মনের আয়নায় ll আহ্সান ওয়াহিদ এর গল্প

খবরটা কি সঠিক, না উড়ো!
দক্ষিণ পাড়ার সামসুর ব্যারাইম্যা ভাই বেহা হন্তদন্ত হয়ে তোতলাতে তোতলাতে খবরটা বাজারে প্রচার করেছে। নদীর ঘাটে দুপুরে গোসল করতে গিয়েছিল সে। দেখে দুই লঞ্চ বোঝাই করে মিলিটারি এসে ঘাটে নেমেছে। তবে খবরটা উড়ো না হলেই ভালো। এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের উৎপাতে বাড়িঘরে বসবাস করা দায় হয়ে পড়েছে। যখন তখন বাড়িতে এসে হামলা করছে, মেরে ফেলার হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। মিলিটারি এসে গেছে, এখন যদি বাছারা একটু শিক্ষা পায়! কিন্তু তার আগে মিলিটারির আসার খবরটা নিশ্চিত হতে হবে। ওই ব্যারাইম্যা বেহাও একটা মানুষ, আর তেলাপোকাও একটা পাখি! সেদিন বিকেলে ভরা মজলিশে কি একটা তত্ত্ব এনে হাজির করল। অবাক কান্ড! পাকিস্তানের জেলে নাকি শেখ সাবেরে মিলিটারিরা মারছে, আর সেইমারের দাগ নীল হয়ে কচু পাতায় ফুটে উঠেছে। বাড়ির নামার কচুখেত থেকে কেটে হাতে করে বিশ-পঁচিশটা কচুপাতাও এনেছিল দেখাতে। কি আশ্চর্য! পাতাগুলোয় সত্যি-সত্যিই লম্বা লম্বা নীল দাগজ্বল জ্বল করছে।

এমনটি কিন্তু এর আগে কখনোইকারো চোখে পড়েনি।অথবা দেখে থাকলেও বেহার মতো এমন করে কেউ ভাবেনি।

জন্ম থেকেই বেহা একটা অসুস্থ মানুষ। বয়স বিশ-বাইশ হলেও দেখতে মনে হয় পনের-ষোল বছরের বালক। জণ্ডিসের জন্যে সারা শরীর হলুদ হয়ে আছে। মুখ থেকে প্রায় বেরিয়ে পড়া গোদা গোদা দাঁতগুলো পর্যন্ত হলুদ। মনে হয় শরীরে রক্তের লেশমাত্রও নেই। বাপ-মা মারা যাওয়ার পর তাকে তেমন করে দেখাশুনারও কেউ নেই। ভাইদের সংসারে একবেলা খেতে পায় তো আরেকবেলা না খেয়ে থাকে। ফজল মাতবর বুঝে পায় না, বেহার মতো এমন একটা মানুষ- যে কিনা এই বাঁচে তো এই মরে, তার মনের ভেতর শেখ সাবেরে নিয়ে এত চিন্তা কোত্থেকে আসে? সে কি তারে দেখেছে কোনদিন, না এই তল্লাটের কেউ দেখেছে? ঢাকার রেসকোর্স ময়দান না কোথায় যেনএকদিন কি একটাভাষণ দিলো, আর অমনি হেমিলনের বাঁশিঅলার মতো তাঁর পেছনে সবাই ছুটলো!

বেহা না হয় হাবাগোবা, বেবুঝ; দেশের আর সব মানুষও কি ওরই মতন? আবার দেখো কি কাণ্ড, বাড়ির বৌ-বেটিরা নাকি আজকাল শেখ সাবের জন্য রোজা রাখা শুরু করেছে। শুধু কি রোজা, প্রতি অক্তে অক্তে নফল নামাজও পড়া শুরু করেছে!কি সব বেদাতি কাজ; সহ্য করার মতো না, কিন্তু করতে হচ্ছে।

