বই ll ম. আমিনুল হক চুন্নুর “সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজভাবনা”

শিউল মনজুর

ম. আমিনুল হক চুন্নু সিলেটের সামাজিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত আমিনুল হক চুন্নু লেখক অঙ্গনেও পরিচিত। সম্প্রতি সিলেটের উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা সংস্থা নাগরী থেকে বেরিয়েছে তার “সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজভাবনা” বইটি।

রাষ্ট্র থেকে শুরু করে সমাজ অঙ্গনের নানা বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে লিখিত প্রবন্ধ/নিবন্ধের মলাটবন্দী বইটির আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ এঁকেছেন, এই সময়ের তরুণ প্রতিভাবান শিল্পী আল নোমান। ২৪৪ পৃষ্টার এই বইটি লেখক উৎস্বর্গ করেছেন বাবা মো. মখলিছ মিয়া ও মা সমতেরা বেগমকে।

৫৫০ টাকা মূল্যের এই বইটির সূচিপত্রে যুক্ত হয়েছে, সংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য (১১), স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর এবং আজকের বাংলাদেশ (৪০), নারী উন্নয়নে ক্ষুদ্র ঋণের প্রভাব (৪৬), বাংলা সনের উৎপত্তি ও নববর্ষ বরণ উৎসব (৪৮), মাতৃভাষা চর্চায় ছেদ পড়েছে : মূল্যায়ণ অতি জরুরী (৫৩), জাতি গঠনে যুব সমাজের ভূমিকা (৫৮), বাংলা সংস্কৃতি কী স্বকীয়তা হারাচ্ছে (৬২), শিশুদের মানসিক বিকাশে খেলাধুলা (৬৮), মাদকাশক্তির ভয়াল করাল গ্রাস : একটি সমাজতাত্তিক বিশ্লেষণ (৭৩), শতবর্ষের শিক্ষার এক অবিচ্ছিন্ন বন্ধন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১১০), বেসরকারী শিক্ষকদের দাবী যৌক্তিক : বাস্তবায়ন চাই (১২৮), বর্বর দশা থেকে সভ্যজগতের রুপান্তর (১৩৬), পর্যটন শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা ও করণীয় (১৪২), পয়লা বৈশাখ ও উৎসব (১৬২), ছাত্রসমাজ ও সন্ত্রাসে রাজনীতির প্রভাব এবং আমাদের করণীয় (১৬৭), সমাজ উন্নয়ন ও অবক্ষয় দূরীকরণে পরিকল্পিত পরিবার (১৯২), প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব (১৯৫), মুরারিচাঁদ কলেজ : শত বছরেও একটুও কমেনি তার রূপলাবণ্য (১৯৭), সাহেদা রহমান : একজন নিরহংকারী ও আদর্শ শিক্ষকের নাম (২০২), ইভটিজিং একটি সামাজিক ব্যাধি : প্রয়োজন সচেতনতা (২০৬), করোনা ভাইরাস : চলমান বাস্তবতা (২১৪), মুমিনদের জন্য প্রশিক্ষণের মাস : মাহে রমজান (২২৫), ইদ উৎসব : কল্যাণ ও মঙ্গলের শ্বাশত বাণী (২৩৬) প্রভৃতি মূল্যবান বিষয়।

সুচিবদ্ধ বিষয়গুলোর দিকে নজর দিলেই অনুমান করে নেয়া যায় লেখক আমিনুল হক চুন্নু যখন রাজপথ দিয়ে হাঁটেন তখন তিনি শুধু হাঁটেন না, হাঁটতে হাঁটতে তিনি চারপাশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিষয়গুলিও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। আবার তিনি যখন রাজপথ ছেড়ে সমাজের অলিগলি দিয়ে ঘুরে বেড়ান তখনো তিনি অবলোকন করেন তার চারপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা কিংবা চারপাশের ঘটে যাওয়ার ঘটনা কখনো তাকে আন্দোলিত করেছে, কখনো বা গভীরভাবে তাকে ভাবিত করেছে। মূলত তিনি একজন সচেতন মানুষ এবং সচেতন মানুষ বলেই সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়গুলি তাকে ছুঁয়ে যায়, নাড়া দিয়ে যায়। শিশুদের মানসিক বিকাশে খেলাধুলা যেমন প্রয়োজন তেমনি অপরদিকে সমাজকে মাদকমুক্ত করার তাগিদও তিনি অনুভব করেন এবং অনুভব করেন বলেই রাষ্ট্র ও সমাজের চারপাশের সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তোলার অভিপ্রায়ে আমাদেরকে উপহার দেন; জাতিগঠনে যুবসমাজের ভূমিকা, প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব, মাদকাশক্তির ভয়াল করাল গ্রাস : একটি সমাজতাত্তি¡ক বিশ্লেষণ, সমাজ উন্নয়ন ও অবক্ষয় দূরীকরণে পরিকল্পিত পরিবার এর মতো গুরুত্বপূর্ণ রচনা।

