শহীদ কাদরী : স্বকীয়তার নিজস্বতায় সমুজ্জ্বল

এবিএম সালেহ উদ্দীন

 

পৃথিবীর প্রাণিকুলের মধ্যে মানুষ ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমের শীর্ষজুড়ে রয়েছে মানুষের সৃষ্টিশীলতা। সৃজন, মনন ও কর্মের বৈশিষ্ট্যেই মানুষ সৃষ্টির সেরা। মানুষ গড়তে পারে, ভাঙতে পারে এবং মানুষই ইতিহাসের স্রষ্টা। সৃজন, স্বভাবগত মননশীলতা ও কর্মের মধ্যদিয়ে মানুষ অমর হয়ে থাকেন। কৃষ্টি-সভ্যতার নিরিখে মানবীয় গুণাবলীর ভিত্তিতে সমাজ ও জাতির উন্নতির পেছনেও মানুষই সক্রিয় ও শক্তিমান। মানুষ সবচেয়ে বেশি মনন ক্ষমতা ও গুরুমস্তিকের অধিকারী। জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধি-বিবেচনবোধ আর মেধা ও মননের ফলেই উদ্ভাবনার অমিত শক্তিতে মানুষের সমতুল্য কেউ নেই। তবে অমর থাকার পেছনে সব মানুষের অমর হয়ে থাকার কারণও ভিন্নতর আঙিকে।

এমন একজন কৃতিমান মানুষের কথা উল্লেখ করছি যিনি তাঁর কবিতা ও ঈর্ষণীয় কাব্যবোধের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বাংলা সাহিত্যের এই ক্ষণজন্মা কবির নাম শহীদ কাদরী।

ইতোপূর্বে ‘কবি শহীদ শহীদ কাদরী- স্মৃতির আড়ালে আরো কত স্মৃতি’ নামে আমার একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বেশ স্মৃতি আছে তাঁর সাথে। একেবারে কম নয়। আশির দশকের মাঝামাঝি তিনি রাশিয়ান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। উদয়ন পত্রিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বের হতো সেখান থেকে। তিনি আর বেলাল চৌধুরী সে সময় সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। আমি তখন সবেমাত্র কবি কলেজে ভর্তি হয়েছি। একবার ধানমন্ডিস্থ রাশিয়ান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে সোভিয়েত বিপ্লবের উপর ভিত্তি করে একটি ফিল্ম দেখানো হয়েছিল। দেখতে গিয়ে সেখানেই প্রথম কবি শহীদ কাদরীর দর্শন লাভ করি। অতঃপর আমেরিকার বোস্টন এবং পরবর্তীতে তার নিউইয়র্কের প্রান্তিক জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁর স্পর্শ লাভে ধন্য হয়েছি।

শহীদ কাদরীর মানস ও বর্ণময় জীবনের কিছু টুকরো দিকের আলেখ্য ছাড়া তাঁর কবিতা নিয়ে আলোকপাত করার যোগ্যতা আমার নেই। তবে তিনি আপাদমস্তক একজন কবিতার মানুষ ছিলেন তা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি। তাঁর কবিতার সর্ববিস্তারী মর্ম ক্রমে ক্রমে উপলব্ধি করা যায়, যখন তাঁর সৃষ্ট কবিতার পংক্তিমালার গভীরে ডুব দেয়া যায়। কবিতা প্রসঙ্গে ‘লর্ড আলফ্রেডের একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে-“সব ভালো কবিতাই আছন্ন করে আমাদের। আস্তে আস্তে মধুর পারম্পরের সঙ্গে, রক্ত ও রোদনের সঙ্গে।”

