শাহ মতিন টিপু
রাত্রিভ’র ডাহুকের ডাক…./এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির!/দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি। /ছলনার পাশা খেলা আজ প’ড়ে থাক,/ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি,/কান পেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক। (ডাহুক)
আবার- যেখানে প্রশস্ত পথ ঘুরে গেল মোড়,/কালো পিচ-ঢালা রঙে লাগে নাই ধূলির আঁচড়,/সেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে প’ড়ে আছে জমিনের ‘পর;/সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখে না সে মৃতের খবর। (লাশ)
আবার- কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হল জানি না তা। /নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা। /দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা। /তবু জাগলে না ? তবু, তুমি জাগলে না ? (সাত সাগরের মাঝি)
আবার- রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?/এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?/ সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?/ তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;/অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি। /রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি? (পাঞ্জেরি)
উল্লেখিত সবগুলো পংক্তিই ফররুখ আহমদের কবিতার। তার রচিত অনেক কবিতা এখনো জনপ্রিয়। তাকে বলা হয় রেনেসাঁর কবি। এই কবির ১০৪ তম জন্মবার্ষিকী আজ। তার জন্ম ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে। তার বাবা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। ফররুখ আহমদের মায়ের নাম রওশন আখতার। তিনি ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।
কেবল রেনেসাঁর কবিই নন- ফররুখ ছিলেন মানবতার কবি, ছোট-বড় সবারই কবি। শিশুদের জন্য তিনি লিখেছেন অনেক মজার মজার ছড়া কবিতা, গান, গল্প ও নাটক-নাটিকা। ‘পাখির বাসা’, ‘হরফের ছড়া’, ‘ছড়ার আসর’, ‘নয়া জামাত’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘কাফেলা’, ‘আলোকলতা’, ‘খুশীর ছড়া’, ‘ছড়াছবির দেশে’, ‘পাখির ছড়া’, ‘রঙমশাল’ ইত্যাদি তার লেখা উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ।
তার ছড়াগুলোও চমৎকার। যেমন-
বিষটি এলো কাশবনে/জাগলো সাড়া ঘাস বনে/বকের সারি কোথারে/লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে। /নদীতে নাই খেয়া যে,/ ডাকলো দূরে দেয়া যে,/কোন্ সে বনের আড়ালে/ফুটলো আবার কেয়া যে!
আবার- ঝুমকো জবা বনের দুল/উঠল ফুটে বনের ফুল। /সবুজ পাতা ঘোমটা খোলে,/ঝুমকো জবা হাওয়ায় দোলে। /সেই দুলুনির তালে তালে,/মন উড়ে যায় ডালে ডালে।
আবার- ডালে ডালে পাখির বাসা/মিষ্টি মধুর পাখির ভাষা/সাত সাগরে নদীর বাসা/কুলুকুলু নদীর ভাষা। /হাজার সুরের হাজার ভাষায়/এ দুনিয়া ঘেরা/আর মাতৃভাষা বাংলা আমার/সকল ভাষার সেরা।
তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘সাত সাগরের মাঝি’, ‘সিরাজাম মুনীরা’, ‘নৌফেল ও হাতেম’, ‘মুহূর্তের কবিতা’, ‘ধোলাই কাব্য’, ‘হাতেম তায়ী’, ‘নতুন লেখা’, ‘হাবিদা মরুর কাহিনী’, ‘সিন্দাবাদ’, ‘দিলরুবা’ ইত্যাদি।
ফররুখ আহমদের ‘হাতেম তা’য়ী’ কাব্যটি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত এক অমূল্য সম্পদ। ‘হাতেম তা’য়ী’ কাব্যটিকে বাংলার অনেক কবি সাহিত্যিক ‘মহাকাব্য’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ কাব্য বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
কবি সাহিত্যে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৬০ সালে ফররুখ আহমদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৫ সনে প্রেসিডেন্ট পদক ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ এবং ১৯৬৬ সালে পান আদমজী পুরস্কার ও ইউনেস্কো পুরস্কার। ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালে তাকে যথাক্রমে মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়।
ফররুখ আহমদের কর্মজীবন শুরু হয় কোলকাতায়। ১৯৪৩ সালে আই.জি.প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদী’-র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে চাকরি করেন ঢাকা বেতারে। প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।