রূপকথার গল্পকে পূর্ণতা দিলেন মেসি

একজন মেসি আর ফুটবলের রূপকথার গল্পের ভালোবাসা পূর্নতা পেলো শত-সহস্র বিনিদ্র রজনীর প্রতীক্ষার প্রহর পেরিয়ে। নিজের বাঁ পায়ের জাদুতে সহস্রবার সবুজ গালিচায় ফুটিয়েছেন ফুটবলের ফুল, জিতেছেন ফুটবলের সম্ভাব্য সব শিরোপা। তবুও যেন কোথায় একটা আক্ষেপ। গোধূলিতে এসেই ফুটবলের শ্রেষ্ট সন্তানকে সেই মুকুট উপহার দিলেন ফুটবল বিধাতা।

আর্জেন্টিনা সর্বশেষ বিশ্বকাপ জিতেছিলো ১৯৮৬ সালে ম্যারাডনার হাত ধরে। তারপর পেরিয়ে গেছে ৩৬টি বছর, বারবার আশা জাগিয়েও হতাশ করেছে আলবিসেলেস্তারা। ম্যারাডোনার পর আর্জেন্টাইনদের হয়ে ফুটবলের মশাল হাতে তুলেছে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, পাবলো আইমার, হার্নান ক্রেসপো, ক্যানিজিয়া, তেভেজ, রিকুয়েলমের মত তারকারা। তবে বিশ্বকাপের স্বপন যেন অধরাই থেকে গেছে আকাশী-সাদা জার্সিধারীদের।

অবশেষে ৩৬ বছরের অপেক্ষা পেরিয়ে সেই লিওনেল মেসির হাত ধরেই এলো আর্জেন্টিনার তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা।

বিশ্বকাপের মুকুট তো মাথায় উঠলো গোটা একটা প্রজন্মকে স্বপন দেখানো মেসির হাতেই। তবে তার জন্যঅ তো কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি ফুটবলের এই ক্ষুদে জাদুকরকে। সৃষ্টিকর্তা নাকি তার প্রিয় বান্দাদের পরীক্ষা নিতে ভালোবাসে। ফুটবল বিধাতাও তার শ্রেষ্ঠ সন্তানের পরীক্ষা নিয়েছেন বারবার। ২০০৬ থেকে ২০১৮, টানা চার বিশ্বকাপে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে আর্জেন্টাইনদের স্বপ্নসারথিকে। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে ‘এতো কাছে তবুও এতো দূরের’ আক্ষেপে পুড়েছেন ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে। কোপা আমেরিকার টানা ফাইনাল ব্যর্থতায় অভিমান করেই নিয়েছিলেন অবসরও। তাইলে কি সেখানেই শেষ হয়ে যেত জাদুকরের আজন্ম লালিত স্বপ্ন? না, এতোটাও নিষ্ঠুর না ফুটবল, তেমনটা হতে দেয়নি ফুটবল। সবুজের গালিচায় মেসি আবারও ফিরেছেন আকাশী-সাদা জার্সি গায়ে। আবারও বীরদর্পে বিচরণ করেছেন নিজের চারণভূমি ফুটবলের রাজ্যে।

মরুর বুকে প্রথম বিশ্বকাপে আসার আগেই মেসি ঘোষণা দিয়ে এলেন এটিই হতে চলেছে শেষ বিশ্বকাপ। ক্যারিয়ারের গোধূলিবেলায় এসে সমাপ্তির ঘোষণা দিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের ফেভারিট হিসেবেই কাতারের মাটিতে পা রাখলো মেসির আর্জেন্টিনা। দলের প্রতিটা ফুটবলারের ভেতর জেদ চেপে বসে আছে, জাদুকরকে তার শেষ বিশ্বকাপে শিরোপার সোনালি রঙে রাঙিয়েই বিদায় দিতে হবে। অনুপ্রেরনা হিসেবে কোপা আমেরিকার শিরোপা আর বিশ্বকাপের কিছুদিন আগেই ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে হারিয়ে লা ফিনালিসিমার শিরোপা জয়।

বিশ্বকাপ জয়ের পণ করে এসে প্রথপম ম্যাচেই অপ্রত্যাশিত হার সৌদি আরবের বিপক্ষে। অপ্রত্যাশিত সেই হারে শিরোপা স্বপ্নে বড় এক ধাক্কা খায় আলবিসেলেস্তারা। সেই এক ধাক্কাতেই যেন ভোজবাজির মতো পাল্টে গেলো আর্জেন্টিনা। ওই এক হারের পরই বাকী সবগুলো ম্যাচে দুর্দান্ত ফুটবল উপহার দিয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালেও উঠে গেলো আর্জেন্টাইনরা। গ্রুপ পর্বের পরের দুই ম্যাচ থেকে নক-আউট হয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল বা সেমিফাইনাল, আর্জেন্টিনা ছিলো অপ্রতিরোধ্য।  এই আর্জেন্টিনাকে থামানোর মতো কেউ ছিলো না বিশ্বকাপে।

