দূরের কথা মুক্তিযোদ্ধার তকমাটিও কপালে জোটে না।
কাজ করতে গিয়ে রুদ্ররা দেখতে পায় শুধু একা খলিল মিয়াই নয়, খেতাবপ্রাপ্ত অনেক মুক্তিযোদ্ধার নামও তালিকায় নেই। আবার তালিকায় নাম আছে, কিন্তু ঠিকানায় গিয়ে হদিস মিলছে না। মাত্র সেদিনের ঘটনা! অথচ ঘটনার মহানায়কদের কেন যেন সবাই ভুলে গেছে। স্মৃতির ভান্ডারে তাঁদের রাখার মত জায়গার যেন বড়ই অভাব। মা তাঁর সন্তান হারিয়ে বোবা হয়েছেন, মায়ের আরেক সন্তান তার ভাই হারানোর স্মৃতিও ভুলে গেছেন।
টেবিলে বসে কাগজপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিল রুদ্র। দু’হাতে মাথার পেছনদিকের চুল টেনে ধরে চেয়ার ছেড়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে সে। পুরো মাথাটায় যেন চিনচিন করে ব্যথা করছে। কাজের কোনো কুল-কিনারা পাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত যতটুকু অনুসন্ধান হয়েছে তার ফলাফল খুবই করুণ। জীবন বাজি রেখে যাঁরা মাঠে-ময়দানে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, নিঃশঙ্কচিত্তে কামানের গোলার নিশানার মধ্যে ছুটে গেছেন, হাসিমুখে আত্মাহুতি দিয়েছেন, সে সব শহীদদের উত্তরাধিকারীরা আজ নিজ দেশে অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবন-যাপন করছে!
আঙ্কেল…।
খলিল মিয়ার গলা শুনে বিছানা থেকে উঠে চেয়ারে গিয়ে বসে রুদ্র।
আঙ্কেল, শইলডা খারাপ লাগতাছে? মাথার চুলগুলান কি একটু টাইন্যা দিমু?
খলিল মিয়া সামনে এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখতে চায়। রুদ্র বাধা দিয়ে বলল, না, লাগবে না। তারপর একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আপনি যে যুদ্ধ করেছেন তার কি কোনোই রেকর্ড আপনার কাছে নাই? এই যেমন লাল মুক্তিবার্তায় নাম থাকতে পারে, আপনি যুদ্ধের সময় ভারতের মেলাঘর ক্যাম্পে যে ট্রেনিং নিয়েছেন সেখানের তালিকায় নাম থাকতে পারে। একটা কিছু পেলে আপনার নামে মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য একটু চেষ্টা করতে পারতাম।
খলিল মিয়া তার ঘোলাটে চোখে ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকে রুদ্রর দিকে। বিষয়টা এমন যেন লাল মুক্তিবার্তা কিংবা ভারতীয় তালিকার নাম জীবনেও শোনেনি সে।
রুদ্র বলল, ঠিক আছে দরকার নাই। আমরা ঘোরাঘুরি করে বুঝতে পারছি আপনার মতো এমন হাজারো লোকের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাই। চিন্তা করবেন না, আপনার নামটা তালিকায় ঢোকানোর জন্য আমি চেষ্টা করে দেখব। যুদ্ধ যখন করেছেন কোথাও না কোথাও নামটা অবশ্যই লেখা আছে।
খলিল মিয়া হাতজোড় করে বলল, আঙ্কেল, এক পাও কবরে গিয়া রইছে, এইসবের আর দরকার নাই আমার। যুদ্ধের পর ফিরা আইসা দেখি পোলায় যুদ্ধে গেছে বইল্যা আমার বাপ-মারে মিলিটারিরা ধইরা ক্যাম্পে লইয়া গিয়া মাইরা ফালাইছে। বিয়া করলাম, ছেলেপুলে হইলো না। ট্যাকার অভাবে চিকিৎসা করাইতে না পাইরা বউডা মইরা গেল আমারে একলা রাইখ্যা। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক দিছে, সময়মতো যহন পাই নাই অহন আর আমার ঐগুলানের দরকার নাই আঙ্কেল!
এসব কি বলছে খলিল মিয়া! মেজাজ খারাপ হয় রুদ্রর। অবাক হয়ে ভাবে, তাঁরা কি চিরদিনই অন্যের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকবে? কেউ বলুক আর না বলুক, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কতো তাঁরাই।
রুদ্র বলল, এটা কোন সুস্থ্য মানুষের কথা হলো না খলিল মিয়া। আপনি কি চিরদিন অন্যের দয়ার ওপর বেঁচে থাকবেন? শোনেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অনুদান দিয়ে সরকার কোনোই করুণা করছে না। এটা আপনাদেরই প্রাপ্য হিস্যা।
কিন্তু এ হিস্যা কি আদায়ের ক্ষমতা রাখে খলিল মিয়ারা? রুদ্র অতর্কিতে ভারি ভারি পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় নামে। পেছনে খলিল মিয়া দাঁড়িয়ে থাকে বোকার মতো। কি যেন এক অজানা কারণে আজ রুদ্রর মনমেজাজ খারাপ হয়ে আছে, বুঝতে পারে না সে।