মানুষ এতোটা বেকুব কি করে যে হতে পারে ফজল মাতবর ভেবে পায় না। আরে শকুনের দোয়ায় কি গরু মরে? এই সত্য কথাটা মানুষকে বোঝানো বড় মুশকিল। পই পই করে হাজারবার সতর্ক করার পরও গেলো নির্বাচনে গ্রামের নির্বোধ লোকজন নৌকার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। এখন আবার কোন হিসেব-নিকেশ না করেই উঠতি বয়সের পোলাপানসহ জোয়ান মর্দ্দগুলো বাপ-মা-ভাই-বোন আর বউদের অরক্ষিত রেখে যুদ্ধে নেমে গেলো!দেশদ্রোহীর অপরাধে এখন যদি তাদের উপর অত্যাচার অনাচার এসে নাজিল হয়, তবে এর দায় কে নেবে? মানুষ না বুঝলে তার করার কি আছে? মাথা ভন্ ভন্ করে ঘুরতে থাকে ফজল মাতবরের।

বিশ্বস্ত একজনকে দিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল বেহা মিথ্যে বলেনি। নদীর পাড়ে থানার চাতালে খাঁকি পোষাক পরা গাদা গাদামিলিটারি অস্ত্রকাঁধে ঘোরাঘুরি করছে। ফজল মাতবর এবার নিশ্চিন্ত হয়। আর ভয় নাই।মনের ভেতরের পুরোনো একটা গোপন বাসনা চেগে উঠে তার। গ্রামটা একটা হিন্দুর কারখানা! এর আগে সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় মালাউন অনেকগুলো পালিয়ে ছিলো, পঁয়ষট্টিতে নাকততে যেন ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় কিছু গেছে। শালার এবার যাবে বাকিগুলো। তখন দুই দফায় নামে-বেনামে অনেক সম্পত্তির দখলসূত্রে মালিক হয়েছিল ওরা। মিলিটারি এসে গেছে,সুতরাং এবার আর কোন চিন্তানাই।ডরে-ভয়ে এমনিতেই যাবে। পাকিস্তান একটা মুসলমানের দেশ, শুধু মুসলমানেরাই থাকবে এখানে।

ফজল মাতবর বাজারে তার বিশাল চালের আড়তের এক কোণে সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে বসে প্রমাদ গোনে। লোক পাঠিয়ে বেহাকে ডেকে এনে কাছেই মাটিতে বসায়। সামান্য কলা-রুটি খেতে দিয়ে বলে, শোন্ বেহা, তোরে এখানে কেন ডাকছি জানস?

বেহা খেতে খেতে চোখ তুলে ফজল মাতবরের দিকে তাকায়। মাথা নেড়ে বলে, না, জানিনা।

শোন্, অসুইখ্যা বলে তোরে সবাই আদর করে। সব জায়গায় তুই যাছ। মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামে আসলেই তুই খবরটা আমারে আগে দিবি, কি দিবি তো?

বেহা আনমনে মাথা নেড়ে কলা-রুটি খাওয়ায় মনোযোগ দেয়, দিমু।

আর শোন্, ঐসব কইস্ না। ঐ যে, কচু পাতাত্ শেখ সাবেরে মারনের দাগ। ঐগুলি হইল ভুয়া কতা, বুঝ্ছস্?তোরা তো বুঝতে পারতেছস্না, শেখ সাব গাদ্দারি কইরা দেশটারে বিনাশ কইরা ফালাইতে চাইতাছে।

বেহা বুঝলো কি না বুঝলো সেদিকে আর মন নেই ফজল মাদবরের। ভেতর থেকে একটা গগনবিদারী কাঠফাটা হাসি বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো আড়তে। তারপর হুট করে আবার থেমে পড়ে সমবেতদের উদ্দেশ্যে বলে, একটা কথা আছে না, উলুর পুট্কিত্ খৈল হইলে আগুনে পুইড়া মরে;আমগো হইছে অহনহেই দশা। ঢাল নাই, তলোয়ার নাই, নিধিরাম সর্দার।এইবার ঠেলা সামলাও, মিলিটারি আইসা পড়ছে। দাও, লাঠি, খুন্তি, বল্লম লাইয়া যে তোমরা যুদ্ধে নামছো, পারবা তাগোর লগে?মিটিং-এ শেখ সাব কি কইল না কইল, দ্যাশের মানুষগুলানরে মাঠে নামাইয়া দিয়া নিজে মিলিটারিগো হাতে ধরা দিয়া জেলে গিয়া আরামে বইসা রইছে! খাইয়া-পইরা আর নামাজ-কালাম কইরা আমরা কি আরামে-শান্তিতেই না আছিলাম, আর অহন অশান্তির জোয়ারে ভাসন লাগতাছে। মিলিটারিরা কি ভালো মাল? অগোর কি কোন বুক-পিঠ আছে? সামনে যা পড়বো, সব মিস্মার কইরা যাইবো। কি মিয়ারা, কথা কও না ক্যান। ঠিক না বেঠিক কইলাম?

