মো. মেহেদী হাসান: ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ১৭ বছর পেরিয়ে ১৮ বর্ষে পদার্পণ করলো। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ১৭ বছর পেরোলেও ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী প্রতিষ্ঠানটি মূলত ১৬৪ বছর পেরিয়েছে।
১৮৫৮ সালে ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল থেকে কালের বিবর্তনে আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আর তখন থেকেই কর্তৃপক্ষ ২০ অক্টোবরের দিনটিকে ’জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদার জগন্নাথ রায় চৌধুরী বুড়িগঙ্গার তীরে একটি পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেন যা ‘জগা বাবুর পাঠশালা’ নামে পরিচিত ছিল। তৎকালীন ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা দীননাথ সেন, অনাথবন্ধু মৌলিক, পার্বতী চরণ রায়, ব্রজসুন্দর মিত্র প্রমুখের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ব্রাহ্ম ধমের্র মূল মতবাদ সম্পর্কে সাধারণ ছাত্রদের শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় ব্রাহ্ম সমাজের নিজস্ব জায়গায় জগা বাবুর পাঠশালাকে স্থানান্তর করে ‘ব্রাহ্ম স্কুল’ নামে একটি অবৈতনিক স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
আর্থিক সংকটের কারণে ১৮৭২ সালে মালিকানা পরিবর্তন ঘটে ব্রাহ্ম স্কুলের। স্কুলের ভার গ্রহণ করেন জগন্নাথ রায় চৌধুরীর সুযোগ্য পুত্র বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী। কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ব্রাহ্ম স্কুলের নাম পরিবর্তন করে তার বাবা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে ‘জগন্নাথ স্কুল’ নামকরণ করেন এবং স্কুলটিকে স্থানান্তর করে বর্তমান জায়গায় নিয়ে আসেন।
১৮৮৪ সালে জগন্নাথ স্কুলের নাম পরিবর্তন করে ‘জগন্নাথ কলেজ’ রাখা হয় এবং এসময়ে এটি দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজের মর্যাদা লাভ করে।
১৮৮৭ সালে ‘কিশোরীলাল জুবিলি স্কুল’ নামে এর স্কুল শাখাকে জগন্নাথ কলেজ থেকে পৃথক করা হয় যা বর্তমানে ‘কে. এল. জুবিলি স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ নামে পরিচিত। শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় জগন্নাথ কলেজ ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজের মর্যাদা লাভ করে।
পরবর্তীতে ১৯২০ সালে জগন্নাথ কলেজ আইন পাস করে ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু এরপরের বছরই ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে শুধু ইন্টারমিডিয়েট কলেজে রূপান্তর করা হয়। নামকরণ হয় ‘জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ’।
জগন্নাথ কলেজের গ্রন্থাগারের ৫০ ভাগ দূর্লভ ও মূল্যবান বই দিয়েই সাজানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার। ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় জগন্নাথ কলেজের নিজস্ব সম্পত্তির ওপর নির্মিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল। এছাড়াও জগন্নাথ কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বেঞ্চ, টেবিল-চেয়ার নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে।
১৯৪৯ সালে দীর্ঘ ২৮ বছর পর জগন্নাথ কলেজে আবারও স্নাতক কার্যক্রম চালু হয় এবং নাম পরিবর্তন করে পুনরায় ‘জগন্নাথ কলেজ’ রাখা হয়।
১৯৬৮ সালে মোনায়েম খাঁন জগন্নাথ কলেজকেন্দ্রিক স্বাধিকার আন্দোলনকে রুখতে না পেরে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এক পর্যায়ে জগন্নাথ কলেজকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। ছয়মাস বন্ধ থাকার পর শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে কলেজ পুনরায় চালু করতে বাধ্য হন। কিন্তু মোনায়েম খাঁন জগন্নাথ কলেজকেন্দ্রিক সরকারবিরোধী আন্দোলনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নানা কূটকৌশলের মাধ্যমে একে সরকারি কলেজে রূপান্তর করেন এবং কলেজের সমগ্র ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেন। তখন একে সরকারিকরণ (প্রাদেশিকীকরণ) করে শুধু বিজ্ঞান কলেজে রূপান্তর করা হয়। জগন্নাথ কলেজের বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগকে সরিয়ে মহাখালীতে নতুন ‘জিন্নাহ কলেজ’ নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা বর্তমানের ‘সরকারি তিতুমীর কলেজ’।
১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফায় জগন্নাথ কলেজকে সরকারিকরণের বিরোধিতা করলে ওই বছরই জগন্নাথ কলেজ আবার পূর্বের ন্যায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ফিরে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জগন্নাথ কলেজে সকল বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স চালু হয়। সে সময় দেশের অন্যান্য কলেজের ন্যায় এই কলেজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজ ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৯২ সালে ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৯১-৯২ শিক্ষাবর্ষ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চলতে থাকে।
বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬ টি বিভাগ ও ২ টি ইনস্টিটিউটের অধীনে ১৪ হাজার ৮৭৬ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এছাড়াও এম ফিল এ ২৪৫ জন ও পিএইচডি তে ১৪১ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এখন পর্যন্ত জবিতে ৪ জন বিদেশী শিক্ষার্থী ভর্তি হন। বর্তমানে ৩ জন বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ টি বিভাগে প্রফেশনাল প্রোগ্রাম চালু রয়েছে, আরও বেশ কয়েকটি বিভাগে চালুর প্রস্তুতি চলছে। এখানে ৬৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৬৭৮ জন শিক্ষক রয়েছে। যার মধ্যে অধ্যাপক রয়েছেন ১৪৪ জন। তন্মধ্যে গ্রেড-১ এর ৩৫ জন ও গ্রেড-২ এর ৪৮ জন। এছাড়াও সহযোগী অধ্যাপক ১৭৭ জন, সহকারী অধ্যাপক ২৯০ জন ও প্রভাষক ৬৭ জন।
অনেক চড়াই উতরাই পেরোনোর পর গত বছরের ২০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রী হল বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে হলটিতে ১২০০ ছাত্রী অবস্থান করছেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জে ২০০ একর জমির উপর নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের কাজও চলমান। ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য মোট বাজেট নির্ধারণ করা হয় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। দুই বছরের এ প্রকল্পের মেয়াদ পরে বাড়ানো হয় আরও দুই বছর। তবে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পূর্ণ শেষ হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ আরেক দফা বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এদিকে ২০০ একর জায়গার মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৮৮ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে, নানা জটিলতায় আটকে আছে বাকি ১২ একর অধিগ্রহণের কাজ। আর তাই জমি অধিগ্রহণ সম্পূর্ণ না হওয়ায় সীমানাপ্রচীরের কাজও আটকে আছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে বলছে, নতুন ক্যাম্পাসের কাজ হতে আসলেই দেরি হয়ে গেছে। এখন কিভাবে দ্রুত করা যায় আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে ওনাকে জানাবো।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেয়ে আমি সত্যিই আনন্দিত। এটি আমার জন্য সম্মানেরও বটে। পূর্ণ যৌবনে পা রাখা একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে নেতৃত্ব দিতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি৷