বইটির অন্তর্ভূক্ত বিষয়গুলো শুধু বর্ণনাযোগ্য নয়, এ সবের ভেতরে তথ্য আছে, উপাত্তও আছে। যা নিবন্ধগুলোর গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। এখানে বইটির প্রিয় পাঠকের জন্য একটি নিবন্ধের উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরছি-

খ্রিস্ট জন্মের প্রায় ৬,০০০ বছর পূর্বে সুমেরীয় সভ্যতার যুগে এশিয়া মাইনরে আফিয়াম পপিকে আনন্দ উদ্দীপক হিসেবে ব্যবহারের কথা জানা যায়। এশিয়ার তাইওয়ানে আজ থেকে প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্বে গাঁজার ব্যবহার ছিল যা প্রত্নতাত্তি¡ক নিদর্শন থেকে জানা যায়। চীনে মাং হুয়াং নামক ড্রাগ ইনহেলেন্টরূপে ব্যবহার হতো ৩,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। অপরদিকে ভারতবর্ষে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে গাঁজা এবং চরাসের প্রতি আসক্তি লক্ষ করা গেছে। আমাদের দেশে নওগাঁ জেলায় গাঁজার চাষ স্মরণাতীত কাল থেকে হয়ে আসছে বলে জানা যায়। আর বাংলাদেশের প্রাচীন সুঁড়িখানায় গাছের ছাল-বাকল দিয়ে চোলাই মদ তৈরীর তথ্য পাওয়া যায় ৬০০ থেকে ১,০০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে রচিত চর্যাপদে। (মাদকাসক্তির ভয়াল করাল গ্রাস : একটি সমাজতাত্তিক বিশ্লেষণ। পৃষ্টা-৭৯)

প্রায় প্রতিটি নিবন্ধের মধ্যে এমন সব তথ্য লক্ষণীয়। এতে নিবন্ধগুলোর গুরুত্বও বেড়েছে যথেষ্ট। “সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজভাবনা” বইটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা হচ্ছে, সংস্কৃতি ও লোক সাহিত্য। এই রচনাটির মধ্যে আঞ্চলিক ছড়া, সিলেটের লোক সাহিত্য, দামাইল গীত, লোকজ ও আঞ্চলিক ধাঁধা এর মতো আকর্ষণীয় বিষয় নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। যা বইটির গুরুত্ব অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে।

ম. আমিনুল হক চুন্নু দীর্ঘ পঁচিশ বছর শিক্ষকতা করেছেন। তার জীবন অভিজ্ঞতার সঞ্চয় বেশ সমৃদ্ধ। তার লেখাগুলো পাঠ করলে সহজেই তা উপলব্ধি করা যায়। রচিত লেখাগুলোর ভাষাও ঝরঝরে, যা সব শ্রেণীর পাঠকমাত্রই তাঁর ভাবনার অংশীদার হতে পারেন। লেখালেখি, গবেষণা, শিক্ষকতা ও সমাজকর্মের অবদানের জন্যে ম. আমিনুল হক চুন্নু অর্জন করেছেন দুটি পুরস্কার। একটি নবাব ফয়জুন নেছা ফাউন্ডেশন স্বর্ণ পদক এবং অন্যটি আইডিয়াল আওয়ার্ড।

আমার মতো সাধারণ পাঠকের নিকট “সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজভাবনা” বইটির মূল্য অপরিসীম। মনে করি, ছাত্র-শিক্ষক, সাধারণ পাঠকসহ সকলের নিকট বইটি সমাদৃত হবে, তেমনি ভবিষ্যতে গবেষণা কার্যে বইটি বহুল ব্যবহৃত হবে। স্বল্প ভাষণে বলা যায়, বইটি নিঃসন্দেহে সংগ্রহযোগ্য একটি সময় উপযোগী বই।

 

লেখক:কবি, মেরীল্যান্ড-আমেরিকা প্রবাসী।

Print Friendly

Related Posts