কুমিল্লার দৌলতপুরের নজরুল অধ্যায়

কামাল আতাতুর্ক মিসেল

‘গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিস্টান’- আজ বুধবার ২৫ মে, ১১ জ্যেষ্ঠ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩ তম জন্মবার্ষিকী। দ্রোহ, প্রেম ও সাম্যের কবি হিসেবেও বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রতিভা নজরুল ইসলামকে অভিহিত করা হয়। ১৮৯৯ সাল, ১৩০৬ বঙ্গাব্দের এইদিনে বর্ধমান জেলার (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে) আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে কাজী পরিবারে নব জাগরণের এ কবির জন্ম।

নজরুলের প্রেম, বিয়ে বিচ্ছেদ, গ্রেফতার, সমাবেশ এবং কাব্য ও সংস্কৃতিচর্চাসহ বহু ঘটনার নিরব সাক্ষী কুমিল্লা শহর। সেই হিসাবে এবার কুমিল্লায় কবির জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান করা এবং প্রতিপাদ্য ‘বিদ্রোহীর শতবর্ষ’ বিশেষ তাৎপর্যময়।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লার দৌলতপুরে এসেছিলেন ৬ এপ্রিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ, ২৩ চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দে। এই গ্রামে কবির জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কিছু সময় কেটেছিল। কবি নজরুল ৭৩ দিন ছিলেন দৌলতপুরে। সেই সময়ে তিনি ১৬০টা গান ও ১২০টা কবিতা লিখেছিলেন। ‘পাঁপড়ি-খোলা’ নামের বিখ্যাত কবিতাটাও লিখেছিলেন এখানে বসে। এছাড়াও ‘অবেলায়’, ‘অনাদৃতা’, ‘বিদায়-বেলায়’, ‘হারমানা-হার’, ‘হারামণি’, ‘বেদনা অভিমান’, ‘বিধুরা পথিক প্রিয়া’ কবিতাগুলো লিখেছিলেন। এখানকার নারীর মমত্ববোধ ও ভালবাসা তার বিদ্রোহী মানসপটে প্রেমিক কবির বিমূর্ত ছবি এঁকে দিয়েছিল।

কুমিল্লায় ও দৌলতপুরে না এলে নজরুলের কবিজীবন ও প্রেমিকজীবন হয়তো পরিপূর্ণ হতো না। দৌলতপুর আসার কারণে নজরুলের জীবনে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছিল, তাঁর সাহিত্য চর্চায় যোগ হয়েছিল নতুন মাত্রা। এখানে এসেই বিদ্রোহী কবি হয়ে গিয়েছিলেন প্রেমের কবি। নার্গিস নামে এই গ্রামের এক তরুণী তার জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছিল। নার্গিসের সঙ্গে কবি নজরুলের প্রথম দেখা হয়েছিল খান বাড়ির এক বিয়ে অনুষ্ঠানে। নার্গিসকে প্রথম দেখার পরই বিদ্রোহী কবির মাঝে প্রেমিক কবির আবির্ভাব ঘটেছিল। তাই তো তিনি লিখেছেন ‘এক অচেনা পল্লী- বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি, যা কোন নারীর কাছে হয়নি…।’

কবির এই পল্লী-বালিকার নাম সৈয়দা খাতুন। কিন্তু কবি তাকে এই নামে ডাকতেন না। ইরানী ফুল নার্গিস নামে ডাকতেন। এই নার্গিস ফুলই পরবর্তীতে কবির হদয়-বাগান সুরভিত করেছিল।

কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর রোডের পাশে দৌলতপুর গ্রাম। গ্রামের নাম দৌলতপুর হলেও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের আগমনের কারণে যোগ হয়েছে কবিতীর্থ। তাই কবিতীর্থ দৌলতপুর নামে আশপাশের গ্রামের লোকেরা চেনে। কবিতীর্থে প্রবেশের শুরুতেই আছে দুটো তোরণ, পথের দুধারে নির্মিত এই তোরণদ্বয়ের নাম রাখা হয়েছে, কবি নজরুল তোরণ। তোরণ দুটোর সামনে বিখ্যাত কিছু কবিতার চরণ খোদাই করে লিখে রাখা আছে।
‘নার্গিস! নার্গিস!
কেন ফুটলে আমার
ফুল-বাগিচায়
আনলে মদির সূরভি
কেন গাইলে গজল শিরীন-সুর
কাঁদলো সাঁঝের পূরবি।’

