আশির দশকের শক্তিমান কবি ফজলুল হক আর নেই। মঙ্গলবার (২৬ জুলাই) বিকালে সিলেট নগরীর নিজ বাসায় তিনি ইন্তেকাল করেন। তার বয়স হয়েছিল ৬১ বছর। মৃত্যুকালে তিনি ২ ছেলে, ১ মেয়ে ও স্ত্রী রেখে গেছেন।
ফজলুল হক সম্প্রতি মস্তিস্কে রক্তক্ষরণজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়েছিলেন। ফুসফুসেও সংক্রমণ ধরা পড়েছিল। ঢাকা ও সিলেটের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়ে বাসায় চিকিৎসাধীন ছিলেন।
ফজলুল হক সিলেটের গ্রামে বসবাস করেও একজন শক্তিমান কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সন্তানদের পড়ালেখার সুবিধার জন্য তিনি গত কয়েক বছর থেকে সিলেট নগরীতে বসবাস করেন।
ফজলুল হকের জন্ম ১৯৬১ সালের ১ সেপ্টেম্বর, সিলেটের বিয়ানীবাজার। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ তিনটি-‘পৃথক দংশন’, ‘কবির জন্মদিন’ ও ‘শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে নির্বাসনের দিনে’। সম্পাদনা গ্রন্থ ‘তপোধীর ভট্টাচার্য: জীবন ও কর্ম’। তিনি ছিলেন গীতিকার। সিলেট বেতারের জন্য গান লিখেছেন। সিলেটের দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেছেন। বিগত তিন দশকে বিয়ানীবাজারের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বুধবার (২৭ জুলাই) দুপুরে গ্রামের বাড়ির পারিবারিক গোরস্তানে তাকে দাফন করা হবে। কবি ফজলুল হকের মৃত্যুতে সিলেট-৬ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
কবি ফজলুল হককে নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করেছেন সিলেটের নিউ ইয়র্ক প্রবাসী কবি ফকির ইলিয়াস:
ফকির ইলিয়াস তার ফেসবুক পেজে লিখেন- ১৯৯২ সাল। আমি নিউইয়র্ক থেকে দেশে গিয়েছি। বিয়ানীবাজারে আমার খুব ঘনিষ্ট বন্ধু আব্দুর রউফ খান মিষ্টুর বাড়ী। বেড়াতে গিয়েছি।সেখানেই রাত ভরে তুমুল আড্ডা।কবি ফজলুল হক জমিয়ে তুলেছেন জোসনার স্তর, কথায় কথায়। সাথে আব্দুল মালিক ফারুক, শাহজাহান কমর- আরও কয়েকজন। কথায় কথা বাড়ায়।আড্ডার মূল বিষয় সাহিত্য।একসময় ভোর হয়ে ওঠে! ফজরের আজানের ধ্বনি আমাদের জানান দেয় ভোরের দ্যুতির কথা।কবি ফজলুল হকের কথা শেষ হতে চায় না!
তারপরেও তিনি আমাকে বলেন- ‘কবি ঘুমুতে যান! কবিদের ঘুমুতে হয়।না ঘুমুলে নতুন কবিতা রচনা হয় না! ‘ আমি তার কথা মান্য করে বালিশে মাথা লাগাই।তিনিও মাথা এলিয়ে দেন, আমাদের পাশেই- বিশাল সোফাবেডে।জাগতে দেরী হয়। বিশাল আইটেমের নাস্তার টেবিলে আবারও সাহিত্য, সমাজ।
তারপর দুপুরের খাবার। অন্তত বিশ পদের তালিকা দিয়ে আহার সেরে আমাদের বাজারে( বিয়ানী বাজার) যাত্রা।
আজই খবর এলো, কবি ফজলুল হক আর নেই। বয়সে তিনি আমার দু বছরের বড় ছিলেন।কিন্তু এই বয়সে চলে যাওয়া! আপাদমস্তক এক কবির নাম
ফজলুল হক। কবিতার শিরা উপশিরায় ছিল যার বিচরণ।ছিলেন নিভৃতচারী। কম লিখতেন।কিন্তু যা লিখতেন, তা হতো শিহরণ জাগানিয়া।
গত কয়েক সপ্তাহ আগেই জানা হয়ে যায়, তিনি গুরুতর অসুস্থ! তিনি চাননি এটা কেউ জানুক।তারপরেও খবর রটে যায়! তিনি চাননি, মুখাপেক্ষী হয়ে তার চিকিৎসা চলুক।ফলে, নিজেদের মতো করেই সর্বশেষ চেষ্টা করেছেন! তিনি লিখেছিলেন—
°°°°
দুঃখ এই যে, এতে দুঃখ নেই তোমার মনে
……………………………………..
দীপান্তরের শেষ দিন।
এই ডাঙা ছেড়ে যেতে যেতে অগ্নিদগ্ধ কবি
যেন ক্লান্ত প্রফেট !
শেষ প্রহরে। সমবেত দ্বীপবাসী ও শিশুদের বললেন,
কবিতা একটি ব্যক্তিগত শিল্প মাধ্যম। যা একান্ত নিজস্ব, তাই তো পবিত্র।
প্রকৃত কবি বেঁচে থাকেন চেতনায়।
কবি ছুঁয়ে থাকে শুধু ছায়া।
নদীর সঙ্গে কথা বলেন।
বাতাসের কাঁধে হাত রেখে চলে যান পাহাড়ি ঝর্ণার কাছে।
লালন সাঁইয়ের মেলায় গিয়ে রাত জেগে শোনেন বাউল গান।
কবি হেঁটে যান জলজ নির্জনতায়।
তখন এক ধরনের উদ্ভাসিত যন্ত্রণা কবিকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
মাঝে মাঝে বর্ণময় ঝড় আসে।
এ ঝড়কে কবির মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোন রহস্যময়ীর চিঠি।
কেন এ রকম মনে হয় তোমার ?
শ্রীলেখা এসে কাঁধে হাত রাখে কবির।
তার চোখ তখন জলে ভরে যায়।
দূরে,আরও দূরে যত্নে গড়ে তোলেন বন্দি শিবির।
এ শিবিরে আসে নর্তকী, আর্তনাদ আর ছাপচিত্র।
কবির শরীর জুড়ে নামে অচেনা সংগীতের আবহ।
দূর থেকে, বহুদূর থেকে শোনা যাচ্ছে অশ্বারোহিণীর ছুটে আসা।
ঘোড়া থেকে নামে নারী।
তার শরীর জুড়ে ছায়াময়, মায়াধোয়া অভ্রনীল পোশাক।
সে হাত বাড়িয়ে একটি চিঠি, কবির দিকে এগিয়ে দেয়।
কবির বুকে ঘুমিয়ে থাকা কবিতার সাদা পাতাগুলি
উড়তে উড়তে তখন পৌছে যায় :
‘সিংহল সমুদ্র থেকে, আরো দূর বিদর্ভ নগরে’ !
তখন তটভূমি এবং অপসৃয়মান জাহাজের মাস্তুল দুটোই অস্পষ্ট।
সকলেই প্রতীক্ষারত।
শিশুরা গুমরে কেঁদে ওঠে মায়েদের ঝাঁপটে ধরলে
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবি,
“দু:খ এই যে, এতে দুঃখ নেই তোমার মনে” !
°°°°°°°°°°°
এমন দুঃসংবাদ, আমাদের কাঁপিয়ে দিয়েছে।এভাবেই চলে গেলেন তিনি!এভাবেই গেলেন, পঞ্চখণ্ডের এই কাব্যপুত্র! আমি তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।