ক্রোয়েশিয়ার সামনে অন্য আর্জেন্টিনা

লিওনেল স্কালোনির সংবাদ সম্মেলনের অন্য রকম আকর্ষণ আছে। অতিকথন নেই, স্বপ্নের বাড়াবাড়ি নেই, ফুটবলটা যেন স্রেফ একটা খেলা। খেলার পর হার-জিত যা হয়, মেনে নিয়ে মাঠে ছেড়ে যাও। সমস্যা হচ্ছে তাঁর মতো করে কেউ ভাবে না।

বিশেষ করে আর্জেন্টিনার সমর্থকরা বাস করে এক ‘স্বপ্নের জগতে’, সেখান থেকে তাদের বের করে আনা বড় কঠিন। তাই কাতারে ফুটবলের হাওয়ায় প্রতিশোধ, চাপ-তাপ ইত্যাদি হাজির হয়ে আর্জেন্টাইন কোচের সহজ ফুটবল আর সহজ থাকছে না, ‘ক্রোয়েশিয়া কঠিন প্রতিপক্ষ, তবে আমরা এবার অন্য দল। ’

আগেরবারের দল ছিল হোর্হে সাম্পাওলির পাগলামিতে ঠাসা। এই কোচের খেয়াল-খুশিমতোই সব হয়েছিল। সেই দল রাশিয়ায় গ্রুপে ৩-০ গোলে হেরেছিল ক্রোয়েশিয়ায় কাছে। এই দল লিওনেল স্কালোনির। তারুণ্যে ভরা দলের গুণগত মান ও বিশ্বাসের জায়গা অনেক শক্তিশালী। মিল বলতে সেই দলের ক্ষুব্ধ লিওনেল মেসি এখন বেজায় খুশি। পঁয়ত্রিশেও দলের মধ্যমণি হয়ে ‘লা স্কালোনেটা’র বিশ্বকাপ গাড়ির চালক। তাই স্কালোনি রাশিয়া বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা দলের সঙ্গে তুলনায় যেতে চান না, ‘আমাদের এই দল ভিন্ন, তাদের সঙ্গে আগের দলের তুলনায় যাব না। তবে এমন একটা দলের বিপক্ষে ম্যাচ খেলতে যাচ্ছি, যারা সত্যিকারভাবে একটা দল হিসেবে খেলে। এটুকু বলতে পারি, একটা ভালো দল আমাদের চ্যালেঞ্জ জানাতে আসছে। ’

সমর্থকরা চ্যালেঞ্জের জবাবে প্রতিশোধের হাওয়া তুললেও আর্জেন্টিনার কোচ বেশ শান্ত ও ধীরস্থির। তিনি হাওয়ায় গা না ভাসিয়ে বরং প্রতিপক্ষকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। যারা গতবার রানার্স আপ হয়েছে তাদের সামর্থ্যকে কুর্নিশ জানান এবং সেই দলের প্রাণভোমরাকে নিয়ে ছক কষছেন, ‘মাঠে তার খেলা দেখা খুব আনন্দের। তার খেলা ও ব্যবহার দিয়ে মডরিচ হতে পারে এক অনুকরণীয় চরিত্র। সে নিশ্চয়ই ম্যাচটা উপভোগ করার চেষ্টা করবে। আমাদের লক্ষ্য প্রতিটি ম্যাচ ধরে সামনে এগোনো। ’ মডরিচকে ম্যাচ উপভোগের সুযোগ দিতে চান না তিনি। এ নিয়ে যে তাঁর অঙ্ক আছে, সেটা আর খোলাসা করেননি।