ঠিক কথা, ঠিক কথা। সমবেতদের কাছ থেকে অনুকূল সমর্থন পেলে ফজল মাতবরের কথার জোস্ দ্বিগুণ বাড়ে, হোনো, আমাগো কোন ডর নাই। আমরা মুসলমান। সাচ্চা মুসলমানেরা মিলিটারিগো ভাই। ডর অহন মতিবাবুগো। তোমরা শেখ সাবের পক্ষ নিছো, নৌকাত ভোট দিছো। কিন্তু ক্ষমতাত যাইতে পারছো? মিলিটারি আইসা গেছে, সোনার চাঁনেরাঅহন বুঝবা কত ধানে কত চাইল!

ফজল মাতবর একজন বকলম মানুষ। তবে কুটবুদ্ধিতে ওস্তাদ।মুসলিম লীগের রাজনীতি করে। গত নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এলাকার মেম্বার ছিল। নিজে লেখাপড়া তেমন না জানলেও দলীয়নেতাদের সঙ্গে হাঁটা-চলা করে শেখ মুজিব সম্পর্কে মনের ভেতর যা বিশ্বাস ধারণ করেছে তা-ই সুযোগমতো উগড়ে দিচ্ছে নিজের লোকেদের কাছে।নেতারা বলেছে হিন্দুর বাচ্চা শেখ মুজিবর একটা জালেম!হিন্দু রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে আঁতাত করে ছয় দফা দিয়ে সে সোনার দেশ পাকিস্তান ভাঙ্গতে চায়। দেশ আর দেশের মানুষকে অস্থির করে তুলেছে। একটা গন্ডগোল বাঁধিয়ে দিয়ে মানুষের এখন না খেয়ে থাকার উপক্রম হয়েছে।বাপের ব্যাটা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান খুব শক্ত মানুষ। তিনি বলেছেন, শেখ মুজিবকে অবশ্যই এর জন্য শাস্তি পেতে হবে। এখন কোথায় আছে কে জানে! দ্যাখো, আর ফিরে আসতে পারে কিনা।

তবে বোঝা যায়, সবার অলক্ষ্যে মানুষের মনের গহিনে কেমন করে যেন সে ঢুকে পড়েছে। আর এটিরই প্রভাব ফজল মাতবর দেখতে পাচ্ছে বেহার মতো একটা হাবাগোবা মানুষের মধ্যেও। এখান থেকে যে করে হোক মানুষকে বের করে আনতে হবে। কথায় না পারলে আঙ্গুল বাঁকা করে হলেও।

এলাকায় মিত্র হিসেবে মিলিটারিদের তালিকায় ফজল মাতবরের নাম আছে। ফজল মাতবরকে তারা খুঁজে বের করে। তাকে নিয়ে চষে বেড়ায় সারা এলাকা। বেছে বেছে হিন্দু বাড়িগুলোকে আগে টার্গেট করে। প্রথম ধাপেই আগুনে পোড়ায় বাজার সংলগ্ন মতিবাবুর পোদ্দার বাড়ি। মতিলাল পোদ্দারের তিন পুরুষের বসতবাটিতে লোহা কাঠের বিশাল বিশাল চৌয়ারি ঘরে দিনভর শশ্মানের মতো আগুন জ্বলে।মিলিটারিরা পরিবারের সবাইকে দুই হাত পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যায় নদীর পাড়ে থানার চাতালে। তারপর সার বেঁধে গুলি করে মেরে লাশগুলোকে ফেলে দেয় নদীতে। পরিবারসহ স্রোতের টানে নদী গহ্বরে হারিয়ে যায় বাজারের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী মতিলাল পোদ্দার।

