আগামীর সুরক্ষায় ডায়াবেটিস শিক্ষা

লে. কর্ণেল ডা. নাসির উদ্দিন আহমদ 
আজ ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে ১৯৯১ সাল থেকে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় আগামীর সুরক্ষায় ডায়াবেটিস শিক্ষা।
পৃথিবী জুড়ে ডায়াবেটিস রোগীদের সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে প্রতি ১০ জন মানুষের মাঝে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০৪৫ সাল নাগাদ এ সংখ্যা প্রতি ৮ জনে একজন হয়ে যাবে। স্থুলতা, পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস, আয়েশী যাপিত জীবন, শরীরচর্চা বিমুখতা ডায়াবেটিসের প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে গোটা বিশ্বে।
ডায়াবেটিসের মূল সমস্যা হলো রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য অগ্নাশয় থেকে নিঃসরিত হয় ইনসুলিন নামক প্রাণরস। ডায়াবেটিস রোগীদের অগ্নাশয় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে ইনসুলিন তৈরী হয় না অথবা এগুলো থাকে অকার্যকর। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে ইনসুলিন তৈরির কারখানা অর্থাৎ অগ্নাশয় তার কার্যকারিতা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসে অগ্নাশয় থেকে ইনসুলিন তৈরি হয় বটে কিন্তু এগুলো থাকে ভোঁতা, অকার্যকর। কারো টাইপ-২ ডায়াবেটিসে যখন প্রথম নির্ণীত হয় তখন শতকরা ৫০-৬০ ভাগ অগ্নাশয়  কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে শতকরা ৯০ ভাগের বেশি অক্ষম থাকে অগ্নাশয়।
অনেকের ডায়াবেটিসের শুরুতে তেমন কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তবে ওজন হ্রাস, ক্ষুধা-পিপাসা বৃদ্ধি অতিরিক্ত প্রস্রাব, ক্লান্তি, ঝাপসা দৃষ্টি, বারবার প্রস্রাবে প্রদাহ, ঘা না শুকানো ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান উপসর্গ হিসাবে অনেকের মাঝে প্রকাশ পায়। অনেক ক্ষেত্রে টাইপ-১ ডায়াবেটিস শুরুতে মারাত্মক জটিলতা হিসাবে আবির্ভূত হয়। এ সমস্ত রোগীদের শুরুতে দেখা দেয় ডায়াবেটিক কিটো এসিডোসিসের মতো মারাত্মক জটিলতা যা মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।
বয়স্কদের কিডনি বিকল হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ডায়াবেটিস। এমনকি তাদের অন্ধত্বের পিছনে সিংহভাগ কারণ রক্তে অনিয়ন্ত্রিত চিনির মাত্রা। হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং অন্যান্য রক্তনালী সংক্রান্ত রোগ ডায়াবেটিসের কারণে বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। ডায়াবেটিস রোগীদের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পায়ে সৃষ্টি হয় মারাত্মক ক্ষত। অনেক সময় পা কেটে পর্যন্ত ফেলতে হয়। পুরুষদের যৌন শক্তি হ্রাসের পেছনে ডায়াবেটিস একটি বড় ভূমিকা পালন করে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে ডায়াবেটিস কিটো এসিডোসিস এর মতো মারাত্মক জটিলতা তৈরি হতে পারে। যা টেনে নিয়ে যেতে পারে মৃত্যুর দরজায়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন, নিয়মিত শরীর চর্চা, ওজন নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলাপূর্ণ মানসিক চাপমুক্ত জীবনযাপন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন।
যেসব খাবার রক্তে চিনির মাত্রা দ্রুত গতিতে বাড়িয়ে দেয় সে সব খাবার অবশ্যই পরিহার করতে হবে। চিনি, চিনির তৈরি মিষ্টান্ন জাতীয় যাবতীয় খাবার, ময়দার তৈরীর খাবার খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। শর্করা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। আমরা ক্ষেত্রবিশেষে শতকরা ৮০ ভাগের বেশি খাবার শর্করা  থেকে গ্রহণ করে থাকি। শর্করার পরিমাণ ৫০ থেকে ৬০ ভাগে নিয়ে আসতে হবে। খাদ্য তালিকায় স্থান দিতে হবে অঢেল শাকসবজি এবং টক জাতীয় ফল-মূল।
প্রতিদিন হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। প্রতিদিন নিদেনপক্ষে ৩০ মিনিট জোর কদমে ঘাম ঝরিয়ে হাঁটতে হবে। হাঁটলে ইনসুলিন কার্যকর থাকে, ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। পেশী কোষ গ্লুকোজ কাজে লাগাতে পারে। ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে। যাদের ইনসুলিন এর প্রয়োজন তাদের অবশ্যই ভয়-ভীতি কাটিয়ে ইনসুলিন চিকিৎসা যথা সময়ে শুরু করতে হবে। ইনসুলিনের ভয়ে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কাছে জীবনকে সঁপে দেয়া হবে অত্যন্ত মারাত্মক।
লেখক: মেডিসিন স্পেশালিস্ট ও এন্ডােক্রাইনােলজিস্ট, সিএমএইচ।
চেম্বার :আল রাজি হাসপাতাল( ২ য় তলা) ফার্মগেট, ঢাকা।
মোবাইলঃ
০১৭৫৬১৭৩৭৬৫
০১৭২৬০৫০৯১২
Print Friendly, PDF & Email

Related Posts