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কাজী নজরুল ইসলাম পাকিস্তানের করাচিতে থাকতেন, সেটা ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের কথা। যুদ্ধের সময় আলী আকবর খান ছিলেন ক্যাপটেন আর কবি নজরুল ছিলেন হাবিলদার। সেই সূত্রে তাদের পরিচয় হয়েছিল। শুধু পরিচয় হয়েই থেমে থাকেনি। দুজনের মাঝে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। কবি নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে আলী আকবর খান তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল নিজের গ্রামের বাড়ি দৌলতপুরে আসতে। আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে সাড়া দিলেও কবি নজরুল সরাসরি দৌলতপুরে আসেননি। প্রথমে এসেছিলেন কুমিল্লা শহরে। কান্দিরপাড়ে এসে তার বন্ধু বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে উঠেছিলেন। এখানে আসার পথে চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনে বসে তিনি ‘নীলপরী’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন।

কান্দিরপাড়ে দুই দিন থাকার পর ৬ এপ্রিল আলী আকবর খানের সঙ্গে এসেছিলেন দৌলতপুরে। এখানে আসার পর আলী আকবর খানের ভাগ্নি সৈয়দা খাতুন বা নার্গিস আরা খানমের সঙ্গে কবি নজরুলের পরিচয় হয়েছিল। নার্গিসের বাড়ির ছিল আলী আকবর খানের পাশের বাড়িতেই। বাল্যকালে নার্গিসের বাবা-মা মারা গিয়েছিল। তাই সে বেশির ভাগ সময় মামার বাড়িতে থাকত।

তোরণ পেরিয়ে গ্রামের ভেতরে যে পাকা রাস্তাটা গেছে সেটা দিয়ে একটু সামনে আছে একটা মাঠ, নজরুল মাঠ। প্রতি বছর ১১ই জ্যৈষ্ঠ এই মাঠেই মেলা হয়। মাঠের এক পাশে পাকা করে বানানো আছে নজরুল মঞ্চ। মঞ্চের দক্ষিণ দিকে আছে আলী আকবর খানের সেই বাড়িটা যেখানে নজরুল-নার্গিসের বিয়ে ও বাসর রাত উদযাপিত হয়েছিল। সেটা ছিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন মোতাবেক ১৩২৮ সনের ৩ আষাঢ়, শুক্রবার। কিন্তু কী এক অজনা কারণে বিয়ের পর সেই রাতেই নজরুল দৌলতপুর ছেড়ে কুমিল্লার কান্দিরপাড় চলে গিয়েছিলেন। কেন তিনি ওভাবে চলে গিয়েছিলেন আজও জানা যায়নি। তবে কুমিল্লা থেকে নার্গিসের মামা আলী আকবর খানকে ‘বাবা শ্বশুর’ সম্বোধন করে তিনি যে চিঠি লিখেছিলেন তাতে কিছুটা অনুমান করা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘বাবা শ্বশুর! আপনাদের এই অসুর জামাই পশুর মতন ব্যবহার করে এসে যা কিছু কসুুর করেছে, তা ক্ষমা করো সকলে…। …আমি সাধ করে পথের ভিখারী সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মতন ‘ক্ষুদ্র-আত্মা’ অমানুষ হয়ে যাইনি। আপনজনের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এত হীন ঘৃণা, অবহেলা আমার বুক ভেঙে দিয়েছে…।’

নজরুল চলে যাওয়ার পর নার্গিস সুদীর্ঘ ষোলো বছর তার অপেক্ষায় ছিলেন। তারপর তিনি আজিজুল হাকিম নামের একজন অখ্যাত কবিকে বিয়ে করেছিলেন। আজিজুল হাকিম ও সৈয়দা খাতুনের (নার্গিস) সংসারে দুই ছেলে হয়েছিল। ছেলে দুজন বিদেশে থাকে এখন। নার্গিসের বর্তমান বাড়িতে এসে তারই ভাইয়ের ছেলে আব্দুর রউফ মুন্সির কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