কবিতার একটা চিরন্তন আহবান আছে। সব কবিতা নয়। তবে কোন কোন কবির কবিতা অমর হয়ে থাকে অনাদিকাল। পৃথিবীতে সে রকম অনেক কবির কবিতা আছে; যা চিরকালের জন্য অমর হয়ে থাকে। অনাদিকাল পর্যন্ত মানুষের মাঝে গেঁথে থাকতে পারে সে রকম চিরায়ত ও উচ্চমার্গের বেশকিছু মহৎ কবিতা শহীদ কাদরীর সৃষ্টিতে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আর এ প্রসঙ্গে আরও উদ্ধৃতি দেয়া যায়। যেমন টি এস এলিয়ট বলেছেন: “মহৎ কবিতা জীবনদৃষ্টি ও বোধের কল্প সত্যকে উপস্থাপন করে”। এই ক্ষেত্রে ‘গেটে’ তো আরও স্পষ্ট করে বলেছেন- “কবিতা মানুষের চিরায়ত সম্পদ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সবখানে, সব সময়ে, সব মানুষের হৃদয়ে তাকে স্থাপন করা যায়।” এ হচ্ছে সৃষ্টিশীল কবিতার আসল তত্ত্ব যেখানে কবিতা সর্বযুগে সব প্রজন্মের জন্য নিবেদিত থাকে।

প্রথম কবিতার বই ‘উত্তরাধিকার’

এই কাব্যগ্রন্থর বড় গুণ, এতে যান্ত্রিকতা নেই, দুর্বোধ্যতা ও আড়ষ্ঠতা নেই । তাজা-টাটকা ভাষা, কোথাও কোথাও টান টান প্রায় গদ্যগন্ধি হয়েও মাদকতাময়, সেই সঙ্গে লক্ষ্যভেদী চিত্রকল্প। সেই কবে, প্রথম যৌবনে মাথায় গেঁথে বসা পংক্তিসমূহ সুক্ষ্নতার স্থিতিতে প্রতিষ্ঠিত, যা থেকে কিঞ্চিৎও সরে যায়নি। না যাওয়ার একমাত্র কারণ—সেসবের ভিন্ন, একেবারে আলাদা স্বর।

তাঁর সমসাময়িক বা পূর্বসূরির কাছে কোন প্রতিধ্বনি ও স্বরের দ্যোৎনায় কোন পদ্ধতিতে তিনি তাঁর পংক্তিমালাকে উজাড় করে দেনঃ “এই সাঁঝে, প্রলয় হাওয়ার এই সাঁঝে/(হাওয়া যেন ইসরাফিলের ওঁ)/বৃষ্টি পড়ে মোটরের বনেটে টেরচা,/ভেতরে নিস্তব্ধ যাত্রী, মাথা নিচু/ত্রাস আর উৎকণ্ঠায় হঠাৎ চমকে/দ্যাখে,—জল,/অবিরল/জল জল জল/তীব্র, হিংস্র/খল…” (বৃষ্টি, বৃষ্টি)

অবাক লাগে কত অল্প বয়সে শহীদ কাদরী কবিতার কাছে নিজের তৈরি কাব্যভাষায় নিজেকে সঁপে দিয়েছেন ! সেই সঙ্গে আরও অবাক হতে হয়, কত কম লিখেছেন! উত্তরাধিকার বেরিয়েছিল ১৯৬৭ সালে। সবসুদ্ধ মাত্র চল্লিশটি কবিতা। কী অপূর্ব বীজরাশি দিয়ে উত্তরাধিকার’-এ তারই তীব্র ব্যঞ্জনাময় আর্তিতে ফোটানো রক্তগোলাপে ফুটে উঠেছে:

“জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন/থেকে নেমে—/সোনালি পিচ্ছিল পেট আমাকে/উগ্রে দিল যেন/দীপহীন ল্যাম্পপোস্টের নিচে…কিংবা/…পৃথিবীতে নিঃশব্দে ঘনায় কালবেলা/আর আমি শুধু আঁধার-নিঃসঙ্গ ফ্ল্যাটে/রক্তাক্ত জবার মতো
বিপদসংকেত জ্বেলে এক জোড়া/মূল্যহীন চোখে/পড়ে আছি মাঝরাতে কম্পমান/কম্পাসের মতো/অনিদ্রায়”। (উত্তরাধিকার)