কৌশলের ছক কষতে গিয়েও কোচ নিশ্চিতভাবে অনেক সমস্যা দেখছেন। আগের ম্যাচের আট হলুদ কার্ডের কোপে ঝরে গেছেন দুই ফুটবলার—অ্যাকুনা ও মন্টিয়েল। অ্যাকুনার জায়গায় ফিরছেন ডিফেন্ডার তেগলিয়াফিকো। তা ছাড়া দি মারিয়া ও দি পলের চোখাটে চোট আছে। বড় ম্যাচে এগুলো বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় না। দি পল খেলবেন আর দি মারিয়াকে দেখা যেতে পারে বদলি হিসেবে। তাঁর জায়গায় লিয়ান্দ্রো পারেদেস কিংবা লিসান্দ্রো খেলবেন। একাদশের কম্বিনেশন মোটামুটি সাজিয়ে ফেলেছেন লিওনেল স্কালোনি। সেখানে যাঁরাই থাকুক, ম্যাচ বের করার আসল কারিগর লিওনেল মেসি। তাঁর জাদুকরী পায়ে কখন গোলের মুহূর্ত জেগে উঠবে, সেটা কেউ জানে না। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে যেমন কড়া মার্কিংয়ে থেকেও তিনি জাদুকরী পাসে খুলে দিয়েছিলেন গোলমুখ। সব পথ যখন বন্ধ হয়ে যাবে তাঁর সোনায় মোড়ানো বাঁ পায়ে খুলে যাবে একটি উপায়। এই বিশ্বাস ছড়িয়ে গেছে চারদিকে। এটা দারুণ উপভোগও করেন তাঁর ৪৪ বয়সী কোচ, ‘লিও সব সময় এমনই খেলে। এখানে আমাদের কোচিংয়ের কোনো গুণাগুণ নেই। সে সব সময়ই ম্যাচ উইনার। ’

এদিকে ক্রোয়েশিয়ান সংবাদমাধ্যম বোমা ফাটিয়েছে সেমিফাইনাল জিততে আর্জেন্টিনা অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে বলে। এক আর্জেন্টাইন ক্লাব ফুটবলারের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে, ‘আর্জেন্টিনা ক্রোয়াট খেলোয়াড়দের উত্ত্যক্ত করবে যেন তারা মাথা গরম করে কিছু করে বসে এবং রেফারির কার্ডের শিকার হয়। নেদারল্যান্ডস ম্যাচের মতো তারা এ ট্যাকটিক নেবে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষেও। ’ তবে সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি ক্রোয়েশিয়ান কোচ জ্লাতকো দালিচ। ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষটির সোজাসাপ্টা কথা, ‘প্রতিপক্ষের শক্তিশালী দিকগুলো আমাদের জানা আছে। কিন্তু নিজেদের খেলাটা খেলতে হবে আমাদের। ’ রাশিয়া বিশ্বকাপে ৩-০ গোলে জয়ের ম্যাচ নিয়ে তাঁর কণ্ঠে নেই কোনো আত্মবিশ্বাসের বাড়াবাড়ি, ‘সেটা ছিল গ্রুপের ম্যাচ। এ রকম বাঁচা-মরার লড়াইয়ের ম্যাচ ছিল না। আমাদের দল শক্তিশালী ও কঠিন মানসিকতার। এটা নিয়েই আমাদের সেমিফাইনালে লড়তে হবে। আগের ম্যাচে কারা জিতেছিল, তাতে কিছু আসে যায় না। ’

নির্ধারিত সময়ে না হলে টাইব্রেকারে যাবে ম্যাচ, এ নিয়ে ক্রোয়েশিয়ার কোনো বাড়তি চাপ থাকার কথা নয়। ওখানে গোলরক্ষক ডমিনিক লিভাকোভিচের প্রাচীর দাঁড়িয়ে যাবে। রাশিয়ায়ও নক আউটের প্রথম দুই ম্যাচ টাইব্রেকারে পার হওয়া ক্রোয়েশিয়া এখানেও জাপান ও ব্রাজিল বধে টাইব্রেকারের কোটা পূরণ করেছে। আগের বিশ্বকাপের গতিপথ ধরলে এবার নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে ম্যাচ। নইলে আর্জেন্টিনারও আছে নেদারল্যান্ডস জয় করা ইমি মার্তিনেজ। মেসি-মডরিচের লড়াই নিষ্ফলা হলে দুই ‘প্রাচীরে’ই হবে ফায়সালা।

Print Friendly

Related Posts