দৌলতপুরে নার্গিসের বসত বাড়িটা এখন আর নেই। তবে আলী আকবর খানের সেই বাড়িটা আছে। রাজ প্রাসাদের মতো কারুকার্যময় দ্বিতল ভবন। বাড়িটার সামনে আছে পুরনো আমলের একটা পুকুর। এই পুকুরেই নজরুল ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটতেন। একবার পুকুরে নামলে উঠার নামও নিতেন না। সাবানের পর সাবান মেখে ফেনা তোলে পুকুরের ফেনিল জলে ছোট শিশুদের সঙ্গে লাই খেলতেন। আলী আকবর খানের এক বোন ছিল, নাম ইফতেখারুন্নেছা। নজরুল তাকে মা ডাকতেন। পুকুরের পশ্চিমপাড়ে একটা আমগাছ ছিল। সেটা এখন নেই। ইফতেখারুন্নেছা এই আমগাছের তলায় খাবার নিয়ে এসে নজরুলকে ডাকতেন ‘আয় নুরু, খেতে আয়!’ তখন নজরুল ভদ্র ছেলের মতো গোসল সেরে বাড়িতে এসে ভাত খেতেন। এই আম গাছের নিচে বসেই নজরুল রাত দুপুরে মনভোলানো উদাস সুরে বাঁশি বাজাতেন। দুপুরে শীতল পার্টিতে বসে কবিতা ও গান রচনা করতেন।

আমগাছের পাশেই ছিল কামরাঙা, কামিনী, কাঁঠাল গাছের সারি। এখানে তিনি খান বাড়ি ও দৌলতপুর গ্রামের ছেলে-মেয়েদের নাচ, গান, বাদ্য শেখাতেন। যদিও গাছগুলো এখন আর নেই। কয়েক বছর আগে মারা গেছে। তবে আম গাছের গোড়া এখনও পাকা করে রাখা হয়েছে। আম গাছটা ছাড়াও তখন খান বাড়িতে বারোটা কামরাঙা গাছ ছিল। কবির শোবার ঘরের সামনে ছিল একটি কামরাঙা গাছ, যা তার অনেক কবিতা গানে, হাসি-কান্না, মান অভিমান এবং মিলন-বিরহের নীরব সাক্ষী। এই গাছকে নিয়েই তিনি লিখেছেন-

‘কামরাঙা রঙ্গ লোকের পীড়ন থাকে
ঐ সুখের স্মরণ চিবুক তোমার বুকের
তোমার মান জামরুলের রস ফেটে পড়ে
হায় কে দেবে দাম…।’

কাজী নজরুল মাঝেমধ্যে দুপুরবেলায় এই গাছের শীতল ছায়ায় বসে আপন মনে গান গাইতেন, গান রচনা করতেন। সেই গাছটা এখনও আছে। নজরুল স্মৃতি ধরে রাখতে গাছটাতে ফলক বানানো হয়েছে। নজরুল যখন বিকেল বেলায় এই গাছের ছায়ায় শীতলপাটি বিছিয়ে বসে কবিতা ও গান লিখতেন তখন নানা কাজের ছলে এখানে ছুটে আসতেন নার্গিস। আর তখনই নজরুল-নার্র্গিসের মন দেয়া নেয়া ঘটনা ঘটে গিয়েছিল।

দৌলতপুরে রাতে বাজাতেন বাঁশি আর দিনের বেলা পুকুরের শান্ত জলে নেমে খেলতেন জলকেলি। গ্রামের বউ-ঝিয়েরা কলসি ভরতে পুকুরে এলে তিনি তাদের সঙ্গে ছেলেমানুষি করতেন। এজন্য নজরুল ঘুম থেকে ওঠার আগেই কলসি ভরে নিত গ্রামের মেয়েরা।

আলী আকবর খান ১৯৭৭ সালে পরলোক গমন করেন। দৌলতপুরে নিজেদের পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়েছে। নার্গিস মারা গিয়েছেন ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে। ইংল্যান্ডে অবস্থান করার কারণে তাকে মেঞ্চেস্টার শহরে সমাহিত করা হয়েছে।

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, আজ (বুধবার) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তিন দিনের অনুষ্ঠানমালার পর্দা উঠলো । কুমিল্লার বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন প্রাঙ্গণে (টাউন হল) আজ বেলা ১১টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ এমপি’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সিমিন হোসেন (রিমি) এমপি, কুমিল্লা-৬ আসনের এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহার ও কবি পৌত্রী খিলখিল কাজী। স্বাগত বক্তব্য রাখছেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর। স্মারক বক্তা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও নজরুল গবেষক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক।

Print Friendly

Related Posts