আলস্যের সকল জড়তা বিদূরিত করে গগন বিদীর্ণ করে শহীদ কাদরী গুটি কতেক কবিতার অলংকারের মধ্যদিয়ে স্থিরায়িত পন্থায় সবাইকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছেন ।

তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা কবিতাটিতে (১৯৭৪) এক মোহময় উন্মাদনার প্রতিশ্রুতিতে নিবিষ্টচিত্তে ঘোষণা করেন:
‘ভয় নেই/আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী/গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে/মার্চপাস্ট করে চলে যাবে/এবং স্যালুট করবে/কেবল তোমাকে প্রিয়তমা। /ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো/বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে/কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে/আর্মার্ড-কারগুলো এসে দাঁড়াবে/ভায়োলিন বোঝাই করে/কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।’ (তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা)

উল্লেখ্য, অতি অল্পসংখ্যক কবিতা সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা কবিতার ভূবনে বিস্ময়করভাবে শহীদ কাদরী স্থায়ী স্থান দখল করে নিয়েছেন। সাহিত্যকর্মের মধ্যে কবিতাই তাঁকে অমর করে রাখবে। অসাধারণ মেধা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন আমাদের কবি শহীদ কাদরী। কাব্যচর্চায় সম্পূর্ণ স্বাধীনচেতনার এক সম্মোহনী শক্তির অভিধারায় তিনি বাংলা কাব্যজগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।

চৌদ্দ বছর বয়সে কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত একটি সংকলনে তার লেখা প্রথম কবিতা ছাপা হয়। দেশ ভাগের পর আধুনিক বাংলা কবিতায় যে সব কবিদের রচনায় নবযুগের সূচনা ঘটে শহীদ কাদরী তাদের মধ্যে অন্যতম। মাত্র ১৪ বছর বয়সী কিশোর কবির লেখা। প্রশ্ন জাগতে পারে, একজন তরুণ কবির আত্মা কেন এত নিঃসঙ্গ আর একা। কবির এই নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্ব শেষতক চিরকালীন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমৃত্যু। তাঁর কবিতায় তা ফুটে উঠেছে শৈল্পিক হাহাকারের মর্যাদায়। এই কবিতাটি ছাপা হয় কবিতা পত্রিকায় (১৯৫৬)। সেটাই ছিল নাকি কবির টার্নিং পয়েন্ট।

শহীদ কাদরীর কবিসত্তার উন্মীলন ঘটেছে বুদ্ধদেব বসু’র কবিতা পত্রিকার মাধ্যমে । নিজের ভাষায় তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন– ‘কবিতা পত্রিকায় যদি লেখা ছাপা না হতো, তাহলে হয়তো আমি কবিতায় লেগেই থাকতাম না। বুদ্ধদেবের রুচির ওপর আমাদের আস্থা ছিল। তিনি যদি মনে করেন কবিতা, তাহলে ওটা কবিতা হয়েছে। উনি মনে না করলে হয়নি ।’

কবি শহীদ কাদরীকে বাংলা সাহিত্য ও আধুনিক কবিতার শীর্ষপুরুষ বলা হয়ে থাকে। তাঁকে নগরের কবিও আখ্যা দেয়া যায়। প্রেম, ভালোবাসা, রহস্য ও রোমান্টিকতার বাইরেও ইস্পাত কঠিন শহরের যান্ত্রিক জীবনের বিকারগ্রস্ততা ও হৃদয়হীনতার অনেক বৈষম্যের বিকট চেহারা কবিকে কাঁদায়। সংক্ষুব্ধ ও আপ্লুত করে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের ‘বৃষ্টি বৃষ্টি’ প্রথম কবিতায় যেমন তিনি উল্লেখ করেন-