তারপর প্রতিদিনই রাত পোহালে শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। একে একে নিশ্চিহ্ন হতে থাকে কামার পাড়া, কুমোর পাড়া, জেলে পাড়ার সব বাড়িঘর আর মানুষজন।এমন কায়দায় আক্রমণ করে, পালানোরও সুযোগ পায় না অনেকে। এরপর শুরু হয় ফজল মাতবরের লোকজনের লুটপাট। গ্রামের যেসব ঘরের জোয়ান ছেলেরা যুদ্ধে গেছে তাদের পরিবারেরও নিস্তার নেই। মুসলমান হলেও কোন কথা নেই, দেশের বিরুদ্ধে ছেলেপেলেরা যুদ্ধে গেল কেনো? মিলিটারিরা তাদের ঘরদুয়ারও পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। বুড়ো বাপ-মাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারে, ছোট কিশোরি বোনকে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে নানান অত্যাচার করে।

তিন-চার দিনের মধ্যে এলাকায় একটা ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি হয়। যারা মিলিটারিদের অত্যাচার থেকে বেঁচে আছে তারা ডানা-ভাঙ্গা পাখির মতো নিরবে দাপাতে থাকে। কোনপ্রকার প্রতিরোধে না পড়ায় প্রবল উৎসাহে মিলিটারিরা এখন এলাকার বাইরে থানা থেকে দূর দূরান্তের গ্রাম-গঞ্জে গিয়ে অপারেশন চালাচ্ছে। এই সেদিনেরও কোলাহলমুখর বাজার এখন নিরব নিস্তব্ধ, প্রায় মৃত। তবুও জীবন জীবিকার তাগিদে হাটুরে লোকজনঅতিশয় সন্তর্পণে বাজারে আসে এবং কোনরকমে বেচাকেনা সেরে দ্রুত বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। ফজল মাতবরদের কোন ভয় নেই, এলাকায় তারা বীরদর্পে চলাফেরা করে।

কইছিলাম না, মিলিটারি আইসা গেছে! এখন কই তোমরা, হ্যাডম থাকলে সামনে আসতে পার না?

আড়তে বসে সমবেত কয়েকজনের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বাতাসে কথাগুলো উগড়ে দিয়ে পরক্ষণেই আবার কি মনে করে বলে উঠে, এই তোমরা বেহারে দেখছ নিহি? অরে ত আমি কয়দিন দইরা দেখতাছি না। হারামজাদাটা গেল কই? নাকি মিলিটারিগো চোদন খাইয়া মইরা গেছে বেহা হালায়!

বেহাকে নিয়ে ফজল মাতবরের খিস্তি খেউরে সমবেতদের একজন আরেকজনের দিকে ইতিউতি করে তাকায়।কিন্তু ফজল মাতবরের কথা যেন ফুরায় না। হা হা করে খলবলিয়ে হাসতে হাসতে থাকে সে। বলে,হালায় কয়, শেখ সাবের মাইরের দাগ নাকি এক হাজার মাইল বাতাসে উইড়া আইসা কচুপাতার মইদ্যে ফুইট্টা উঠছে! যে চোদন দিতাছে মিলিটারিরা, শেখ সাবের লাইগ্যা বৌ-বেটিগো অক্তে অক্তে নফল নামাজ আর রোজা রাখনও পাছা দিয়া বারাইবো অহন।

এর ঠিক একদিন পর। রাত দশটা কি সাড়ে দশটা হবে তখন। চারদিকে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার নিরবিচ্ছিন্ন ডাক। পুরো গ্রাম ঘুমঘোরে আচ্ছন্ন।বেহা চোরের মতো পা টিপে টিপে ফজল মাতবরের ঘরের দরজায় গিয়ে ঠক্ ঠক্ করে আঘাত করে। হতে পারে আজই তার জীবনের শেষ রাত। হোক, তাতে তার কোন আফসোস নেই। তার এই জীবনের কিই-বা দাম আছে। মফিদুল কমান্ডার বারংবার সতর্ক করে। কিন্তু সব জেনেও পিছপা হয় না বেহা। জন্মিলে মরিতে হইবেই, সুতরাং ভয় করে কি লাভ? কোমরে লুঙ্গির কোঁচড়েলুকানো গ্রেনেডটা আলতো করে ছুঁয়ে দেখে।মিলিটারিদের আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে সে। থানার চারদিকে অস্ত্র নিয়ে সতর্ক অবস্থানে আছে মুক্তিযোদ্ধা মফিদুলরা। সুযোগমতো থানা আক্রমণ করতে মরিয়া হয়ে আছে তারা। বেহা বুদ্ধি করে ফজল মাতবরকে থানা চত্বরে নিয়ে যেতে পারলে হয়। ওর সামনেই মিলিটারিদের ওপর গ্রেনেড ছুঁড়ে মারবেবেহা। সঙ্গে সঙ্গে ওৎ পেতে থাকা মফিদুলরা চারদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে নাস্তানাবুদ করে দেবে মিলিটারিদের, পরিকল্পনা এমনই।