প্রথম ম্যাচে হারের পরও ঠিক যেন স্বপ্নের মতো এক বিশ্বকাপ পার করেই ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা, যার মূল কারিগর অধিনায়ক লিওনেল মেসি। প্রতিটি ম্যাচে মেসির দুর্দান্ত পারফরম্যান্সই যেন গড়ে দিয়েছে ম্যাচের ফল। ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ, মেসি খেলেছেনও যেন জানপ্রাণ দিয়েই। ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে এসেও যেন সেই চিরতরুণ মেসিকেই মনে করিয়ে দিয়েছে আর্জেন্টাইন মহাতারকার মাঠের পারফরম্যান্স।

মেসির অতিমানবীয় সেই রূপ দেখেই হয়তো এনজো ফার্নান্দেজ বা জুলিয়ান আলভারেজের মতো তরুণদের রক্তও গর্জে উঠলো। একটা সময় ছিলো আর্জেন্টিনা দলকে একা তেনে নিয়ে গেছেন  মেসি, সেই মেসি এবার কাতারের মাটিতে পেয়ে গেলেন তার সেই শুরুর বয়সের বয়সী কয়েকজন যোদ্ধা। সঙ্গে ছিলেন ডি মারিয়ার মতো অভিজ্ঞ তারকার অভিজ্ঞতার ছোঁয়া।

বিশ্বকাপজুড়েই নিজের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স আর সতীর্থদের যোগ্য সমর্থন, আর্জেন্টিনাকে তুলে আনলো ফাইনালে। আরাধ্য সেই বিশ্বকাপের স্বপ্নে সামনে বাধা শুধুমাত্র গত আগের বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। মেসি আর বিশ্বকাপ শিরোপার মধ্যে দূরত্ব তখন মাত্র ৯০ মিনিট।

ফাইনাল অবশ্য শেষ হলো না ৯০ মিনিটে। অতিরিক্ত সময় পেরিয়ে বিশ্বকাপের ফাইনাল গড়ালো টাইব্রেকারে।  শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালের পরতে পরতে বেড়েছে উত্তেজনার পারদ। অধিনায়কের আর্মব্যান্ড হাতে মাঠে নামা মেসি দলকে দিলেন সামনে থেকেই নেতৃত্ব। প্রথম গোল করে এগিয়ে দিলেন আর্জেন্টিনাকে। ডি মারয়ার দ্বিতীয় গোলের সূচনাও মেসির পা থেকেই। বিশ্বকাপ শিরোপাটা যখনই ছুঁইছুঁই করছেন  তখনই দৃশ্যপটে আগমন মেসিরই ক্লাব সতীর্থ কিলিয়ান এমবাপ্পের। দুই মিনিটে দুই গোল করে ফাইনালনিয়ে গেলেন অতিরিক্ত সময়ে।

অতিরিক্ত সময়ে প্রকৃত নেতার মতোই নিজের কাজটা সারলেন মেসি। আবারও ফ্রান্সের জালে বল জড়িয়ে শিরোপা ছোঁয়ার স্বপ্নকে আরেকটু কাছে আনলেন মেসি। তবে আবারও ভিলেন হিসেবে মঞ্চে আগমন এমবাপ্পের। পেনাল্টি থেকে গোল করে আবার সমতায় ফেরালেন ফ্রান্সকে।

টাইব্রেকারে গড়ালো বিশ্বকাপের ফাইনাল। টাইব্রেকারকে অনেকেই বলে ভাগ্যের খেলা, তাহলে ফুটবল বিধাতা কি সঙ্গ দেবেন মেসির, বিদায়ের মঞ্চ থেকে খালি হাতেই ফেরাবেন জাদুকরকে। না, ফুটবলবিধাতা এবার সদয় হলেন। মেসির জন্য যুদ্ধেও যেতে পারবেন এমন ঘোষণা দেওয়া আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ নিজের দুই হাতেই যেন বিশ্বকাপের শিরোপা উপহার দিলেন মেসিকে।

৩৬ বছরের অপেক্ষা পেরিয়ে বিশ্বকাপের স্বাদ পেলো আর্জেন্টাইনরা। আর ক্যারিয়ারজুড়ে পরম আরাধ্য হয়ে থাকা বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিতে চুমু একে দিলেন মেসি নামক মহাতারকা।

মেসি নামের ফুটবল মহীরুহের হাতে উঠলো বিশ্বকাপের শিরোপা। অনন্ত প্রতীক্ষার প্রহর পেরিয়ে ফুটবলের শ্রেষ্ট সন্তান পেলো পূর্ণতা। লুসাইলের উৎসবের রাতে বিশ্বকাপের শিরোপা উঠে মেসি পূর্ণতা পেলো আর ফুটবল নিজেও হলো সমৃদ্ধ।

Print Friendly

Related Posts