“এইক্ষণে আঁধার শহরে প্রভু বর্ষায়, বিদ্যুতে/নগ্ন পায়ে ছেঁড়া পাৎলুনে একাকী/হাওয়ায় পালের মতো শার্টের ভেতরে/ঝকঝকে,সদ্য, নতুন নৌকার মতো একমাত্র আমি,/আমার নিঃসঙ্গে তথা বিপর্যস্ত রক্তে মাংসে/নূহের উদ্দাম রাগী গরগরে লাল আত্মা জ্বলে….”/তেমনই সমাজের বৈষম্য তথা রাষ্ট্রপুঞ্জের সীমাহীন নিপীড়ন-নিষ্পেষণ আর সামরিক শাসনের উৎকট ঈগলদৃশ্যে কবিও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন-/“ রাষ্ট্র মানেই রাষ্ট্র সংঘের ব্যর্থতা/রাষ্ট্র সংঘের ব্যর্থতা মানেই/লেফট, রাইট, লেফট্ রাইট লেফট…”

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে একাত্তুরের পঁচিশে মার্চের কালো রাতের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতম গণহত্যার পর মৃত নগরী ঢাকা শহরের বিধ্বস্ততায় শহীদ কাদরীকে বেদনাহত করে তোলে। তাইতো তাঁর ‘নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে’ কবিতার লাইনগুলো এভাবে ফুটে উঠে: “ভোরের আলো এসে পড়েছে ধ্বংসস্তুপের ওপর। /রেস্তোরাঁ থেকে যে ছেলেটা রোজ/প্রাতঃরাশ সাজিয়ে দিতো আমার টেবিলে/তে-রাস্তার মোড়ে তাকে দেখলাম শুয়ে আছে/রক্তাক্ত শার্ট পরে,/বন্ধুর ঘরে যাওয়ার/ রাস্তায় ডিআইটি মার্কেটের ভস্মাবশেষ,/প্রতিরোধের চিহ্ন নিয়ে বিবর্ণ রাজধানী দাঁড়িয়ে রয়েছে,/তার বিশাল করিডোর শূন্য। /শহর ছেড়ে চলে যাবে সবাই। ”(এবং চলে যাচ্ছে দলে দলে)

এভাবেই কবি শহীদ কাদরী কবিতার রাজ্যে সর্ববিস্তরী হয়ে জেগে থাকবেন। মানুষের মাঝে প্রেম-বিরহ , আর্তনাদ কিংবা রাশি রাশি ভালোবাসার অন্বেষণে তাঁর কবিতা নিখুঁতভাবে পথ দেখাবে ।

আগেই উল্লেখ করেছি যে, শহীদ কাদরীর কাব্য মানস ছিল আকাশচুম্বি। তারুণ্যোদ্দীপ্ত পঞ্চাশের শেষদিকে এবং ষাট দশকের পুরোভাগে শহীদ কাদরী কবিতাচর্চায় সক্রিয় হয়ে উঠেন। তখনো তাঁর কোন বই বের হয়নি। অথচ আধুনিক বাংলা কবিতার জগতে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন।

তাঁর প্রখর মেধা ও মননের তীক্ষ্নতার কথা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে কলকাতার দেশ পত্রিকায় কবিতা ছাপা হয়েছিল। সেই কবিতার সংখ্যাটি ঢাকার আধুনিক কবিতার বরপুত্র শামসুর রাহমানের দৃষ্টি এড়ায়নি। পুরানো ঢাকার শ্রীষদাশ লেনের বিউটি বোডিংয়ের কবিতার আড্ডার প্রথম দর্শনেই তরুণ কবি শহীদ কাদরী তাঁর আলিঙ্গন লাভ করেন। তারপর থেকে কয়েক বছর ঢাকায় এবং স্বাধীনতার পর অর্থাৎ আশির দশকের শেষদিকে বাংলাদেশ ছাড়েন। ইউরোপ, জার্মান অতঃপর আমেরিকায় কাটে জীবন। প্রবাসে এসে একটানা তিরিশ বছর তিনি কোন কবিতা লিখেননি। কেন লিখেননি সে জবাব চেয়ে অনেক প্রশ্ন করলেও উত্তর মিলেনি। অথচ জীবনের শেষ দিকে তিনি আবার জেগে উঠলেন। প্রবাসজীবনের প্রান্তিকতার কঠিন বাস্তবতার এক পর্যায়ে তাঁর মানস ও কাব্যবোধ আবার গর্জে উঠলো। কোন অসুখ-বিসুখ তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারলো না।