দরজায় ঠক্ ঠক্ আওয়াজটি ভালো ঠেকছে না ফজল মাতবরের। ওরা আবার নয়তো! সচকিত হয়ে ধর্ফর্ করে বিছানা ছেড়ে আলমারির পাশে রাখা দু’নালা বন্দুকটা হাতে নিয়ে সন্তর্পণে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। ভয়ার্ত স্বরে আস্তে আস্তে দরজার ওপাশের মানুষটির পরিচয় জানতে চায়, কে?
আমি, দুয়ার খুলেন, খবর আছে।

বেহার তোতলানো গলা শুনে আশ্বস্ত হয় ফজল মাতবর। তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে বেহাকে দেখেই বলল, এত রাইতে তুই! এতদিন কই আছিলি হারামজাদা?

বেহা মুখে কোনো রা করে না।ডান হাতের তর্জনিতে ঠোঁট চেপে দু’চোখে বারকয়েক পলক ফেলে ফজল মাতবরকে প্রায় ঠেলেগুদ গুদ করে ঘরে ঢুকে পড়ে সে।বেহার চালচলনে এতক্ষণে ফজল মাতবর নিশ্চিন্ত হয়। দরজা চাপিয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে জানতে চায়, কি খবর আনছত্, ক? অরা কি গ্রামে ঢুকছে? আস্তানা কই গাড়ছে?

ফজল মাতবরের এতসব প্রশ্নের পিঠে বেহা নিচু তোতলানো স্বরে যা বলল তার মর্মার্থ হলো, মফিদুল কমান্ডাররা দক্ষিণ পাড়ায় তাদের বাড়ির কাছেই আস্তানা গেড়ে থানা হামলার পরিকল্পনা করছে। এ ক’দিন বেহা ওদের কাছেই ছিলো।ফজল মাতবরের আর তর সয় না। ক্যাপ্টেন সাহেবকে সংবাদটা দেয়া জরুরি। দেরি না করে বেহাকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়ে সে। থানা কাছেই, হেঁটে যেতে বড় জোর বিশ কি পঁচিশ মিনিট লাগবে।

যদিও সামনে কি অপেক্ষা করছে জানা নেই বেহার, তবুও আজ তার হাত দিয়ে জীবনের সেরা একটি কাজহতে যাচ্ছে ভেবে পুলকিত হয় সে। থানা চত্বরের কাছাকাছি এসে বেহাকে পেছনের ফেলে ফজল মাতবর একটু সামনে এগিয়ে যায়, ক্যাপ্টেন সাহেবকে সংবাদটা দিতে হবে দ্রুত। কিন্তু সেই সুযোগ আর পায় না ফজল মাতবর। তার আগেই বেহার কোঁচড়ের গ্রেনেড বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে শুরু হয় মফিদুল কমান্ডারদের সাঁড়াশি আক্রমণ।অতর্কিত হামলায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে মিলিটারিরা। ঘটনার বিহ্বলতায় হতভম্ব ওরা। রাতভর থেমে থেমে চলে গোলাগুলি। ক্রস ফয়ারিং-এর কবলে পড়ে বেহা। ভোরে থানার দখল নেয় মফিদুলরা।অনেক খোঁজাখুঁজি করে দেখে চাতালের একপাশে নদীর প্রায় ধারে পড়ে আছে বেহার গুলিবিদ্ধ লাশ। কি সুন্দর নির্ভয় হলুদ-চোখে তাকিয়ে আছে বেহা। যেন বলছে- জন্মিলে মরিতে হইবেই, সুতরাং মরণে ভয় কিসের!#

Print Friendly

Related Posts