তার প্রেমের এই চলমানতা উপমা উৎপ্রেক্ষার চঞ্চলতাকে প্রবল করেছে। একটি প্রগাঢ় প্রতিশ্রুতির দৃঢ় প্রস্তুতি লক্ষ্য করা গেছে এই ধরনের কবিতায়। হাতাশা হাপিত্যেশ আর দুঃখ সুখে আবৃত প্রেমের ভুবনকে তিনি নতুন রঙের ছাট লাগিয়েছেন।

কবি শহীদ কাদরীর বর্ণবহুল জীবনের বৈচিত্র এতই প্রদীপ্ত ছিল তা আমার মত ক্ষুদ্রজনের পক্ষে ব্যক্ত করা বেমানান এবং কঠিন। তাঁর সঙ্গে কতজনের কত স্মৃতি আছে। সেসব স্মৃতির রেশ টেনে এতটুকু বলা যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-“নাহি জানে কেউ/ রক্তে তোর নাচে আজি সমুদ্রের ঢেউ,/ কাঁপে আজি অরণ্যের ব্যাকুলতা;/ মনে আজি পড়ে সেই কথা-”।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি শহীদ কাদরীর অবর্তমানে কাব্যজগতে মহাশূন্যতা বিরাজিত (!)। এই প্রসঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতা যা পরবর্তীতে চিরন্তন গান হয়ে আছে-“যেদিন আমি থাকব নাক থাকবে আমার গান/বলবে সবাই, “কে সে কবির কাঁদিয়েছিল প্রাণ?”/আকাশ-ভরা হাজার তারা/রইবে চেয়ে তন্দ্রহারা,/সাথে সাথে জাগবে রাতে, চাইবে আকাশে,/আমার গানে পড়বে মনে আমায় আভাসে।”

কবি শহীদ কাদরীর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়টিও সে রকম, যা আমাদের সর্বদা কাঁদায়। আপ্লুত করে। তাঁকে নিয়ে এক ধরনের শূন্যতা ও স্মৃতি সাহিত্যানুরাগী এবং কবিতাপ্রেমীদের সর্বদাই কাঁদাবে। হ্যাঁ, হৃদয়ের একান্ত অনুভবের মধ্যদিয়েই স্মৃতিকে লালন করতে হয়। কেননা মানুষ মাত্রেই স্মৃতির অতলে থাকা, আর স্মৃতির মধ্যেই মানুষের বসবাস। যেটি কোন কিছুর সাথে তুলনা করা যায় না। মাত্র তিনটি কাব্য গ্রন্থ উত্তরাধিকার(১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন: প্রিয়তমা(১৯৭৪), কোথাও কোন ক্রন্দন নেই(১৯৭৮) এই তিনটি বই লিখে কবি শহীদ কাদরী বাংলা সাহিত্যে যে বিশাল জায়গা দখল করে আছেন। বাংলা কবিতার জগতে তাঁর উচ্চকিত মর্যাদা ও গৌরব কখনও ম্লান হবে না।

কথায় আছে- ‘শেষ ভালো যার সব ভালো তার’। জীবনের শেষদিকে শহীদ কাদরী সেই ভালোর পূর্ণতায় ঝলসে উঠলেন। প্রবাসের নিঃসঙ্গতার তিমির ভেদ করে হয়ত: সেজন্যেই তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘আমার চুম্বনটুকু পৌঁছে দাও’ প্রকাশ হয়েছিল। সেটিই তাঁর ‘সব ভালো’র সাক্ষ্য বহন করে। আধুনিক বাংলা কবিতার একজন অগ্রগণ্য কবি হিসাবে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। জীবন ও কর্মের বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের ঔজ্জ্বল্যে বেঁচে থাকবেন চিরকাল। কবিতাই তাঁকে অমর করে রাখবে ।

(২৮ আগষ্ট কবি শহীদ কাদরীর প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি)

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।

Print Friendly

Related Posts